বিজ্ঞাপন

মেয়েটাকে নিয়ে লিফট উঠে গেল, এ দৃশ্যটা ভুলতে চাই

March 31, 2018 | 6:55 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ১৫ তলার বাসায় একের পর এক মানুষ আসছেন, ভেজা চোখে বাসায় ঢুকে তারা উম্মে সালমাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসেন, জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারেন না, সবাই মিলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন।

উম্মে সালমা বলতে থাকেন, আমার চোখের সামনে মেয়েটাকে লিফট টেনে নিয়ে গেল, আমি হাত দিয়েও সেন্সর করতে পারলাম না। মাত্র এক সেকেন্ডের ভেতরে মেয়েটাকে ওপরে নিয়ে গেল-আমি এই দৃশ্যটা ভুলতে চাই, কিন্তু পারছি না। আমার চোখের সামনে মেয়েটার এ অবস্থা হলো আমরা কিছুই করতে পারলাম না, আমি কী করে এ দৃশ্য ভুলব।

বিজ্ঞাপন

মেয়েটাকে নিয়ে লিফট উঠে গেল, এ দৃশ্যটা ভুলতে চাই

মেয়ের স্মৃতিচারণায় শোকসন্তপ্ত মা

বিজ্ঞাপন

তিনি কাঁদেন আর বলেন, আজ এ বাসায় কত মানুষ এসেছে, কিন্তু তারপরও বাসায় কোনো চিৎকার নেই, বাসায় কেউ জোরে কথা বলছে না। অথচ এ বাসাতেই কেবল আমি, আলভিরা আর আমাদের গৃহকর্মী থাকতাম। তাতেই বাসা সরগরম হয়ে যেত, আলভিরার মা মা চিৎকারে এই বাসা গমগম করত।

গত বৃহস্পতিবার রাতে শান্তিনগরের চামেলিবাগের এ বহুতল ভবনে লিফটে আটকে মারা যায় ১০ বছরের আলভিরা রহমান। আলভিরা আর দুই মাসের আরেক কন্যাকে নিয়ে বাবা শিপলু রহমান খান ও মা উম্মে সালমা থাকেন ১৮ তলা ভবনটির ১৫ তলার একটি ফ্ল্যাটে। আলভিরা লিফটে ওঠার পর দরজা সজোরে আটকে যায়, তাতে শিশুটির মাথায় আঘাত লাগে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা আলভিরাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিজ্ঞাপন

মেয়েটাকে নিয়ে লিফট উঠে গেল, এ দৃশ্যটা ভুলতে চাই

মায়ের সঙ্গে ফ্রেমবন্দি আলভিরা

বিজ্ঞাপন

শনিবার চামেলিবাগের এ ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, বাসা ভর্তি মানুষ। তারা আলভিরার মৃত্যু সংবাদ শুনে এসেছেন। আলভিরার মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কিন্তু কোনোভাবেই বাঁধ মানছে না মায়ের শোকার্ত মন। মা উম্মে সালমা সবাইকে মোবাইলে মেয়ের ছবি দেখাচ্ছেন আর কাঁদছেন।

জানা গেল, বাবা শিপলু রহমান মেয়ের কবরের পাশেই রয়েছেন। গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা উত্তরা কবরস্থানে আলভিরাকে কবর দেওয়ার পর থেকেই শিপুল ‍রহমান মেয়ের কবরের পাশ থেকে নড়ছেন না। আজ ফযরের নামাজের আগে সেখানে গিয়ে শিপলুকে স্বজনরা গিয়ে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। কিন্তু ভোর না হতেই আবার চলে গেছেন মেয়ের কবরের পাশে।

সেদিনের ঘটনা সর্ম্পকে জানতে চাইলে এ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সুমনা ইসলাম বলেন, ‘সেদিন ছিল আলভিরার মা উম্মে সালমা রুনির জন্মদিন। বাইরে খেতে যাওয়ার জন্য তারা ১৫ তলাতেই লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিল। লিফট সামনে এলে আলভিরা হঠাৎ এক পা দিয়ে দেয় লিফটের ভেতরে। পাশ থেকে এসময় উম্মে সালমা বলেন, ঘটনাটা এক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল আলভিরা, আমার কোলে ছোট মেয়ে। লিফট আসা মাত্র আলভিরা তাতে পা দিল, আমি লিফটের ভেতরে হাত দিলাম। কিন্তু মুহূর্তের ভেতরে লিফটটা আমার মেয়েকে নিয়ে ওপরে উঠতে লাগল-লিফটের দরজা আটকে যেতে থাকল। বাবার হাত থেকে ছুটে গেল মেয়েটার হাত। মেয়েটা লিফটের ভেতরে বাবা বাবা করে চিৎকার করছে আর এদিকে আমরা।

আমি হাত দেওয়ার পরও লিফটের সেন্সর কাজ করেনি, আমার মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল, মেয়েটা আর ফিরল না।

এ সময় বন্ধু সুমনাকে জড়িয়ে ধরে তিনি জানতে চান, আমার মেয়েটা নিশ্চয় খুব ব্যথা পেয়েছিল আটকা পড়ে। কী করে মেয়েটা এই ব্যথা সহ্য করেছিল এ বলে তিনি আবার কাঁদতে থাকেন।

মেয়েটাকে নিয়ে লিফট উঠে গেল, এ দৃশ্যটা ভুলতে চাই

আলভিরার ছবিটি কেবল স্মৃতি

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু কিছু গণমাধ্যমে আলভিরার মৃত্যু সংবাদকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আলভিরাকে লিফটে একা ছেড়ে দিয়েছেন বাবা-মা এটা ঠিক নয়। আলভিরা প্রি মেচিউর বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করে, তার বা-পায়ে একটু উইকনেস ছিল। কেবল বাসা ছাড়া বাবা-মায়ের হাত ধরেই থাকত সে।

এ সময় উম্মে সালমা বলেন, ‘বাইরে কোথাও গেলে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখত, আমিও ওকে কারও কাছে দিয়ে শান্তি পেতাম না। সেদিনও ওর বাবার হাত ধরা ছিল। কিন্তু কাউকে কিছু বলার নেই, আমাদের মেয়ে গেছে-নিউজ করে কী হবে?’

তিনি বলেন, ‘আমি যদি জানতাম সৃষ্টিকর্তা কেবল দশটা বছরের জন্য আমাকে ওকে দিয়েছেন তাহলে স্কুলে দিতাম না, পড়তে বলতাম না-মেয়েটা আমার যা করতে চাইত তাই করতো। ওকে যদি একটিবার কাছে পেতাম তাহলে ওর হাত ধরে ক্ষমা চাইতাম।’

১৫ তলায় অবস্থিত ফ্ল্যাটে উঠার সময় কথা হয় এই তলারই আরেক ফ্ল্যাটের বাসিন্দার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বিশাল এ ১৮ তলা কমপ্লেক্সে মোট তিনটি ভবন। সেখানে ১৫টি ফ্লোরের প্রতি ফ্লোরে চারটি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতিমাসে সার্ভিস চার্জ দিতে হয় চার হাজার টাকা। এতগুলো পরিবারের দেওয়া সার্ভিস চার্জ নিয়ে কী করা হয় তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

মালিকপক্ষের এত অব্যবস্থাপনা রয়েছে এই ভবন নিয়ে- ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মালিকপক্ষকে লিফটের এ সমস্যার কথা অনেকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখন কাজ হচ্ছে, একটা জীবন চলে যাওয়ার বিনিময়ে তারা লিফট সমস্যার সমাধান করছেন। এই কাজটা যদি আগে করা হতো তাহলে ফুটফুটে এই মেয়েটা চলে যেত না।

সে দিন তো উম্মে সালমার জন্মদিন ছিল জানতে চাইলে সুমনা ইসলাম বলেন, ‘কত মর্মান্তিক ঘটনা-মায়ের প্রতিটি জন্মদিন মেয়ের মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেবে।’

কথা বলে বের হবার সময় উম্মে সালমা মেয়ের ছবি ভর্তি অ্যালবাম হাতে এগিয়ে আসেন। ছবি দেখান, পাশে থাকা সাইকেল দেখিয়ে বলেন, এটা এখন একটু ছোট হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তারপরও চোখের সামনে রাখতে হত-ড্রয়িংরুম থেকে সরাতেই দেয়নি। পাশেই রাখা মেয়ের বই-খাতা দেখান, খাতার পাতায় থাকা লেখায় হাত বোলান, যেন তাতে মেয়েকে ছুয়ে দেখছেন তিনি। পাচ্ছেন চলে যাওয়া মেয়ের স্পর্শ।

সারাবাংলা/জেএ/এমএস/একে

আরও পড়ুন

মায়ের জন্মদিনে লিফট চাপায় মেয়ের মৃত্যু

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন