বিজ্ঞাপন

যে যার যাপনে

August 21, 2021 | 2:35 pm

সাহিত্য ডেস্ক

অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখাবে। শাহাদাৎ স্যার বাংলা দ্বিতীয়পত্র খাতা নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। পুরো ক্লাস উঠে দাঁড়ালো। স্যার সবার মুখের দিকে তাকালেন। কাকে যেন খুঁজছেন। তারপর আঙুল তুলে দেখালেন।
বিপ্লব, বেঞ্চের উপর দাঁড়া।
সবাই বিপ্লবের দিকে তাকায়। বিপ্লব দাঁড়াবে কি দাঁড়াবে না বুঝতে পারছে না। শাহাদাৎ স্যার ধমকে উঠলেন। বিপ্লব লাফ দিয়ে বেঞ্চের উপর দাাঁড়ায়। এক এক বেঞ্চে চার পাঁচজন গাদাগাদি করে বসতে হয়। পুরো ক্লাসে তিপ্পান্ন জন ছাত্র। গড়ে প্রায় সাতচল্লিশ আটচল্লিশ উপস্থিত থাকে। বিপ্লব দাঁড়িয়ে কান ধরতে যাচ্ছিল। স্যার চোখ গোল গোল করে তাকালেন।

বিজ্ঞাপন

এই তোকে কান ধরতে বলিনি। হাত নামা। চোরের মন পুলিশ পুলিশ।

বিপ্লব হাত নামিয়ে দুই পকেটে দুই হাত রাখল। স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন।

জনাব, আপনাকে তো লাটসাহেব হতে বলিনি। দাঁড়াতে বলেছি। দাঁড়াতে। শুধু দাঁড়াতে।

সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। এরা বুঝতে পারছে না বিপ্লব কী করেছে। পরীক্ষার খাতা দেখাবে। পরীক্ষায় অনেকেই টোকাটুকি করে। কিন্তু সে তো ইংরেজি আর আরবিতে। বাংলা দ্বিতীয়পত্রে নকল করার দরকার পড়ে না। কেউ কেউ নকলের ওস্তাদ মামুনের দিকে তাকায়। মামুন জুতার ভিতর নকল রাখে। চুলের ভিতর নকল রাখে। তোহা স্যার আর মণিলাল স্যার ছাড়া কেউ মামুনকে ধরতে পারে না। নকল পেলে মামুনের খাতায় পাবে। বিপ্লব কী দোষ করেছে কেউ বুঝতে পারছে না। ক্লাসে হৈ চৈ বেড়ে গেল। স্যার বেত দিয়ে টেবিলে ঠাসঠাস দু’ঘা বাড়ি মারলেন। পুরো ক্লাস চুপ হয়ে গেল।

বিজ্ঞাপন

দেখ, সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখ। চোর-বদমাইশ-গুন্ডা-ডাকাত-দস্যু।

স্যার আর কিছু বললেন না। খাতা দিতে শুরু করলেন।

রোল এক- আটাত্তর।

বিজ্ঞাপন

রাশিদুল এসে মাথা নিচু করে খাতা নিয়ে গেল।

রোল চার। নুরুল ফজল মুকুল। সাতষট্টি।
রোল সাত। মহিউদ্দিন আহমেদ।
-রোল সতেরো। সত্যজিৎ সাহা।

নিতাই জানালো সত্যজিৎ অনেক দিন আসবে না। ওর বাবা মারা গেছে। ওর এখন ন্যাড়া মুণ্ডু। স্যার একে একে সবার খাতা দিয়ে দিলেন। একটি খাতা আলাদা করে রাখলেন।

বিপ্লব শঙ্কিত। বুঝতে পারছে না কী করেছে। স্যার একটা খাতা আলাদা করে রাখল। তবে কি খাতার মধ্যে ঝামেলা। কিন্তু সে তো জেনেশুনে কিছু করেনি। স্যার কেন রাগ হয়েছে বুঝতে পারছে না। তবে কী হুজুর স্যার বিচার দিয়েছে। গতকাল ছুটির পরের ঘটনা। কিন্তু সেটাতো পুরোটাই হাসান করেছে। বিপ্লব শুধু সাথে ছিল। আর হুজুর স্যার তো কাউকে দেখতেই পায়নি। দেখতে পাবার কথাই না। গতকাল হুজুর স্যার টুপির জন্য মাথায় অনেক মেরেছিল। বেশি মার খেয়েছিল হাসান। হাফ প্যান্টের সাথে টুপি পরায় স্যার ওকে হাঁটুতে অনেক মেরেছিল।

বিজ্ঞাপন

স্কুল থেকে একটু এগিয়ে বায়ে গলি। চিনের প্রাচীরের চেয়েও লম্বা সরু গলি। এই গলির ভেতর দিয়েই নারাণদিয়া স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষকবৃন্দ চলাচল করেন। গলির শুরুর বাড়ি নূর মোহাম্মদদের। আর শেষ বাড়িটায় থাকে রেজারা। এই গলির ভেতর মাঝামাঝি গেলে কামরাঙা গাছ আছে। সেটাই হাসানদের বাড়ি। এখানে সবগুলো বাড়ি একতলা। খুব সহজেই এক ছাদ থেকে এলাকার সব ছাদে যাওয়া যায়।

হাসানের সঙ্গে বিপ্লব এই ছাদে বেশ কয়েকবার এসেছে। গতকাল গিয়েছিল স্কুল ছুটির পর। হাসান কোত্থেকে যেন মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ি-পাখ-পাখালি জোগাড় করে এনেছে। একটা সুতা দিয়ে বেধে সেসব গলির উপরের কারেন্টের তারে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতোর আরেক মাথা হাসান বিপ্লবের হাতে দেয়। সুতো ধরে বিপ্লব ছাদের এক পাশে বসে থাকে। সুতো ছেড়ে দিলে গলি দিয়ে যাওয়া পথচারীর মাথায় পড়বে। হুজুর স্যার যখন যাবে হাসান শিস দেবে। সঙ্গে সঙ্গে সুতো ছেড়ে দিতে হবে। শাহাদাৎ স্যার টেবিলে বেত্রাঘাত করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

শহিদুল আমিন বিপ্লব। কে কে ওর বন্ধু হাত তোল।

হাসান আনিস পাপ্পু অর্ধ হাত তুলে আবার স্যারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাত নামিয়ে ফেলল।

-কিরে, ওর সঙ্গে দস্যু দলে যোগ দিবি না? ও একটা দল বানাবে। দস্যুদল। সেই দল সাধারণদের কোনও ক্ষতি করবে না। বিরাট বিরাট ধনিকদের বাড়িতে লুটপাট করবে। আর সেসব ধন সম্পদ এনে সর্বহারা দলিতদের বিলি করবে। ও হবে ডাকাত সর্দার। ওর জীবনের লক্ষ ডাকাত হওয়া।

বাংলা দ্বিতীয় পত্রে রচনার বিষয় ছিল জীবনের লক্ষ। স্যার একটু চুপ থেকে আবার শুরু করলেন।

কয়েকমাস পরেই আমি অবসরে যাব। এই জীবনে বহু রচনা আমাকে পড়তে হয়েছে। একবার বোর্ডের পরীক্ষায় এক মেয়ের খাতা পেলাম। ‘স্যার তিন বছর যাবৎ ফেল করিতেছি। এবারও পাশ করিতে না পারিলে বিবাহ ভাঙ্গিয়া যাইবে। দয়াপরবশত হইয়া পাশ করাইয়া দেবেন। এবার পাশ না করিলে গলায় দড়ি দিয়া ফাঁস নিব।’ আরেক ছেলে একবার বর্ষাকাল রচনায় লিখল, ‘এহ,পরপর তিন বছর ক্ষরার কারণে চাষ দিতে পারছি না। আর ওনারা রচনা দিছে বর্ষাকাল।

স্যারের বলার ধরনে সবাই হেসে উঠল।
এই জীবনে কোনদিন কাউকে রচনায় পনেরোতে বারোর বেশি দেইনি। এই প্রথম পনেরোর মধ্যে পনেরো দিলাম। নে, খাতা নে। গুন্ডা-বদমাশ-ডাকাত-দস্যু।

স্যার চলে যাওয়ার পর বিপ্লবকে সবাই ঘিরে ধরল।

তুই, কয় পাতা রচনা লিখেছিস?

মাত্র আড়াই পৃষ্ঠা লিখে পনেরো। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কেউ লিখেছে ডাক্তার, কেউ শিক্ষক। ফার্স্টবয় রাশেদ লিখেছে বিজ্ঞানী। দশ পৃষ্ঠার উপর লিখে সে পেয়েছে দশ। থার্ডবয় সুলতান খুব চুপচাপ। সুবোধ বালক বলেই সে পরিচিত। স্কুল ছুটির পর সুলতান বিপ্লবের কাছাকাছি আসল।

তুই আইডিয়াটা কোথা থেকে পেলি?

সোহেল বলল, ‘দোস আমারে তোর দলে রাখিস। আমি ছ্যাঙ্গার লোম সাপ্লাই দিব।’ খারাপ ছেলে হিসেবে সোহেলের দুর্নাম আছে। মোহামেডান-আবাহনীর খেলা বা মধুমিতায় কম পয়সায় ইংরেজি ছবি দেখতে গেলে মারামারি করার প্রস্তুতি নিয়ে যায়। সোহেল কুংফু কারাত জানে। চেইনস্টিক ঘুরাতে পারে। সন্ধ্যা ধর ধর সময়ে খ্রীষ্টানদের কবরে যায়। সেখানে জংলা গাছের পাতার নীচ থেকে ছ্যাঙ্গা ধরে। বাচ্চা বাচ্চা ছ্যাঙ্গা নয়। একেবারে মধ্যমার চেয়ে বড় পাকা ডাই ছ্যাঙ্গা। ছ্যাঙ্গার গায়ে খাড়া খাড়া লোম। ছ্যাঙ্গার গা থেকে লোম সরিয়ে ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের প্যাকেটের চকমকি কাগজে সংগ্রহ করে। ওর সঙ্গে বলধা গার্ডেনে গেলে ঢুকতে টিকিট দরকার হয় না।

ক্লাসে বিপ্লব কোনও দিনই ‘ভাল’ ছাত্র নয়। কিন্তু সেই ক্লাস থ্রি থেকে এই নবম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও ক্লাসে ফেল করেনি। এমনকি আলাদা কোনও বিষয়েও ফেল করেনি। আবার কোনও বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বরও পায়নি। সে কী করে নিজের থেকে একটা রচনা লিখে ফেলে। বন্ধুরা ভেবে আশ্চর্য হয়। বন্ধুরা জানতে চায় বড় হয়ে সত্যি সত্যি ডাকাত হবে কি না। বিপ্লব বেশ আস্থার সাথে বন্ধুদের কৌতুহল নিবৃত্ত করে।

-আমার পূর্বপুরুষ ছিল দস্যু। জলদস্যু। তখন এদেশে পর্তুগিজ দস্যুদের আগমন ঘটছে। বাণিজ্য করার নাম করে তারা এদেশে হত্যা লুণ্ঠন করে। আমার পূর্বপুরুষররা পাল্টা লুণ্ঠন করতে জেলে হয়ে রাতের পর রাত নৌকা নিয়ে নদীতে নদীতে ঘুরত।
-কতদিন আগের ঘটনা? কাউকে মারতে পারছিল?
-তা তিন চারশ বছর আগে। একজন পূর্বপুরুষের নাম ছিল গুতু ম-ল। শুনেছি তার গায়ে ভীষণ জোর ছিল। একাই পাঁচ সাতজনের সঙ্গে লড়াই করতে পারত।
-কী করে এসব জানলি?
-জানতে চাইলেই জানা যায়। একবার ইতিহাস বইয়ে দেখেছিলাম।

সুলতান ধরতে পারে বিপ্লব এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছে।

জানিস কথা বানাতে পারা একটা ক্ষমতা। তুই ভাই লিখতে পারবি। একদিন বাসায় আয়। আমাদের বাসায় অনেক বই। তোকে দেখাব। বই কিন্তু বড় মামার।

সুলতান কথা বলে আস্তে আস্তে। কিন্তু কথা বলার সময় চোখগুলি জ্বলজ্বল করে। ছিপছিপে লম্বা গড়ন। কথা হয় সুলতানদের চিলেকোঠায় বসে। এটা অনেকটা এজমালি বাড়ি। একদিকে থাকে মামার চাচা-ফুপুরা। আরেক দিকে চাঁন মামারা। এই সীমানা পার হয়ে থাকে মণি। মণিরা তিন বোন মণি, মুক্তা ও রুনা। সুলতানদের চিলেকোঠার ছাদ থেকে মণিদের বাড়ি পুরোটা দেখা যায়। সুলতানের কাছে মণির একখানা ছবি আছে। ঈষৎ কোকড়া কোকড়া চুল। দুই বেণি করা। সাদা কলারের হলুদ জামা গায়। কাঠালি চাঁপার হাসি হাসি মুখ। সুলতান ছবিটা বিশ্বের ডায়রির ভেতর লুকিয়ে রেখেছে। বিপ্লব একদিন হঠাৎ দেখে ফেলে।

স্কুলে নতুন দুই তলা দালান উঠেছে। এরা ক্লাস ফোর পর্যন্ত টিনের দোচালা লম্বা ঘরে পার্টিশান দিয়ে ক্লাস করেছে। এখন দশম শ্রেণির ক্লাস হয় নিচ তলার শেষ ঘরে। এখান থেকে হেড স্যারের বাড়ি সবচেয়ে কাছে। স্কুলের সীমানা প্রাচীরের ভিতরেই স্যারের বাড়ি। তার পাশেই টিফিন ঘর। টিফিন ঘর এখনো টিনের চৌচালা। টিফিন ঘরের পিছনে বিরাট জাম গাছ। গোদা গোদা জাম ধরে। ক্লাস সেভেনে থাকতে সোহেল একবার জাম গাছে উঠে জাম পাড়ছিল। প্রধান শিক্ষক রশিদ স্যার দেখে ফেললেন। এমন মার মারলেন। তিনটা ডোরাকাটা বেত ভাঙলো। কিন্তু সোহেলের চোখে একফোটা পানি নাই। সেই বছর থেকে জাম গাছে আর জাম ধরে না।

স্কুলের পশ্চিম দিকে কবরস্থান। এখানে বিরাট বিরাট বানরের বাস। ঘাসগুলো মানুষের চেয়ে বড় বড়। এই কবরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে হত্যা করা হয় দীপনকে। ছবি তোলার ক্যামেরার জন্যে। তখন এরা নতুন ক্লাস এইটে উঠেছে। সেই থেকে কবরে ঢুকলেই গা কেমন ছমছম করে। স্কুলের মাঠ থেকে প্রায়ই বল গিয়ে কবরে পড়ে। সেই বল আনতে বানরদের সাথে লড়াই করতে হয়।

স্কুলের মাঠ দুইভাগে বিভক্ত। মাঝখানে উঁচু বারান্দাসহ টিচার্স রুম। বারান্দার একপাশে ঝুলন্ত ঘন্টা। দপ্তরি অনিল তিরিশ মিনিট পরপর গোলাকার ঘন্টায় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দেন। বারান্দার অন্যপাশে বসে মাসুদ স্যার প্রায়ই ওজু করেন। লোকমান স্যার সবসময় জিহ্বা কামড়াতে থাকেন। প্রায়শই ভুল ক্লাসে চলে আসেন। নতুন বংলা শিক্ষিকা মমতাজ বেগম যোগ দেওয়ায় ভূইয়া স্যারের পান খাওয়া বেড়ে যায়। ভূড়ির উপর সাদা ফতুয়ায় পানের রস পড়ে লালচে হয়ে থাকে। কথায় কথায় আর সুলতানের পেটের চামড়া ধরে টানাটানি করেন না। টেনে ধরে এখন আর বলেন না—

নানীর হোটেলে খাও আর মামুর ভিটায় ঘুমাও

শাহাদাৎ স্যারের বিদায় হয়ে গেল। বিদায়ের দিন ঘড়ি-ছাতা-কলম-পাঞ্জাবি উপহার দেওয়া হল। স্কুলের সাইকেল গ্যারেজের পাশে দুইটা গর্ত করা হল। তিনি গর্তের একটাতে পেয়ারা গাছ অন্যটাতে কৃষ্ণচূড়া পুতে দিলেন। সবাই হাত তালি দিল। সেই পেয়ারা গাছে পেয়ারা আর কৃষ্ণচূড়ার ডালে ফুল আসবার আগেই মেট্টিক পরীক্ষা এসে গেল।

পেছনে পড়ে রইল তিনশ বছরের পুরনো কবর। বাজা হয়ে যাওয়া জাম গাছ। বানরের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া পাউরুটির ভেংচি। অনিলের পিতলের ঘন্টা। ধুলো ওড়া মাঠ। টিফিনের সিঙ্গারা-গজা-পরাটা-বুন্দিয়া। নেভি ব্লু প্যান্ট-সাদা সার্ট। মাসুদ স্যারের কানমলা আর মণিলাল স্যারের পরিপাকতন্ত্র।

সবাই একেক দিকে ছিটকে পড়ল। কলেজ থেকে কলেজে ভাগ হয়ে গেল। কলেজ জীবন এতই ছোট দেখার আগেই শেষ হয়ে গেল।

রাশিদুল পড়ছে বুয়েটে। বিপ্লবের সাথে একদিন ক্যাম্পাস এলাকায় দেখা হল।
-পড়ার সাংঘাতিক চাপ। দম নেয়ার সময় পাওয়া যায় না।
-তুই তো বরাবরই ব্রিলিয়্যান্ট।
-এখানে সবাই ব্রিলিইয়্যান্ট। বাঘে-মহিষে লড়াই হয়। তোর কী খবর? কী পড়ছিস?
-আমি তো তোদের ধারে কাছেও নেই। আমার ঠিকানা জগা বাবুর পাঠশালা।
– তোর ডাকাত হওয়ার কী হল?
-মনে আছে তাহলে। হবে একদিন হবে।

মুকুল ডাক্তারি পড়ছে। সাদা এপ্রোন আর গলায় স্থেটিস্কোপ ঝুলিয়ে রাখে। মেডিকেল কলেজের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বেশ একটা ডাক্তার ডাক্তার ভাব নিয়ে হেঁটে যায়। বিপ্লব মাকে ভর্তি করার সময় মুকুলকে খুঁজে বার করেছিল। বেশ সাহায্য করল।মুকুল খুবই আন্তরিক।
-তুই কি এখনও ও পাড়াতেই থাকিস?
-আর কোথায় যাব বল।
-মণিলাল স্যারের সাথে দেখা হয়?
-না রে
-মণিলাল স্যার খুবই দারুণ টিচার ছিলেন। তখন পরিপাকতন্ত্র নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। এখন বুঝতে পারি কত ইম্পর্টেন্ট বিষয়। ডাক্তারি পড়তে এসে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
-তা হাড় নিয়ে পড়াশুনা করছিস হাড়ে হাড়ে টের তো পাবিই।
-আরেকজন টিচারের জন্যেও খুব প্রাউড ফিল করি। শাহাদাৎ স্যার। আচ্ছা তোর সেই দস্যু দলের খবর বল।

বিপ্লব অনেক দূরে হারিয়ে যায়। কয়েকটা ইংরেজ মারতে হবে। রেললাইনের ঢালুতে ঘন অন্ধকারে মাটির সঙ্গে মিশে বোমা হাতে শুয়ে আছে সোনাই ম-ল। ঠিক ঠিক তাক করতে পারলে ডজন খানেক মারা পড়বে।

ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা। সাহিত্য পত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্য বিপ্লব বসে আছে জেনারেল ম্যানেজারের কক্ষে। দুই কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে। ম্যানেজার সাহেব সাংঘাতিক ব্যাস্ত। কথা বলার সময় পাচ্ছেন না। কাচ দিয়ে ঘেরা ঘর। ঘরের ভিতর থেকে বাইরে দেখা যায়।

বাইরে অফিসারদের টেবিল। বুক সমান উচ্চতার পার্টিশন দিয়ে অনেকের বসার জায়গা। সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যায় আবার আড়ালও থাকে। একটা লোক প্রায় সব টেবিলেই যাচ্ছে। কিছুক্ষণ থেমে আবার আরেক টেবিলে। লোকটাকে খুবই চেনা চেনা লাগে বিপ্লবের।

-তুমি রফিক। ঠিক তো
– কেমন আছ বিপ্লব? এখানে?
– পত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্য আসছিলাম। তোমার কথা বল। কতদিন পর দেখা। সেই স্কুলের পর আর দেখা নেই।
-আমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছো। রোজই এথানে আসি।
– কেন?
-ভাত সাপ্লাই দেই। অফিস পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ভাত বেচি।
– মোয়াজ্জেম স্যার ক্লাসে ঢুকেই তোমাকে ডাকতো ডাক্তারের শালা। তোমার দুলাভাই ডাক্তার ছিলেন? তুমিতো ভাল ছাত্র ছিলে।
-সেই মেট্রিকের পরপরই বোনের সাথে দুলাভাইর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। পড়াশুনা চালাতে পারি নি। সে সব নিয়ে এখন আর ভাবি না। আগে তো খেয়ে-পরে টিকে থাকি। তোমার ডাকাত দলের কাজকর্ম কেমন চলছে?
-যোগ দিবে নাকি। তোমাকে পেলে ভালো হয়।
-কেমন?
-তুমি ঠিক জায়গা মতই চলে আসছ। প্রতিদিনই ব্যাংকে যাতায়াত করছ। কোথায় ভোল্ট কার কাছে চাবি সবই তো জানা হয়ে গেছে। একটা ডাকাতির পরিকল্পনা করে ফেল। সারাজীবন আর কষ্ট করতে হবে না।
-ঠাট্টা করছ! সকাল দেখলেই দিন কেমন যাবে বোঝা যায়। আমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না। আমি আর কোনও কাজে আসব না।
-হবে। হবে। কে বলেছে হবে না। সব মানুষের ভেতর অসম্ভব সম্ভাবনা থাকে। জীবনে অন্তত একবার হলেও ডাকাতি করার সম্ভাবনা থেকে যায়।

রফিক চা সিগারেটের বিল দিতে দেয় না। অফিস পাড়ায় অনেকেই তাকে চেনে। সে এই পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে। তার একটা দাপট থাকা দরকার।

সুলতান থাকে সবচেয়ে কাছে। কিন্তু বিপ্লবের সাথে দেখা হয় সচরাচর। বসু বাজার লেন পার হয়ে ধোপা পট্টির ভিতর দিয়ে লাল মোহন সাহা স্ট্রিটে ঢুকলে মসজিদের গলির কল পাড়ের বাড়িটা সুলতানদের। আসলে এটা সুলতানের নানীর বাড়ি। সুলতান বড় হয়েছে নানীর কাছে। নানী যত দিন জীবিত ছিল ততদিন সুলতানের খুবই কদর ছিল।

নানী মারা যাবার তিন মাসের মধ্যে সংসার খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেল। সুলতান একবার বড় মামার ভাগে পড়ে, আবার ছোট মামার । পরের সপ্তায় আবার মেজ মামার। ফুটবলের মত এ ওকে পাস দেয়। সুলতানের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। বাবার দিকের সম্পর্ক বহু আগে থেকেই বন্ধ। শেষ পর্যন্ত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠে না। এ ব্যাপারে কারও কোনও মাথাব্যাথা নাই। কেউ ঠিক মতো খোঁজও নেয় না। বিপ্লবকে দেখে সুলতান খুশি হয়।
-অনেক দিন পর দেখা।
-হ্যাঁ, অনেক দিন। তা ও তো আমি আসছি বলে। তুই তো আমার বাড়ি চিনিস। একদিন তো খবর নিলি না। তুই তো ভাল ছাত্রের দলে।
-রাখ তোর ভাল আর খারাপ। আমি তো আর ছাত্রই নই।
-নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়।
-স্বাধীনতার মানে বুঝিস? মুক্ত মানে বুঝিস? খুবই খারাপ জিনিস। সমস্ত পৃথিবী আমার সামনে খোলা। অথচ আমার কোনই ক্ষমতা নেই কোথাও যাওয়ার।

কথা হচ্ছিল সুলতানদের ছাদে দাঁড়িয়ে। উঁচু নিম গাছের ফাঁকা দিয়ে পাশের বাড়িটা ঠিক আগের মতই দেখা যায়। বিপ্লব সেদিকে নজর রাখছিল। তিন বোনের কাউকেই দেখতে পেল না।
-নাই। চলে গেছে।
-কবে? কোথায়?
-বছর খানেক আগে। আমেরিকায়। মণির বড় ভাই গ্রীন কার্ড পেয়েছে।
-আর ফিরে আসবে না।
-মণি বলেছে ফিরে আসবে।
-মণির ছবিটা তোর কাছে এখনও আছে?
-হ্যাঁ। ক্লাস ফাইভ থেকে ঐ ছবিটা আমার কাছে। তুই যখন ডাকাত সর্দার হবি-গহীন দুর্গম গুহায় তোর আস্তানা হবে- সেই আস্তানায় এই ছবিটা বড় করে এঁকে টানিয়ে রাখব।
-তুই তো খুব ভাল ছবি আঁকতে পারতি।
-এখনও পারি। আর পারব কি না জানি না।

একসময় আমরা ভাল ফুটবল খেলি। বড় হয়ে আর খেলি না। একসময় আমরা ভাল ছবি আঁকি। বড় হয়ে আর আঁকি না। একসময় আমরা ভাল গান করি। বড় হয়ে আর গাই না। একসময় আমরা কবিতা লিখি। বড় হয়ে আর লিখি না।

মুকুল পুরোপুরি ডাক্তার হল। রাশিদুল হল স্থপতি। দুই মোশাররফের একজন ব্যাংকার। আরেকজনের খবর পাওয়া যায় না। নূর মোহাম্মদ বিসিএস দিয়ে সরকারি আমলা। সোহেল টার্মিনালের বড় নেতা। রফিক একটা হোটেল চালায়।

কোনও এক মামলায় জড়িয়ে বিপ্লবকে কোর্ট কাচারি করতে হয়। সেখানে মহিউদ্দিনের সাথে দেখা। মোটা গোঁফ। সুঠাম দেহ। চিনবার উপায় নেই। মহিউদ্দিনের কাছে অনেকের খবর পাওয়া গেল। মঈন কোন ব্যাংকের ডিরেক্টও হয়েছে। বিবাহের যৌতুক হিসেবে পদটি উপহার পেয়েছে।

এ.আর. মতিনউদ্দিন। যাকে ক্লাস টেন পর্যন্ত ছুটির পর মা এসে হাত ধরে নিয়ে যেত। সে এখন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক।

অনির্বাণ। অনির্বাণ সাহু। একাই এখানে পড়ে আছে। পুরো পরিবার চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। অনির্বাণ নারায়ণদিয়া স্কুলে ভর্তি হয়েছিল উপরের ক্লাসে। একদিনের ঘটনায় সবাই তাকে চিনে ফেলে। স্কুল ম্যাগাজিনে আনিসের কবিতা ছাপা হয়েছিল। পরের দিন আসল কবির কবিতার বই এনে অনির্বাণ সবাইকে দেখিয়ে দেয়।

সুলতানের সাথে দেখা হয় কোর্টে যাতায়াতের পথেই। কলতাবাজার এলাকায়।একটা পুরোন বাড়ির সামনে ছোট একটু মাঠের মত জায়গা। সেখানে উঁচু মাচার উপর দাঁড়িয়ে সিনেমার পোষ্টার আঁকছে। সুলতান খুব যত্ন করে মোটা ব্রাশ মুঠ করে নায়িকার স্তনে কমলা রঙ করছে।.
-এই করি আজকাল। পেট চলে যায়। এক পেট খুব বেশি ভাবি না।
বিপ্লব সুলতানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঢোলা প্যান্ট আর ঢোলা গেঞ্জি গায়। সারা গেঞ্জিতে হরেক রঙের রঙ। গেঞ্জির আসল চেহারা বোঝার উপায় নেই। সুলতান হাক দেয়।
-আবে শামসু। কই গেলি বে। বন্ধুরে চা সিংগারা খিলা। তোমার লেখালেখি কেমুন চলতাছে।
বিপ্লব লক্ষ করে সুলতান এই প্রথম তাকে তুমি সম্বোধন করছে। সুলতানের ভাষাও বেশ বদলে গেছে।
-এই কাজ করছ কবে থেকে?
– বেশ অনেক দিনই হল। একটা কিছু কইরাতো চলতে হয়। এইটা বড় মামার ব্যাবসা। বড় মামা হাত ধইরা নিয়া আইসা রঙের কৌটা ধরাইয়া দিল। কইল তুই পারবি, করবি না কে? ভিতরে মামার অফিস। নায়ক-নায়িকার ছবি আঁকি। একেকটা বিশ ফুট চল্লিশ ফুট।
-নায়িকার ঠোঁট সামনের থেকে দেখলে মনে হয় বড় মিষ্টি কুমড়ার টুকরো।
-ছবি দেখতে হয় দূর থেকে। মানে নির্দিষ্ট দুর থেকে। না হলে ছবি বোঝা যায় না। ছবি আঁকা আমার কাছে জ্যামিতি। জ্যামিতির উপর রঙ করা। দস্যু আস্তানা তৈরি কতদূর। আমি কিন্তু বিরাট করে একটা ছবি এঁকে দেব মনে আছে তো?
-কার ছবি? মণির? এখনও মনে রেখেছ!

সুলতান নিষ্পাপ হাসে। যেন অনেক যত্ন করে তুলে রাখা গোপন বিষয় প্রকাশ পেল।

সময় কীভাবে চলে যায় টের পাওয়া যায় না। একে একে বিয়েও হতে থাকলো একেকজনের। কারও ধুমধাম করে। কারও চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে। কেউ চুপচাপে। কেউবা টেলিফোনে আবার কেউ ইস্তেমায় খেজুর দিয়ে বিয়ে করে ফেলল। কেউ মোটা বউ পেল। কেউ চিকন বউ পেল। কারও ভাগ্যে পড়ল রাগী বউ। কেউ পেল রাগিনী। কারও বউ পাউডারের মত ফকফকা সাদা। আবার কারও বউ একটু ঘোলা। বউ যেমন হোক সকলের পটাপট বাচ্চা হয়ে গেল। বাচ্চারা লেকটোজেন নিডো হরলিকস খেয়ে বড় হয়ে গেল। বউবৃন্দ বালিশসমূহে রূপান্তরিত হইল। কেউ কোলবালিশ। কেউ পাশবালিশ। কেউবা কুশন সাইজে পরিণত হল। বাচ্চা লালন-পালন আর বৈষয়িক হিসাব নিকাশ করতে করতে কেউ নতুন বাড়ি করল। কেই বর্ধিত নতুন আধুনিক শহরে ফ্লাট কিনে উঠে গেল।

রাশিদুল এখন আর দেশে থাকে না। লস অ্যাঞ্জেলস না টরেন্টো কোথায় যেন চলে গেছে স্থায়ীভাবে। মুকুল সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালে বসে। সে এখন অনেক নামিদামি ডাক্তার।

-ছেলে আমেরিকায় থাকে। সেখানেই বিয়ে করেছে। মেয়ে থাকে জার্মানি। দুজনেই বিদেশি বিয়ে করেছে। কেউই বাংলা বলতে পারে না। ছেলের ঘরে ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। একদম ফুলের মত ফুটফুটে। বয়স তিন বছর। কাছে ডাকলে দৌড়ে গিয়ে দেয়ালে মাথা ঠোকে। সে অনুভব করতে পারে না কেন তাকে আদর করতে চাই।

যেন অনেক মজার কথা বলে ফেলেছে। মুকুল হাসতে থাকে। হাসির সঙ্গে তাল দিয়ে মতিনউদ্দিনের বিশাল ভূড়ি নড়ে উঠে। মহিউদ্দিন, বিপ্লব ওরাও হেসে ওঠে।
এত বড় ভূড়ি হইছে কেন?
-ইচ্ছা করে কি হয়? কমাতে পারি না। সারাদিন বসে কাজ করতে হয়।
-ইদানিং হার্ট অ্যাটাক অনেক বেড়েছে। ইউরোপিয়ান এক জার্নাল বলছে এশিয়ানদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে না পারলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। সাবধানে থাকিস। আর এই বয়সে এমনিতেই সাবধান থাকা উচিত।
-বিপ্লব দেখি এখনও সমানে সিগারেট খাস। তোর সেই ডাকাত না দস্যু কী অবস্থা তাদের। আর কি দলটল বানাতে পারবি?
-দেখা যাক।

দরবার হলে বিয়ের বিশাল অনুষ্ঠান। মঈনের মেয়ের বিয়ে। কত মানুষের আয়োজন অনুমান করার জো নেই। অনেক নামকরা লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। মঈন সবার সঙ্গে হেসে হেসে করমর্দন করছে। বিপ্লবের ভাবতে ভাল লাগে এত লোকের সঙ্গে মঈনের যোগাযোগ আছে। এখানে এসে স্কুলের কয়েকজন বন্ধুকে পাওয়া গেল। নতুন বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাই এখন বেশি। তবু মঈন মহিউদ্দিন মারফৎ যে কয়জনের খোঁজ পেয়েছে খবর দিয়েছে। এসে ভালই লাগলো। দেখা হয়ে গেল।

শহর বড় হতে হতে উত্তর-পশ্চিমে বাড়ল। খাল-বিল-নদী-নালা দখল হয়ে গেল। একশ ফিট নিচের মাটি টেস্ট হল। ডোবা ভরে উঁচু উঁচু দালান উঠল। মানুষে মানুষে সেই সব দালান ভরে গেল। চাষের জমি ভরাট করে রাস্তা হল। বাজার হল। নতুন নতুন মার্কেট উঠল। নদীর উপর দিয়ে রেললাইন চালু হল। নদীতে চর পড়ল। সেখানে চাষ হল। অনাবাদি জমিতে লাঙ্গল ঢুকল। পাঁচ বছর পর পর সরকার বদল হল। নতুন নতুন পত্রিকা ছাপা হল। জাকজমক করে চ্যানেল জন্ম নিল। অনেক পাখিকে ধরে এনে ভালবেসে খাঁচায় পুরল। আকাশে অনেক ঘুড়ি কাটা পড়ল। নতুন কবরস্থান তৈরি হল। অনেক অনেক ডাক্তার-প্রফেসর-আমলা অবসরে গেল। পৃথিবী ছোট হয়ে গেল। একমাসের পথ দশ ঘন্টায় নেমে এল। বিশ দিনের চিঠি এক মুহুর্তে চলে গেল। শোষণের নতুন নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেল। পর্তুগিজরা বন্ধু হয়ে গেল। ইংরেজরা বন্ধু হয়ে গেল। পাকিস্তানিরা বন্ধু হল। শত্রু হারিয়ে গেল। দেশিয় প্রতিভাবানরা সেসব জায়গা দখল নিল। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ল। আসমা চা বানিয়ে বিপ্লবকে এগিয়ে দিল—
-সেই তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে ডাকাত দলের কথা শুনেই আসছি। কোন একটা কাজ আজ পর্যন্ত গুছিয়ে করতে দেখলাম না। এক লেখালেখি কর তা ও মানুষ চাইতে চাইতে তারপর। মানুষের এত ঠেকা নেই। আজকাল কেউ আর পড়ে-টড়ে না। কারা যেন আসছিল তোমার গল্প থেকে ছবি বানাতে চায়- স্ক্রিপ্ট দিছ করে-দাও নাই…

আরশি কথাচিত্র। রাজমণি সিনেমা হলের উল্টাদিকের বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলা। লিফট নাই। এই বয়সে পাঁচ তলায় উঠতে পা ধরে যায়। কয়েকবার বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ওঠা গেল। অফিসে কথা বলার মত তেমন কাউকে পাওয়া গেল না। পরপর দুইটি সিনেমা ফ্লপ করায় কোম্পানি উঠি উঠি করছে। এখানেই একটা লম্বা বেঞ্চের উপর শুয়ে থাকা অবস্থায় সুলতানকে চিনতে পারল। মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। যে কয়টা আছে এদিক সেদিক বড় হয়ে ঝুলছে। মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাঁড়ি। চোখ দুটো গর্তে।
-এদের সিনেমার পোস্টা আঁকতাম। এখন কাজকর্ম নাই। দুই একটা সিনেমা যা-ও হয় ব্যানারের দরকার হয় না। আমগো দশ দিন আগে অর্ডার দিতে হয়। আর মেশিনে ঘন্টায় হাজার হাজার ছাপা যায়। ডিজিটাল পোস্টার। আমি এনালক যুগের মানুষ। একালে অচল।
-থাকো কোথায়? মামাদের বাড়িটা ঐরকমই আছে? পুরোনো
-মামারা কেউ আর বেঁচে নেই। বড় মামার ছেলে মামার ব্যাবসা বুঝে নিছে। এখন আর আগের ব্যাবসা নাই। ওরা প্যাকেজিং মেশিন তুলছে।
-আর বাড়িটা?
-প্রথমে ভাগযোগ করে থাকত। পরে ডেভলপারকে দিয়ে দিল। ভাগের ভাগ দুটো করে ঘর পেয়েছে। এ ওদেরই লাগে। আমার জায়গা হয়নি।

‘যে যার যাপনে’ নামে ঈদ সংখ্যায় একটা গল্প বেরিয়েছে। ‘আকাশ জমিন’ পত্রিকায়। লেখক ফেরদৌস বিপ্লব। লেখকের খুব ইচ্ছে নিজ হাতে পুরোনো কয়েকজন বন্ধুকে পত্রিকার কপি দেবে। এখন একা একা চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়। নাতিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। একদিনে খুব বেশি জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। ঠিক করলেন আজ দু’জায়গায় যাবেন।

সোহেলের বাড়ির গেটেই নানান কৈফিয়ত দিতে হল। দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইন্টারকমে কাকে যেন জানালেন। শেষে ড্রয়িং রুম পর্যন্ত যাওয়া গেল বটে কিন্তু সোহেলের সঙ্গে দেখা করা হল না। কয়েক মাস হল সোহেল আর কাউকে চিনতে পারে না। এই পৃথিবী সে হারিয়ে ফেলেছে।

মুকুল অনেক কথা বলল। কথা বলতে অনেক কষ্ট হয়। বুকে পেইসমেকার বসানো। গেঞ্জি তুলে মেশিনটা দেখাল। শ্বাস টানলে মেশিনটা ফুটে উঠে।
-কী লাভ হল বল? মরার সময় ছেলে মেয়ে কেউ সামনে থাকবে না। মরার পর আসবে কি না তা ও জানি না। স্ত্রীর মৃত্যু হল ছেলের কাছে। যেতে পারিনি। তখন আমার অপারেশান হচ্ছে।
-আমার একটা লেখা বেরিয়েছে এ পত্রিকায়।
– তোর কয়েকটা লেখা আমি পড়েছি। ভাল লেগেছে। পৃথিবীতে কত ভাল ভাল সাহিত্য লেখা আছে কিছুই পড়া হল না। কেরিয়ার কেরিয়ার করে সারাটা জীবন চলে গেল।

ফেরার পথে ঘাড় ঘুরিয়ে দু’পাশ দেখতে দেখতে ফিরছে বিপ্লব। ইলিশিয়ামের পিছনে যে শুকনা পুকুর ছিল সেখানে একটা ব্যাংকের পনের তলা ভবন। মেথর পট্টির যে জায়গাটায় শুকর এদো কাদা ঘাটত সেখানটায় প্রাইভেট ক্লিনিক। হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে উড়াল সেতু। নিচ দিয়ে রিকশা চলাচল করে। এখানটায় একবার সত্যজিৎ আর হাসান সাইকেল চালাচ্ছিল। প্রথম স্বৈরশাসনের আমলে। তখন নতুন নতুন কারফিউ চলছে। সত্য সাইকেল চালাচ্ছে হাসান সত্যর কাধে হাত রেখে পিছনে দাঁড়িয়ে। উর্দিরা ধরল। কান ধরে উঠবস করার পর শাস্তি স্বরূপ সাইকেল কাঁধে করে বাড়ি যেতে হবে। খ্রিস্টানের কবর আর বলধা গার্ডেনের মাঝখান দিয়ে ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল কাধে দুই বন্ধু রওনা হল। সব কথা এখন আর মনে পড়ে না। সময় বড় নিষ্ঠুর। গড়িয়ামঠ মন্দিরের দেয়ালে দৈনিক পত্রিকা লাগানো হত। উপরে লেখা ছিল ‘কাবুল স্মৃতি পাঠাগার’। কাবুল মারা গেল তখন আমরা কলেজে। সবকিছু কত দূরে চলে যাচ্ছে। অথবা সব ঠিকঠাক আছে শুধু আমি দূরে সরে যাচ্ছি।

বিপ্লব আজকাল আর একা বের হতে পারে না। বিছানা থেকেই নামতে সাহায্য লাগে। দুলাল নামের একটা ছেলে এসে বিকেলে একঘন্টা ধরে ধরে হাটিয়ে দিয়ে যায়। হাঁটতে গেলেই মনে হয় পাজামাটা বোধ হয় ভিজে যাচ্ছে, টের পাচ্ছে না। দুলাল ছেলেটা ভাল। দরদ দিয়ে যত্ন করে। নানাভাই বলে ডাকে। আজকাল কেউ আর নাম ধরে ডাকে না। কে যেন বিপ্লব বলে ডাকছিল। দুলাল শুনেও খেয়াল করছে না। বুঝতেই পারেনি। বিপ্লব থেমে থেমেই হাঁটে। একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তার ওধারে সুলতান দাঁড়িয়ে। সে অনেকক্ষণ ধরে বিপ্লবের বাড়ি খুঁজছে। পাশের বাড়িতে একটা বিরাট আম গাছ ছিল। তা নাই। বাড়ির সামনের দিকে একটা লেদ মেশিনের দোকান ছিল সেটাও নেই। কী করে খুঁজে পাবে। কিছুই ঠাওর করতে পারছিল না।
-একা একা চলতে পারিস?
-কষ্ট হয় কিন্তু পারি। দু’টা বিষয়ে তোমার কাছে আসা।
-চল বাসায় গিয়ে বসি।
-না, আমার তাড়া আছে। কয়েকদিন হল অনির্বাণ মারা গেছে।
-ও। অনির্বাণ বেঁচে ছিল!
-একা একা থাকত। ঘরে ধূপ দেবার কেউও ছিল না। একটা মামলায়ও জিততে পারেনি। অন্ধকার কুঠুরিতে বসে বসে মদ খেত। অনেক মদ খেত।
-তুইও তো একাই থাকিস।
– কেমন জানি ভয় ভয় করে। বেশি দিন আর থাকব না। এই খামটা তোমার কাছে রেখে দাও।
খামটা হলুদ হয়ে গেছে। সাবধানে খুলতে হয়। সাদা কালো ছবি। হলদেটে আভা পুরো ছবিটায়। দুই বেণি। ঈষৎ কোকড়া। নিষ্পাপ হাসি।
-ছবিটা রেফলেক্স স্টুডিওতে তোলা। স্টুডিওটা উঠে গেছে।
– গায়ে যে জামাটা তা বানিয়েছিল অনুপম টেইলার্স। সেটাও উঠে গেছে।
– এক মাসের জন্য লাহোর বেড়াতে গিয়েছিল। তখন ছবিটা রাখতে দেয়।
-এই ছবিটা আমি ফেলে দিতে পারব না।
– তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম। আমি মুক্তি নিলাম।

মৃত্যু সংবাদ এখন আর নতুন কিছু নয়। মনে হয় অনাগত আর প্রস্থানরত মানবের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। দেশের সবচেয়ে লম্বা মানুষ মারা গেছে। বলিউডের এক নায়ক মারা গেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখে যায় ফেরদৌস বিপ্লব। যুক্তরাষ্টে মারা গেলেন বাংলাদেশের স্থপতি রাশিদুল হক। মৃত্যুকালে তিনি-স্ত্রী-পুত্রসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। এক পলকের জন্য তার স্ত্রীর ছবিটাও পর্দায় ভেসে উঠল। চোখের সামনের সব কিছু ঘোলা হয়ে আসে। মণি বৃদ্ধ হয়ে দেখতে এরকম হয়েছে।

বিপ্লব ছবিটা সামনে ধরে আছে। সুলতান নেই। সুলতানের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে। ছবির মেয়েটার নাম মণি। খুবই ছোট বয়সের। কিন্তু মণি তো আমার সমান বয়সি। দেখতে খুবই ছোট মনে হচ্ছে কেন। মণি কেন ছোট থাকবে। মণি আমার সমান। যেখানেই থাকুক মণি আমার সমান বয়সি। বদলাতে তাকে হবেই। যখন সব কিছু বদলে যায়। বদলাতে হয়।

শহর বদলে যায়। দেশ বদলে যায়। সময় বদলে যায়। বাড়ি বদলে যায়। ঘর বদলে যায়। বিছানা বদলে যায়। বয়স বদলে যায়। চরিত্র বদলে যায়। বন্ধু বদলে যায়। শত্রু বদলে যায়। শরীর বদলে যায়। শরীরের ভাষা বদলে যায়। মানুষ বদলে যায়।

এক দল মানুষের ছেড়ে যাওয়া পৃথিবীতে আরেক দল নতুন মানুষ ঘুরে বেড়ায়। আরেক দল মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে।

অপু শহীদ- কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যকার

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন