বিজ্ঞাপন

মুকুটনাইটের মেয়েরা

June 19, 2021 | 12:05 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো : কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েদের কথা এখনও মনে গেঁথে আছে নিশ্চয় ! ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামটির মেয়েদের কথা, ফুটবল খেলে যারা গ্রামটিকে নিয়ে এসেছিলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। নাড়া দিয়েছিলেন এমপি-মন্ত্রী থেকে একেবারে সরকারের শীর্ষপর্যায়ে পর্যন্ত।

বিজ্ঞাপন

তেমনই একটি গ্রামের মেয়েদের কথা এবার। মুকুটনাইট গ্রাম। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের মুকুটনাইট গ্রাম। এই গ্রামের একদল স্কুলপড়ুয়া মেয়ে, তারা শুধু হাতে বইখাতা নিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে স্কুলেই যায় না। যাত্রাপথে কেউ যৌন হয়রানির চেষ্টা করলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে, নারীর প্রতি সহিংসতার খবর শুনলে ছুটে গিয়ে রুখে দাঁড়ায়। স্কুলের কোনো সহপাঠী কিংবা গ্রামের কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তারাই বাধা হয়ে সামনে দাঁড়ায়। আবার গ্রামের পথে-পথে, হাটবাজারে ঘুরে সমাজ বদলের চেষ্টায় মাইকিংও করে।

কলসিন্দুরের মেয়েদের মতো মুকুটনাইট গ্রামের মেয়েরাও এখন মাঠে ফুটবল খেলে। শুধু মুকুটনাইট নয়, আশপাশের আরও দশ গ্রামের মেয়েরাও জার্সি পরে মাঠে নামেন, পায়ে ফুটবল নিয়ে দৌড়ান। এই মেয়েরা আলো ছড়াচ্ছেন, সেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশেও।

বিজ্ঞাপন

মুকুটনাইট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী কাজী মায়মুনা রহমান গত ১৪ জুন সকাল ৭টার দিকে স্কুলে আসছিলেন একটি সভায় যোগ দিতে। হেঁটে আসার সময় বাড়ির অদূরে রাস্তা মেরামতের কাজে থাকা কয়েকজন শ্রমিক তাকে দেখে হাসাহাসি করে বিভিন্ন ‘অশ্লীল’ মন্তব্য করতে থাকে। কিন্তু সেটা শুনে নীরবে চলে আসার মতো মেয়ে তো মায়মুনা না ! তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘ভাই, আপনারা যা করছেন, এগুলো অপরাধ। আমি চাইলে পুলিশকে কমপ্লেইন করতে পারি। ট্রিপল নাইনে ফোন করে কমপ্লেইন করলে এক্ষুণি আপনাদের ধরে নিয়ে যাবে।’

মায়মুনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্যসময় হলে চুপ করে চলে আসতাম। কিন্তু এখন আমাদের মধ্যে সাহস আছে। দাঁড়িয়ে যখন প্রতিবাদ করলাম, তখন উনারা আমাকে আপা ডেকে দুঃখ প্রকাশ করেন।’

মুকুটনাইট স্কুল থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী ইরফাত জাহান পিউ, বাড়ি পাশের গ্রাম করণখাইনে। ২০১৯ সালে ইরফাতের সদ্য ১৮ পার হওয়া বড় বোন নুসরাতের বিয়ে ঠিক করে তার বাবা। কিন্তু নুসরাত বিয়েতে আগ্রহী নন, তার ইচ্ছা পড়ালেখা করে চাকরি করবে। আবার বাবাকে একথা বলার সাহসও নেই। নিজের সাহসে ভর করে ইরফাতই দাঁড়িয়ে যান বাবার সামনে।

বিজ্ঞাপন

ইরফাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবার চোখে চোখ রেখে বলি- আপনি যদি বিয়ে বন্ধ না করেন, আমরা আইনের আশ্রয় নেব। আপনি জোর করে তার অমতে তাকে বিয়ে দিতে পারেন না। বাবা বিস্মিত হন, প্রথমে কিছুটা রাগারাগি করেন। তারপর নিজেই বিয়ে ভেঙে দেন। আমার বোন এখন স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী এবং মহিলা অধিদফতরের আওতাধীন পটিয়া কার্যালয়ের আবৃত্তি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে চাকরিও করছে।’

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে একই স্কুল থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী ফারজানা আক্তার জিন্নাতের বিয়ের কথা চলছিল। প্রবাসী বাবা দেশে ফিরে মেয়ের বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেন। এ নিয়ে ফারজানার খুবই মন খারাপ। একদিন ক্লাসে বিষয়টি খেয়াল করেন শিক্ষিকা সুবর্ণা দাশ। তিনি ফারজানাকে একদিন জিজ্ঞেস করেন- ‘কি রে তুই সবসময় মনমরা হয়ে থাকিস কেন ? পড়ালেখায় মনযোগ নেই কেন?’ তখন তিনি সবকিছু খুলে বলেন তাদের ভাষায় ‘সুবর্ণা ম্যামকে’। উনি সাহস দেন। তখন ফারজানা বাবার সামনে গিয়ে বলেন, ‘আব্বা, আমি পড়ালেখা করব, আমার ১৮ বছর হয়নি, আমি বিয়ে করব না।’ বাবা মেনে নেন মেয়ের কথা।

এমন আরও মায়মুনা-ইরফাত-ফারজানা ছড়িয়ে আছে পটিয়ার গৈড়লা, কেলিশহর, ছত্তারপেটুয়া, তেগোটা, ত্রিপুরা দিঘীর হাট, ঈশ্বরখাইন, গোবিন্দরখীলসহ আরও কয়েকটি গ্রামে। এসব গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের মেয়েরা একযোগে লড়েন। কিভাবে এত সাহস পেলেন মায়মুনা-ইরফাত-ফারজানাদের মতো একেবারে পাড়া-গাঁয়ে বেড়ে ওঠা এই মেয়েরা?

বিজ্ঞাপন

সাহসের যাত্রার শুরুটা মুকুনাইট উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই। বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) নামে একটি সংগঠন ‘প্রোমোটিং রাইটস থ্রু মোবিলাইজেশন অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্ট’ (প্রাইম) নামে একটি প্রকল্প শুরু করে পটিয়া উপজেলায়। ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন দু’টি এলাকায় গ্রুপ আড্ডা-কর্মশালা, মোটিভেশনের মধ্য দিয়ে ১০০ জনকে ‘চেঞ্জ মেকার’ হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে, যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী। তবে ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি।

মুকুটনাইট স্কুলে একটি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি করা হয়, সভাপতি করা হয় স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা সুবর্ণা দাশকে। এরপর এগিয়ে যাবার পালা শুরু। সামনে ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ‘সুবর্ণা ম্যাম’ আর পেছনে তার প্রিয় শিক্ষার্থীরা। সুবর্ণা ম্যাম একজন-দু’জন করে ছাত্রীকে নিয়ে বসেন, আদর-মমতা দিয়ে তাদের কানে দেন একটি মন্ত্র- ‘আমরা নারী, আমরা পারি।’ মুকুটনাইট স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই বললেন, শিক্ষিকা সুবর্ণা দাশকে অনুসরণ করে পথচলা শুরু হয় গৈড়লা কে পি উচ্চ বিদ্যালয়, হাইদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি স্কুলে। তিনবছর পর এসে মুকুটনাইটসহ আশপাশের গ্রামের এই মেয়েগুলো এখন একেকজন সাহস আর প্রতিবাদের প্রতীক, এলাকায় একেকজন ‘পরিবর্তনের হাতিয়ার।’

মুকুটনাইট উচ্চ বিদ্যালয়ের এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী পাপিয়া ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমদিকে যখন বিএনপিএস’র স্যারেরা এবং সুবর্ণা ম্যাম আমাদের বাল্যবিয়ে, যৌন সহিংসতা- এসব নিয়ে বলতেন আমরা অবাক হতাম। উনারা আমাদের বলেন যে, মেয়েদেরকেই প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। একজন এগিয়ে এলে অন্যরাও এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করবে। বিএনপিএস’র স্যারেরা বলেন যে, বাল্যবিবাহ-যৌন হয়রানি বা নারীর প্রতি সহিংসতা দেখলে যেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক অথবা যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতিকে জানাই। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশ এবং জাতীয় জরুরি পরিসেবা নম্বরে ফোন করে জানানোর বিষয়ও শিখিয়ে দেন।’

‘তবে আমাদের নিজেদের নিরাপত্তায় যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য আমাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখতে বলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে আমাদের ভয় কেটে যায়। আমরা কয়েকজন যুক্ত হওয়ার পর আস্তে আস্তে সহপাঠীরাও যুক্ত হন। এখন আমরা আর নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে কিছু করি না। প্রতিবাদ করি সামনাসামনিই’- বলেন পাপিয়া

ফারজানা আক্তার জিন্নাত জানালেন, চলতি বছরের শুরুতে মেয়েরা দু’জন করে ভাগ হয়ে মুকুটনাইট, করণখাইন, তেগোটা গ্রামে একাধিক রিকশা ও অটোরিকশায় ঘুরে ঘুরে মাইকিং করেছেন। রিকশা বা অটোরিকশায় শুধু দু’জন মেয়ে। তারা মাইকে করোনা নিয়ে সচেনতনতার কথা বলছে, সাথে বাল্যবিয়ে-ইভ টিজিং প্রতিরোধ বিষয়েও বলছে।

‘গ্রামের রাস্তায় প্রথম যখন শুরু করলাম, গ্রামের লোকজন ভাবতেই পারেনি, কোনো মেয়ে গ্রামে গ্রামে ‍ঘুরে মাইকিং করবে। বাজারে-দোকানপাট থেকে লোকজন বের হয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। মুরব্বিদের অনেকে আপত্তি করলেন। অনেকে নানা কথা বলতে থাকলেন। আমরা পাত্তাই দিইনি।’

বিএনপিএস জানিয়েছে, পটিয়া উপজেলার ধলঘাট, হাইদগাঁও, কেলিশহর ইউনিয়ন এবং পৌরসভায়ও কখনও দু’জন মেয়ে, আবারও কখনও একজন ছেলে আর একজন মেয়ে মিলে মাইকিং করেছে দিনের পর দিন। এই পরিবর্তনের যাত্রায় মেয়েদের সঙ্গী হয়েছেন তাদের অনেক সহপাঠী ছাত্রও, যাদের ‘চেঞ্জ মেকার’ হিসেবে গড়ে তুলেছে সংগঠনটি।

ধলঘাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গতবছর এসএসসি পাশ করা দৃশ্য বিশ্বাস জানালেন, স্কুলের পাশে বখাটেরা দাঁড়িয়ে থেকে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। একদিন দেখেন, এক ছাত্রী হেঁটে যাওয়ার সময় কয়েকজন বখাটে তার ওড়না কেড়ে নিয়েছে। আর দেরি করেননি দৃশ্য। ফোন করেন পটিয়া থানার ওসিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে পুলিশ এসে হাজির। বখাটেদের ধরে নিয়ে যান থানায়। আর কোনোদিন ইভটিজিং করবে না মর্মে মুচলেকা নিয়ে ছাড়েন। সেই স্কুলের আশপাশে এখন আর বখাটেদের উৎপাত নেই।

কিশোর দৃশ্যের অভিযোগ, পটিয়ায় বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির কার্যালয় থেকে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া কিশোরীদেরও ১৮ বছরের বেশি বয়স দেখিয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ দিচ্ছে। এ জন্য চেষ্টা করেও তিনি দু’টি বাল্যবিয়ে ঠেকাতে পারেননি।

হাইদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী অয়ন চৌধুরী বলেন, ‘হাইদগাঁও স্কুলে আমরা ছাত্রছাত্রীরা যৌথভাবে পড়ালেখা করি। একসময় আমরা একজন সহপাঠী ছাত্রীর সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেটা অনেকেই বুঝতাম না। কিন্তু এখন আমরা জানি যে, ছেলে আর মেয়ে ভিন্ন কিছু না। এখন আমার সামনে কেউ যদি একজন ছাত্রীকে টিটকারিমূলক কোনো কথা বলে, আমরা ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করি। যে কোনো সমস্যা আমরা ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করি।’

গৈড়লা কে পি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গতবছর এসএসসি পাশ করা ইসরাত সুলতানা ইশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে আমরা কোনো জায়গায় গেলে, এমনকি স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানেও ছাত্রছাত্রীরা পাশাপাশি বসার সাহস করতাম না। অথচ এখন ছেলেমেয়ে একসাথে গ্রামে গ্রামে অটোরিকশায় ঘুরে ঘুরে নানা বিষয়ে সচেতনতামূলক মাইকিং করি। একসাথে মিলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। আমরা চাই, এটা বাংলাদেশের সব গ্রামে, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হোক।’

পাড়া-গাঁয়ের স্কুলগুলোতে আরও একটি দৃশ্যমান পরিবর্তনের উদ্যোগ আসে ২০১৮ সালে। ছাত্রীদের ফুটবল খেলা। বিএনপিএস’র উদ্যোগে ২০১৯ সালে মুকুটনাইট স্কুলে প্রথম ছাত্রীদের ফুটবল খেলা হয়, পরের বছর হয়েছে মোট ১০টি স্কুলে। এবছর করোনার কারণে হয়নি। কিন্তু প্রত্যেক স্কুলে এখন ২৪ জন করে ছাত্রীদের একটি ফুটবল টিম আছে। ১০ স্কুল মিলিয়ে আছে ২৪০ জনের টিম, যার মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে উপজেলাভিত্তিক মহিলা ফুটবল টিমেও চান্স পেয়েছে।

মুকুটনাইট স্কুলের ছাত্রী ইরফাত জাহান পিউ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফুটবল খেলা যখন প্রথমদিকে শুরুর কথা বলা হল, আমাদের অনেকেই নাম দিতে সংকোচবোধ করল। অনেকে রাজি হওয়ার পর বলল, জার্সি পরে খেলবে না। হিজাব খোলা নিয়েও আপত্তি। তারা বলে, ফুটবল কি মেয়েদের খেলা, এটা তো ছেলেরা খেলে। তখন আমাদের সুবর্ণা ম্যাম বলেন যে, মেয়েরা কি শুধু ঘরে বসে লুডু খেলবে, তোমরা এই মনোভাব চেঞ্জ কর। প্রথমবার খেলার পর দ্বিতীয়বার এত মেয়ে আগ্রী হল যে, অনেককেই প্র্যাকটিসের পর ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও টিমে নেওয়া যায়নি। প্রথম বছর দর্শক ছিলেন শুধু স্কুলের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা। দ্বিতীয় বছর খেলা দেখতে গ্রামের লোকজন ভিড় করেন, খেলোয়াড়দের অভিভাবকরাও আসেন।’

কেলিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী আরিফা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই যে একটা পরিবর্তন, এটা এত সহজে হয়নি। প্রথমদিকে তো আমরা মা-বাবাকেই বলতাম না, আমরা এসব কাজ করছি। অনেক বাধা পেরিয়ে আমাদের এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। এখন তো বাল্যবিয়ে কিংবা ইভ টিজিংয়ের খবর পেলে আমরা একেবারে হুলস্থূল ফেলে দিই। ইউএনও-ওসি, চেয়ারম্যান-মেম্বার, স্কুলের টিচার, সবাইকে জানিয়ে দিই। অনেকসময় আমাদের উপজেলা সদরে যেতে হয়। তখন প্রতিবেশিরা মা-বাবাকে এসে বলে, মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, খেয়াল রেখ, বড় হয়েছে, বিয়ে দিয়ে দাও। শুনতে শুনতে এসব এখন সয়ে গেছি। আমাদের পাশে টিচাররা আছেন। ইউএনও-ওসি স্যারেরা আছেন।’

মুকুটনাইট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুবর্ণা দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গ্রামগঞ্জে যে সামাজিক প্রেক্ষাপট, একসময় তো মেয়েদের কথা বলারই সুযোগ ছিল না। ইভ টিজিংয়ের শিকার হলেও সাহস করে মেয়েরা প্রতিবাদ করতে পারত না। নীরবে বাল্যবিয়ে মেনে নিতে হতো। পরিবারের সিদ্ধান্তে অমত করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, তোমাদের কথা বলতে হবে। আমরা তাদের সাহস দিয়েছি, মানসিক সাপোর্ট দিয়েছি। এখন তারা কথা বলতে শিখেছে, প্রতিবাদ করতে শিখেছে। আমরা মনে করি, এভাবে প্রতিবাদের ভাষা স্কুল থেকে পরিবারে, পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে দেশে ছড়িয়ে যাবে।’

তবে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ চেঞ্জ মেকাররা সবাই একবাক্যে একজনের কথা বলেছেন, যিনি কখনও নীরবে, কখনও সরব হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। পটিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম শিরু। চেঞ্জ মেকাররা বলছেন, পাড়ায়-গ্রামে যেসব বাধার মুখে তাদের গত তিনবছরে পড়তে হয়েছে, তার অনেকগুলোরই সমাধান করে দিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধি।

মাজেদা বেগম শিরু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পটিয়া উপজেলার গ্রামগুলো যে শিক্ষাদীক্ষায় একেবারে পিছিয়ে তা কিন্তু নয়। অনেক বিপ্লবী, রাজনীতিক, খ্যাতিমান সাহিত্যিক-মনীষীর জন্ম কিন্তু এই পটিয়াতেই। এরপরও আজকের সমাজে যে অবক্ষয়, নৈতিক মূল্যবোধ আর পারিবারিক-সামাজিক সুশিক্ষার অভাব, সেগুলোর প্রভাব নিশ্চয় পটিয়ার গ্রামগঞ্জেও আছে। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক এবং নিপীড়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গী- এটা যে পটিয়ায় নেই সেটা বলব না। এই জায়গায় পটিয়ার বিভিন্ন গ্রামে বিএনপিএস কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং তাদের উদ্যোগে দৃশ্যমান কিছু সফলতাও এসেছে।’

বিএনপিএস, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক ফেরদৌস আহম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত তিন বছরে পটিয়ার বিভিন্ন স্কুল ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে কিছু পরিবর্তন আমরা আনতে পেরেছি বলে মনে করি। উচ্চ আদালত দেশের প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছিল। আমরা বিএনপিএস’র পক্ষ থেকে প্রথম নির্দিষ্ট কিছু স্কুলে এই কার্যক্রম শুরু করি। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি বলে আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। কিন্তু আমরা কিছু স্কুলে করতে পেরেছি, ভবিষ্যতে আরও করব। গত তিন বছরে আমাদের চেঞ্জ মেকাররা ১৮টি বাল্যবিয়ে ও ২১টি যৌন হয়রানির ঘটনা প্রতিরোধ করেছে। সংখ্যাটা বড় কথা নয়, একটা ম্যাসেজ কিন্তু তারা সমাজে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।’

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন