বিজ্ঞাপন

কবরস্থান নিয়ে সংঘাত: নেপথ্যে দাফনের টাকা আদায়

June 25, 2021 | 7:30 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়ায় কবরস্থানের দখল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় ‘আওয়ামী লীগ নেতা’ এয়াকুবসহ আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর পুলিশের ধরপাকড়ের মুখে মিরসরাইয়ে এক যুবলীগ নেতার বাসায় আত্মগোপন করেছিল এয়াকুব। সেখান থেকে তাকে এবং বাকি দু’জনকে ঢাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এয়াকুবের রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল রেখে তাকে ‘ভূমিদস্যু’ উল্লেখ করে পুলিশ আরও জানিয়েছে, কবরস্থানে লাশ দাফনের জন্যও টাকা আদায় করত এয়াকুব ও তার সহযোগীরা। এ নিয়ে বিরোধের জেরে কবরস্থানের জায়গার মূল মালিক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে এয়াকুব ও তার সহযোগীরা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল, যারা এলাকায় ‘এয়াকুব বাহিনী’ নামে পরিচিত।

বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) দিনভর নগরীর বাকলিয়া থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার বিজয় বসাক।

গ্রেফতার মো. এয়াকুব (৫০) নগরীর বাকলিয়া থানার আব্দুল লতিফের হাট এলাকার ইসলাম সওদাগরের ছেলে। গ্রেফতার বাকি দু’জন হলেন- ওসমান আলী (৩৫) ও মাসুদ আলম (৩৬)।

বিজ্ঞাপন

উপপুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক জানিয়েছেন, ঘটনার মূল হোতা এয়াকুবসহ এ নিয়ে ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার ভিডিও ফুটেজে চারজনকে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে ওসমান আলী ও জাহিদকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। মহিউদ্দিন ও ওয়াসিম নামে আরও দু’জন পলাতক আছে।

উল্লেখ্য, গত ১৫ জুন গভীর রাতে জাহিদ নামে একজনকে বাঁশখালীর প্রেমবাজার এলাকা থেকে পিস্তল ও গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ওই পিস্তল ঘটনার সময় ব্যবহার করা হয়েছিল।

গত ১১ জুন সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে নগরীর বাকলিয়া থানার পূর্ব বাকলিয়া আবদুল লতিফ হাটখোলা এলাকায় ‘বড় মৌলভী বাড়ি’ কবরস্থানের দখল নিয়ে স্থানীয়দের দুইগ্রুপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে চারজন গুলিবিদ্ধসহ ১৩ জন আহত হন। পুলিশ জানিয়েছিল, বড় মৌলভী বাড়ির লোকজন পুরনো সাইনবোর্ড ফেলে কবরস্থানের নতুন সাইনবোর্ড লাগাতে গেলে স্থানীয় একদল তাদের বাধা দেয়। এসময় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উভয়পক্ষ সংঘাতে জড়ায়। এ ঘটনায় বড় মৌলভী বাড়ির সাইফুল্লাহ মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি বাদি হয়ে বাকলিয়া থানায় মামলা করেন।

বিজ্ঞাপন

গত ২২ জুন এলাকার সাংসদ হিসেবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি এলাকায় অস্ত্র নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় না দেখে কঠোরভাবে দমনের নির্দেশনা দেন।

গ্রেফতার হওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংঘর্ষের কারণ সম্পর্কে বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রুহুল আমীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কবরস্থানটি মূলত বড় মৌলভী বাড়ির পারিবারিক জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পরে তারা সেটি সামাজিকভাবে মরদেহ দাফনের জন্য উন্মুক্ত করে। কবরস্থানটি পড়েছে বড় মৌলভী বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে এবং এয়াকুবের বাড়ির একেবারে পাশে। এয়াকুব গত কয়েক বছর ধরে সেই কবরস্থানে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে। বড় মৌলভীবাড়ির বাসিন্দা ও এলাকার লোকজনকে পাশ কাটিয়ে এয়াকুব সেখান থেকে মরদেহ দাফনের সময় টাকা নিতে শুরু করে।

‘ঘটনার দিন সকালে বড় মৌলভী বাড়ির সন্তান সাইফুল্লাহ মাহমুদ এলাকার লোকজনকে নিয়ে কবরস্থানে দাফন করতে টাকা না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে সাইনবোর্ড লাগাতে যান। এয়াকুব বাহিনীর লোকজন এতে বাধা দেয়। একপর্যায়ে এলাকার লোকজনের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করি। মামলায় এয়াকুবসহ ২১ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং আরও ৫০-৬০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়’, বলেন ওসি ‍রুহুল আমীন।

স্থানীয়রা জানান, পদ-পদবিতে না থাকলেও এয়াকুব নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। বছর তিনেক আগে যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়েই মূলত এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তবে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে ‘যুবলীগের কর্মী’ পরিচয়ে তিনি এলাকায় রাজনীতি করতেন। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় তাকে কয়েকবার জেলেও যেতে হয়।

বিজ্ঞাপন

এয়াকুবসহ তিনজনকে গ্রেফতারের বর্ণনা দিয়ে ওসি রুহুল আমীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনার পর পুলিশ যখন তৎপর হয়, তখন এয়াকুব এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জে একজনের আশ্রয়ে ছিল। আমরা সীতাকুণ্ড, বাঁশখালী, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দফা অভিযানের পর এয়াকুবের অবস্থান শনাক্ত করি। গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুরে আমরা যখন অভিযানে যাই, তখন সে পুকুরপাড়ে বসে তাস খেলছিল। পুলিশ দেখে ধানের জমি দিয়ে দৌড় দেয়। এলাকার লোকজন আমাদের সহযোগিতা করে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করি। এছাড়া ঢাকার পল্টনে একটি হোটেলে আত্মগোপনরত অবস্থা থেকে আরও দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়।’

পরে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়ে গভীর রাতে আব্দুল লতিফ হাটখোলা চাঁন্দগাজী সড়কের খাল পাড় থেকে দুই রাউন্ডগুলি ও ম্যাগজিনসহ একটি বিদেশি পিস্তল ও দু’টি কিরিচ উদ্ধার করা হয়। বিদেশি পিস্তলটিও ঘটনার সময় ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ওসি জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, মিরসরাইয়ে যার বাড়িতে এয়াকুব আত্মগোপন করেছিল, সেটি একজন যুবলীগ নেতার বাড়ি। সেখান থেকে ঢাকায় গিয়ে উচ্চ আদালতে আগাম জামিন আবেদনের পরিকল্পনা করেছিল এয়াকুব।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে এয়াকুব মূলত বাকলিয়াসহ আশপাশের এলাকায় ভূমি দখল, জায়গা কেনাবেচায় প্রভাব দেখানো, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করত।

এদিকে এয়াকুবকে গ্রেফতারের ঘটনা জানাতে শুক্রবার দুপুরে নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার বিজয় বসাক সংবাদ সম্মেলন করেন। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) শাহ মো. আব্দুর রউফ, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) আমিনুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (চকবাজার জোন) কামরুল ইসলাম।

সারাবাংলা/আরডি/এমও

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন