বিজ্ঞাপন

‘ঘুষ ছাড়াই’ পুলিশে চাকরি, বিস্মিত ৪৪২ বেকার

April 1, 2018 | 8:10 am

।।স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।। 

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার জাহেদা আক্তার। অটো রিকশা চালক বাবা কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। সংসারে তাই নিদারুণ অভাব। আর্থিক দুরবস্থার কারণে জাহেদার পড়ালেখা এসএসসির বেশি এগোয়নি। সেই জাহেদা এবার চাকরি পেয়েছেন পুলিশ কনস্টেবল পদে। টাকা-পয়সা ছাড়া পুলিশে চাকরি পেয়ে বিস্ময় আর আনন্দে আত্মহারা তিনি।

জাহেদা সারাবাংলাকে বলেন, আমি যখন কনস্টেবলের চাকরির জন্য যাচ্ছিলাম, অনেকে বলেছিল ৫ লাখ টাকা ঘুষ লাগবে। না হলে পুলিশের চাকরি হবে না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমাকে এক টাকাও দিতে হয়নি।

চন্দনাইশ উপজেলার শারমিন সুলতানা মুক্তা। বাবা রাজমিস্ত্রি। অভাবের সংসারে এসএসসি পাশের পর মা সুফিয়া বেগম ভেবেছিলেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু মুক্তা অনড়। তিনি চাকরি করবেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ কনস্টেবল পদে মুক্তার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সুফিয়া বেগম সারাবাংলাকে বলেন, টাকাপয়সা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। ভাত জোটাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম বাপের শরীরে বল থাকতে ধারকর্জ করে বিয়ে দেব। পরে তো ধারকর্জও পাব না। মেয়ে বলছে চাকরি করবে। টাকা ছাড়া মেয়েটা পুলিশের চাকরি পাবে, ভাবিনি।

চন্দনাইশের মিঠুন তালুকদারের বাবা চকরিয়ায় একটি বাণিজ্যিক মার্কেটের ক্যাশিয়ার। কনস্টেবল পদে নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়া মিঠুন সারাবাংলাকে বলেন, বাবা বলেছিল, যদি টাকা দিতে হয় তাহলে কনস্টেবলের চাকরি লাগবে না। কিন্তু টাকা ছাড়াই চাকরিটা হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

সাতকানিয়া উপজেলার সাজ্জাদ হোসেনের বাবা কৃষক। পাঁচ বোন, দুই ভাইয়ের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এবার এইসএসসি পরীক্ষার্থী সাজ্জাদও কনস্টেবল পদে যোগ দিচ্ছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, শহরে গিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা দিতেও কষ্ট হয়েছে। ঘুষ কোত্থেকে দেব ? ভাল লাগছে চাকরিটা পেয়েছি। এবার আব্বাকে একটু সাহায্য করতে পারব।

জাহেদা-মুক্তা, মিঠুন-সাজ্জাদের মতো ৪৪২ জন আছে যারা এবার কোন ঘুষ-বখশিস ছাড়াই চট্টগ্রাম থেকে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন। এসব পরিবারে এখন রাজ্যের সুখ, অফুরন্ত আনন্দ।

ঘুষ ছাড়া পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পাওয়া-বাংলাদেশের বাস্তবতায় মোটামুটি অবিশ্বাস্য একটি বিষয়। অতীতে চট্টগ্রামে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের সময় টাকা আদায় মুখরোচক বিষয়ে পরিণত হত। তবে এবার চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ব্যতিক্রমী একটি নজির স্থাপন করতে পেরেছে। যা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। ঘুষ লেনদেনের তেমন কোন অভিযোগ ছাড়াই জেলা পুলিশ ৪৪২ জনকে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ চূড়ান্ত করেছে।

বিজ্ঞাপন

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াই চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের কনস্টেবল পদে ৪৪২ জনকে নিয়োগ প্রশংসিত হয়েছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলেও।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এস-এম মনিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, হাজার হাজার প্রার্থীর মধ্যে ৪০০ জনকে বাছাই করা খুব সহজ বিষয় নয়। এরপরও মোটামুটিভাবে কোন অভিযোগ ছাড়াই যে নিয়োগটা চূড়ান্ত করা গেছে সেটা অবশ্যই ভালো হয়েছে। এতে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি বেড়েছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) নূরে আলম মিনা সারাবাংলাকে বলেন, কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ নিয়োগই আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে করেছি। এখানে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। ১-২ শতাংশ অনিয়ম হতে পারে আমাদের অজ্ঞাতে। তবে আমরা কোন অভিযোগ পাইনি। যদি অভিযোগ পেতাম সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিতাম। মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশও আমরা সেভাবে বিবেচনায় নিতে পারিনি।

এসপি বলেন, নিয়োগ পরীক্ষার আগে আইজিপি স্যার গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাকে ডেকে বলেছিলেন শতভাগ স্বচ্ছতার মাধ্যমে এবং ঘুষ ছাড়া কনস্টেবল নিয়োগ দিয়ে তিনি সারাদেশে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান। স্যার নিজেই একজন এআইজি ও একজন অ্যাডিশনাল এসপিকে নিয়োগ কার্যক্রম দেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন। স্যারের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করেছে। উনারা নিজেরাই বলে গেছেন যে, এবার নিয়োগে কোনো বাণিজ্য হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ৫০ হাজার জনবল বাড়ানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এবারের নিয়োগ হয়েছে। প্রতিবছর অবসরজনিত শূন্যপদে নিয়োগ হলেও এবার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত নিয়োগ হওয়ায় দুর্নীতিমুক্ত থাকার বিষয়ে পুলিশের বিশেষ নজর ছিল বলে এসপি জানিয়েছেন।

সূত্রমতে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক গত ৪ মার্চ নগরীর হালিশহরে জেলা পুলিশ লাইনস মাঠে কনস্টেবল পদে নিয়োগ প্রত্যাশীদের প্রাথমিক বাছাই সম্পন্ন হয়। এতে ৪ হাজার ১৪১ জন অংশ নেন। বাছাইয়ে যোগ্য ২ হাজার ৭৯ জন লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন।

৬ মার্চ লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ১ হাজার ৯২০ জন। এতে উত্তীর্ণ হয় ৭৭২ জন। ১১ মার্চ মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য মনোনীত হন ৪৪২ জন।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, প্রত্যেক থানার ওসিকে বলা হয়েছিল নিজ নিজ এলাকায় পুলিশের চাকরি দেওয়ার নামে দালালচক্রের বিষয়ে খোঁজ রাখতে। ফেসবুক এবং পত্রিকার মাধ্যমে আমরা ব্যাপকভাবে বিষয়টি প্রচার করি। প্রাথমিক বাছাইয়ের দিন আমাদের মধ্যে কেউ যাতে তাদের কাছ থেকে কোন টাকাপয়সা দাবি করতে না পারে, সেটা নজরে রাখার জন্য সিসিটিভি বসানো হয়েছিল। এখন পর্যন্ত আমরা কারও কাছ থেকে টাকা লেনদেনের কোন অভিযোগ পাইনি।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জাতীয় পরিষদ সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি কলঙ্কমুক্ত একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য পুলিশের উপরমহল আন্তরিক ছিল। স্থানীয় প্রশাসনেরও এতে সায় ছিল। এর ফলেই মূলত বড় ধরনের কোন অভিযোগ ছাড়াই নিয়োগটা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, আন্তরিকতা থাকলে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা সম্ভব। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিপরীতে এই ধরনের একটি ভালো উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত সকলকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে ঘুষবিহীন চাকরি পাবার অধিকার সর্বস্তরে নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

সারাবাংলা/আরডি/এমএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন