বিজ্ঞাপন

শিরোপা আসুক আর নাই আসুক, মারাকানার রাত মেসির হোক

July 10, 2021 | 10:11 pm

রফিকউল্লাহ রোমেল

হিসেবনিকেশ করে খেলা পাগল হয়েছে এরকম আসলে কেউ নেই। ফ্যানরা ফ্যান হয় কারণ তারা বুঝে না বুঝেই ফ্যান। এটাই ফ্যানধর্ম। কেন আপনি আপনার প্রিয় মানুষটিকে ভালবাসেন, তার জন্য তো যুক্তি দরকার নেই। কেন আপনি আপনার খোদার উপাসনা করেন সেটাও প্রতিদিন যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই।

বিজ্ঞাপন

এই পরিসংখ্যান, যুক্তি দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করতে গেলে গলফ বা দাবা খেলা পৃথিবীর সেরা খেলা হতো। অথবা ক্রিকেটের মতো দলীয় ক্যালকুলেটিভ খেলা দুনিয়ার গ্রেটেস্ট শো অব আর্থ হতো। কিন্তু হয়নি।

ফুটবল কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাই লার্জার দ্যান লাইফ! জীবনের চেয়েও অনেক বড়। একেকটা বড় ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে গেলে তাই মনে হয় কেমন যেন এতিম হয়ে গেছি।

ট্রলিং, পাল্টাপাল্টি বিতর্ক, যুক্তি বিরুদ্ধ যুক্তি, অপযুক্তি— সবই ফুটবল আর ফুটবলকে ঘিরে ফ্যানডোমের অংশ। তবে এসবের মধ্য দিয়েই ফুটবলের ভেতরের সৌন্দর্য ধরতে পারাটা বা তার লার্জার দ্যান লাইভ ফিলিংয়ে যেতে পারাটাই আসল কথা। এটার মানে একেবারেই কঠিন কিছু নয়, খুব সোজা। খেলার মাঠে যা কিছু সেরা তার সব কিছু আপনি সমর্থন নাও করতে পারেন, আপনার কাছে আপনার সমর্থনই সেরা। কিন্ত সেটা প্রমাণসাপেক্ষ বলেই প্রমাণের কোনো দরকার নেই।

বিজ্ঞাপন

ঠিক সেই কারণে অকথ্য গালাগালি, ফালতু জিনিস দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের পাশাপাশি এরিকসনের জন্য ভালবাসা, ডেনিশদের ফাইটিং স্পিরিটের প্রতি শ্রদ্ধা বা গত বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে দেখে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা— দুটোই সমান্তরালে চলবে।

কাল ফুটবল বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকার ফাইনালে মুখোমুখি। সারা বিশ্ব এই ম্যাচের দিকে তাকিয়ে থাকবে। উরুগুয়ের রেফারি এস্তেবান অস্টোয়িচ ফাইনালে গুরুদায়িত্ব সামলাবেন। তার বাঁশির ফুঁকের এদিক সেদিকে খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে। পেরুর রেফারি আন্দ্রেস চুনহা থাকবেন ভারের সামনে। অনেক নাটকের উৎস হতে পারে তার সিদ্ধান্তও। মারকানার ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে নতুন ইতিহাস রচিত হবে কাল। এত কম দর্শক নিয়ে মারাকানায় কোনো দিন ফাইনাল ম্যাচ হয়নি। কনমেবল দুই দেশ মিলিয়ে হাজার সাতেক দর্শককে মাঠে ঢুকতে দিচ্ছে।

এই ফাইনালটি মেসির ফাইনাল হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন অনেকে। ব্যক্তি মেসির নতুন করে নিজেকে প্রমাণের কিছু নেই। তার বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দল যেমনই করুক, তাদের গ্রেটনেসকে খাটো করার বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ নেই। কাপ না জেতা বড় সুপারস্টার প্লেয়ার অনেকেই আছেন। তুলনামূলকভাবে মেসির চেয়ে অনেক ভালো দল নিয়েও রোনালদো নিজে আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছেন একটি।

বিজ্ঞাপন

কিন্ত এখন যারা খেলছেন তাদের মধ্যে একটি জায়গায় মেসি সবার চেয়ে আলাদা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ফুটবল একটি এন্টারটেইনমেন্ট এলিমেন্ট ও বটে, অনেক বেশি গোল দেখা বা অসাধারণ দক্ষতায় গোল ঠেকানোর প্রয়াস দেখার মধ্যে অসাধারণ একটা আনন্দের উপকরণ আছে। রক্ষণাত্মক এন্টারটেইনমেন্টের ইতালি স্টাইল এখন আর নাই বললেই চলে। এ ধরণের ফুটবলের সমস্যা হলো, খেলায় জিততে না পারলে এদের কদর থাকে না। ঐতিহাসিকভাবে ইতালিই শুধু পেরেছে, অথবা ইউরোতে একবার করে গ্রিস বা ডেনমার্ক পেরেছে। এছাড়া বাকী পুরাটাই আক্রমণাত্মক ফুটবলের জয়জয়কার। জোগো বনিতো হোক, টোটাল ফুটবল বা তার ভ্যারিয়েন্ট টিকিটাকা হোক বা জার্মান রবোটিক ফুটবল হোক— এই যে কথিত শৈল্পিক ফুটবলের পুরোটাই আক্রমণাত্মক খেলার গল্প। ব্যক্তিগত পারফরমেন্স এই শতকে এসে গৌণ হয়ে পড়েছে। কিন্ত ব্যক্তিগত স্কিল, ড্রিবলিং যাদু, স্পিড আর ট্যাকটিকসের সমন্বয় আর গোল করার ঈশ্বরপ্রদত্ত দক্ষতা এ মুহূর্তে লিওনেল মেসির যেমন আছে তা কারো নেই। তাঁর ধারে কাছেও নেই কেউ।

জেনুইন স্ট্রাইকার বা নাম্বার নাইনে না খেলেও ক্লাব আর জাতীয় দলে যে পরিমাণ গোল তিনি করেছেন (পেনাল্টি বাদ দিয়েও) সেটার ধারে কাছে পরিসংখ্যানেও অন্য কেউ নেই। মেসিকে মাঝে মাঝে ফুটবলের ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট মার্কা চরিত্র মনে হয়। রবেনের স্পিড, রোনালদোর প্রিসিশান আর ইনসাইড কাটিং আর মদ্রিচ/ইনিয়েস্তার পাসিং/ডিস্ট্রিবিউশানের অপূর্ব সমন্বয় মেসি। খাটো হওয়ার কারণে বাতাসে সুবিধা এক ফোঁটাও পাননি। এই ফিজিক্যাল বা মাসল ফুটবলের যুগে লেওয়ান্ডস্কি বা রোনালদোর মতো হেডে গোল করার সুযোগ তার হয়নি। তারপরও তিনি যা করেছেন তার তুলনা নেই। তার মতো ড্রিবলিং করতে পারা ফুটবলার জন্মই নিয়েছেন খুব কম। দুনিয়ার অনেক নাম করা ফুটবলারকে একটু টোকা খেয়েই মাঠে কাতরাতে দেখেছি। চোখে মুখে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় নীল হয়ে যেতে দেখেছি। ক্লাবে দীর্ঘদিন একসঙ্গে খেলা সতীর্থের পায়ে বুট দিয়ে পাড়া দিতে দেখেছি। কিন্ত মেসি গত সতেরো বছর ধরে এগুলোর ঊর্ধ্বে। লাথি খেয়ে উঠে আবার দৌড়েছেন। শার্ট ধরে টানার চেষ্টা করছেন এমন খেলোয়াড়কে টানতে টানতে পিছে পিছে নিয়ে গেছেন ডিবক্স পর্যন্ত। হাত পায়ে মুখে নাকে রক্তারক্তি কাণ্ডের পরেও আবার উঠে বল নিয়ে যা করেছেন সেটার জন্যই মনে হয় ফুটবল অনেক সুন্দর এখনও।

বার্সেলোনা এবং আর্জেন্টিনা একেবারেই সমর্থন করেন না এমন লোক মেসির খেলা দেখে হা করে তাকিয়েছিলেন এই উদাহরণ বিশ্বব্যাপী। এখানে একটি ভিডিও যুক্ত করে দিলাম। যারা দেখেননি, তারা দেখতে পারেন। দেখতে পারেন না আসলে, অবশ্যই দেখেন। এই ভিডিওর মাঝামাঝি একটি জায়গায় আছে দেখবেন, রোনালদোকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, ‘তোমার কি মনে হয়, এই দুনিয়ার সেরা ফুটবলার কে?’ ‘আমার মনে হয় আমি ই…’ রোনালদোর জবাব। মেসিকে একই প্রশ্ন করা হলো। তিনি অ্যাঁ অ্যাঁ করতে বললেন, ‘খুব ভালো খেলতে পারিনি। জাতীয় দলটাও ভালো করেনি। রোনালদো অনেক ভালো। নেইমার সুয়ারেজ দারুণ। আমিও ভালো…(হাসি)…এটাই মেসি। বছরের পর বছর চোখে দেখার ফুটবলের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার মেসি।

বিজ্ঞাপন

ফ্যানদের কথা শুরুতে বলছিলাম। এখন খেলাধুলা, রাজনীতি সবখানে ফ্যানের চেয়ে এন্টিফ্যান বেশি। এন্টিফ্যানের বৈশিষ্ট্য হলো, আমি যাকে পছন্দ করি, তাদের চেয়ে প্রতিপক্ষকে ঘৃণা করি অনেক বেশি। যুক্তি হিসেবে দেখাই ‘অমুক দলের সাপোর্টারদের অত্যাচারে’ এটা করেছি। যেটা আসলে নিজেকেও অত্যাচারী সাপোর্টারেই পরিণত করে।

কাজেই মেসির অনেক হেটার আছে। এটা একটা ফিল্টার। মেসির যখন অনেক হেটার থাকে, জিদানের যখন হেটার থাকে, লুকা মদ্রিচের যখন অনেক হেটার থাকে, পেপ গার্দিওলার যখন হেটার থাকে তখন বুঝতে হয় যে এটা ফুটবলের রাইভালেরিতে আর সীমাবদ্ধ নেই। এটা প্রকট একটা অসুস্থতা। সহসাই সুস্থ হওয়া সম্ভাবনা এই অসুখে খুব একটা দেখি না। খেলার সৌন্দর্য বা জগো বনিতো বা ইত্যাদি ইত্যাদি বলে মুখে ফেনা তোলা লোকজন নিজের ইগোর কাছে কতটা অসহায়, ফুটবল সেটাও সামনে নিয়ে আসে কখনো কখনো— দুর্ভাগ্যবশত।

মেসি এগুলো ডিসার্ভ করেন না। হি উইল বি গ্রেটলি মিসড। কাল তিনি কাপ পেয়েছেন কি পাননি এই নিয়ে আমাদের মতো ডাচ ফুটবল সাপোর্টারদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্ত আমার ধারণা এটাই মেসির শেষ কোপা, এবং এই খেলাই তার শেষ কোপা ম্যাচ। নিজের খেলায় সন্তুষ্ট না হলে শুধু ফিটনেস ধরে রেখে (যেটা করা এই মেকানিকাল দুনিয়ায় খুবই সম্ভব) আর পেনাল্টি বক্সে দাঁড়িয়ে গোল করার জন্য মেসি খেলা চালিয়ে যাবেন বলে মনে হয় না।
আর্জেন্টিনা বোর্ড আর জনগণ যতই যন্ত্রণা করুক। আর্জেন্টিনা বোর্ডের জন্য লিওনেল মেসি ব্যবসার অপর নাম। ট্রফি আসুক বা না আসুক, তিনি খেললেই ব্যবসার চাকা ঘুরবে। এজন্য ইউরোপের অন্য একটি দলের মতোই নিজ দলের সমস্ত ফরমেশন উল্টাপাল্টা করে দিয়ে হলেও তারা মেসিকে খেলাতে চাইবেন। কিন্ত লাভ হবে বলে মনে হয় না।
তাই কথিত সুন্দর ফুটবল আর জোগো বনিতোর বেলাভূমি বা ল্যাটিন শৈল্পিক প্ল্যাটফর্মে লিওনেল আন্দ্রেয়াস মেসির এটাই শেষ আঁচড়…

রজার ফেদেরারকে আর কখনো দেখা যাবে না উইম্বেলডনের সেন্টার কোর্টে। আর মেসিকেও… জীবন স্তব্ধ হবার মতো আর তেমন কিছু দরকার নেই।

আমি জীবনে যতগুলো আর্জেন্টিনা ব্রাজিল খেলা দেখেছি তার একটাও জমেনি। একটাও না। ব্রাজিল প্রায় পুরা সময় একচেটিয়া খেলেছে। একচেটিয়া খেলেও হেরেছে এমন ঘটনা আছে। যেমন ৯০ এর বিশ্বকাপের রাউন্ড অফ সিক্সটিনে। সেই খেলায় ম্যারাডোনার অসাধারণ ডিফেন্স চেরা থ্রু পাসে গোল দিয়ে ক্যানিজিয়া আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যান ফাইনেলে। ব্রাজিলের পোস্টে বল লেগেছিল পাঁচবার। ক্যারেকা একাই তিনবার। কিন্ত কমবেশি সবই ওয়ানওয়ে জার্নি।

এই ফাইনেলেও ব্রাজিল ফেভারিট। টিম জোগো বনিতো টনিতো খেলছে না। কিন্ত এখনকার ফুটবলে যা দরকার, সেই ইফেক্টিভ ফুটবল খেলছে। সব পজিশনেই দারুণ খেলোয়াড় আছে। টাই ব্রেকারে ও গোলি এবং টেকার- দুই ক্ষেত্রেই তুলনামূলক ভালো প্লেয়ার আছে। তাদের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। ট্যাগলিয়ফিকো আর ওটামান্ডিকে খেলানোর ডিসিশনটা স্কেলোনি কেন নিলেন তিনিই ভালো জানেন। ট্যাক্টিকাল মুভে তিতে তার চেয়ে ভালো ম্যানেজার। ব্রাজিলকে ঠেকাতে হলে তাই আজকে আর্জেন্টিনাকে ‘মেসি একা কি করবে?’ থেকে বের হতেই হবে…কিংবা মেসি একাই হয়ত সব করতে হবে।

খেলা আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল। এই খেলার কেন্দ্রীয় চরিত্র নিশ্চিতভাবে মেসি। এবং এটাও ১০০% নিশ্চিত গত ত্রিশ বছরে যে ৯-১০ টা খেলা এই দুই দলের হয়েছে, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ক্লোজ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। মারকানার রাত মেসির হোক, উইথ অর উইদাউট ট্রফি।

মে দ্য ফোর্স বি উইথ ইউ লিওনেল আন্দ্রেয়াস মেসি।

লেখক: ম্যানেজিং এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট

সারাবাংলা/আইই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন