বিজ্ঞাপন

দ্রোহে ও প্রেমে ফকির আলমগীর

July 25, 2021 | 12:51 am

ফারহানা হোসেন শাম্মু

ও সখিনা গেছোস কি না ভুইলা আমারে—ফকির আলমগীর এই গানটা এমন দরদ দিয়ে গাইতেন যে তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সখিনা নামে সত্যিই কি তার জীবনে কেউ ছিল?

বিজ্ঞাপন

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সখিনা নামে কেউ ছিল না, কিন্তু তার প্রথম প্রেমের নায়িকার নামের আদ্যক্ষর ‘স’ দিয়ে ছিল। সে কি সুচিত্রা সেন? নাকি জন্মস্থল ফরিদপুরের কালামৃধা গাঁয়ের প্রিয় কোনো মুখ— সে কথা আর বলেননি।

‘ও সখিনা’ গানটা শুনে ছোটবেলা আমরা অনেক হাসাহাসি করতাম। বিদ্যাবুদ্ধি হওয়ার পর সেই হাহা রিয়েক্টের মূর্খতার কথা মনে করে ফেসবুকে প্রোফাইল লক করে মুখ লুকানোর মতো অবস্থা হয়েছে।

সেবার বানে সোনাফলা মাঠ হইলো ছারখার
দেশ-গেরামে শেষে নামে আকাল, হাহাকার
আমরা মরি কী আসে যায় মহাজনের পাওনা টাকায়
বেবাক ফসল তুইলা দিলাম আমরা তাগোর খামারে

বিজ্ঞাপন

‘ও সখিনা’ গানের নায়ক পেটের দায়ে কখনও রিকশা চালায়, কখনও মেশিন চালায়। আকালের এককালে মহাজনের সুদের টাকা শোধ দিতে নাকাল তরুণ একদিন শহরে চলে আসে। ফুটপাতে মশার কামড়ে রাত কাটে তার ভালোবাসাহীন। এত অভাবেও শহরের রোদে তাপে পুড়তে পুড়তে তার পোড়ামনের জানতে ইচ্ছে করে, ‘ও সখিনা গেছোস কি না ভুইলা আমারে?’ সবকিছু ছেড়ে তার সখিনার কাছে ছুটে যেতে মন চায়।

লক্ষ মশার উৎপাতে রাত কাটে না ফুটপাতে
লয় মনে আজ বদলা লমু
উইড়া যামু তোর ধারে
ও সখিনা

সেই প্রেমিক পুরুষটি চলে গেলেন ২৩ জুলাই রাত ১০ টা ৫৬ মিনিটে। যার আজন্ম প্রেম ছিল সখিনাদের জন্য, আর তিনি ছিলেন এক ব্যর্থ প্রেমিক সত্ত্বা। ক্ষুধা পেটে যার প্রেম জাগে, প্রেমের গভীরে যার ক্ষুধা লাগে। প্রতি বছর মে দিবসে তিনি তার গণসংগীত দিয়ে মুছে দিয়েছেন শ্রমিকের চোখের জল, আর গায়ের ঘাম। তার ভাষায়, গণসংগীত বিভাজনের বিরুদ্ধে একটি আর্তনাদ। রানা প্লাজা, শবমেহের, উড়িরচর, জগন্নাথ ট্রাজেডি— বাংলাদেশের সকল দুর্দশায় তিনি সুরশক্তি নিয়ে হাজির থেকেছেন আজীবন।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে.. কিন্তু সেই বৃষ্টিতে যদি শত শত সখিনার ঘর ডুবে যায়। সেই বৃষ্টি আমরা চাই না।

পঞ্চাশ দশকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে আঁড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে জন্ম নেন ফকির আলমগীর। যে কুমার নদী কেটে কেটে নৌকা বেয়ে স্কুলে যেতেন তিনি, সেই নদী আজ মৃত। তবু তিনি চিরকাল বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন সেই নদী। বড় খাল থেকে ধরা মাছ, আম কাটার চাকু, মেলা থেকে কেনা রাবারের বল, ফসলের ক্ষেতে বসে বাজানো বাঁশির সুর আর ফসলের ঘ্রাণে ভরা ছিল তার জীবন। হাতটা এগিয়ে হঠাৎ বলে বসতেন, ‘কই মাছের কাটায় কি যে ব্যথা’—যেন মাছ ধরতে গিয়ে মাত্র ফুটল কইয়ের কাটা।

ছোট ছোট অনেক গভীর প্রেমের গল্প তার ঝুলিতে। পূজা পার্বণে একবার দেখা হয়েছিল গীতা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে। গন্ধরাজ বা বেলি ফুলের মালা নিয়ে তার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো গীতা। তাদের প্রেমে রুমালে ফুল উঠত। সেই মধুর স্মৃতি ধূসর হলেও তা গায়কের চোখে স্পষ্ট। এভাবে তিনি চিরকাল প্রেমে ছিলেন, বিদ্রোহে ছিলেন। একদিকে তিনি গেয়েছেন, কালো কালো মানুষের দেশে, ঐ কালো মাটিতে/রক্তের স্রোতের শামিল/নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্ত্যমিল।

অন্যদিকে কাজের টানে শহরে ছুটে আসা এক ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে তিনি গেয়েছেন,

বিজ্ঞাপন

পার্বতীপুর ইস্টিশনে
দেখা হলো তোমার সনে
১২ বছর পর,
মনে হলো করছ তুমি
ভুল মানুষের ঘর

গণসংযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর শেষে তিনি গণসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বিসিআইসিতে। পাশাপাশি গণসংগীত ছিল তার ভাষা।
আশির দশকে ‘আউল বাউল ফকির’ অ্যালবাম দিয়ে ফকির আলমগীরের যাত্রা শুরু। পপ সংগীতের অগ্রজ পথিক আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ, জানে আলম আর ফকির আলমগীর— ছয়জন মিলে গড়েছিলের সুরের ষড়ভুজ।

ফকির আলমগীর এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, সতীর্থ পিলু মমতাজের সঙ্গে চমৎকার রসায়ন ছিল তার। দুজনেই নেচে নেচে গান করতেন। দুজনেই স্টেজ মাতিয়ে কনসার্ট করতেন। একটা প্রেমের সম্পর্কের দিকে যাচ্ছিলেন তারা। কক্সবাজার থেকে শামুকের মালা এনে উপহার দিয়েছিলেন তিনি পিলু মমতাজকে। কিন্তু প্রেম যেন চিরকাল দূরে দূরে থাকে, তাই তাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে বিরহে-বিচ্ছেদে।

প্রেমে প্রেমেই জীবনমিতা পেয়েছিলেন তিনি। ভক্ত সুরাইয়ার সঙ্গে চিঠি বিনিময় করতে করতে একসময় তাদের প্রণয় পরিণতিতে গড়ায়। ফকির আলমগীর তার নাম দেন বনলক্ষী। ফিরোজ সাঁইসহ আরও দুজন বন্ধু মিলে গভীর রাত পর্যন্ত সেই বনলক্ষীর পত্রের উত্তর লেখতেন। ভালোবাসা দমে দমে চলা ৪৪ বছরের সেই দাম্পত্য জীবনে, মিনিট আর সেকেন্ডের কাটা হয়ে পার করেছেন জীবনঘড়ি।

তার অফুরান তারুণ্য দেখে সবসময় মনে হতো জুয়েল বসানো এই ঘড়িটা চলবে আরও বহুদিন। যেমনটি তিনি গেয়েছিলেন,

মাটির একখান কেস বানাইয়া
মেশিন দিছে তার ভিতর
রঙ বেরঙয়ের বার্নিশ করা
দেখতে ঘড়ি কী সুন্দর

মাত্র দেড় মাস আগে ১২ জুন আমার বাবার স্মরণসভায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পল্লীমা স্কুল আয়োজিত সেই জুম মিটিংয়ে সরব ছিল তার উপস্থিতি। আমার বাবার মতোই তার করোনা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে তার কৃত্রিম অক্সিজেনের উপর নির্ভরতা বাড়তে লাগল। তিনি নিবিড় পরিচর্যায় গেলেন। মৃত্যুর গুজব রটল। একই গল্প।

শুধু পার্থক্য আমার বাবার হাসপাতাল থেকে ডাক্তার আমাদের বলেছিলেন, ষাটের পর এই অবস্থায় লাইফ সাপোর্ট দিলে ফিরে আসে এমন কোনো নজির নাই। আমার বাবাকে আমরা লাইফ সাপোর্টে দেইনি। আড়াই দিন পর বাবা চলে গিয়েছিলেন। ফকির আলমগীরকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের মধ্যে কু-ডাকটা বেজে উঠেছিল। বুঝলাম দেহ-ঘড়িটা থেমে যাচ্ছে।

মন আমার দেহ-ঘড়ি
সন্ধান করি, কোন মিস্ত্রী বানাইছে
মন আমার দেহ-ঘড়ি

লেখক: গ্রামীণফোন কর্মকর্তা

সারাবাংলা/আইই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন