বিজ্ঞাপন

সেক্যুলার আফগানিস্তানে যেভাবে মোল্লাতন্ত্রের উত্থান

August 26, 2021 | 8:11 pm

সারাবাংলা ডেস্ক

আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর লেখা আগের পর্বে আমরা জেনেছি যে মানুল্লাহ খান এবং সুরাইয়া খান মিলে আফগানিস্তানে যখন সামাজিক বিপ্লব নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন, তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগানিস্তানে একটা ধর্মীয় গোষ্ঠী এই বিপ্লবের বিপক্ষে ছিল। বারবার তারা আমানুল্লাহ খান এবং সুরাইয়া তার্জিকে থামানোর চেষ্টা করছিল। ১৯২৩ এবং ১৯২৬ সালে আমানুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তারা। কিন্তু ১৯২৯ সালে তৃতীয়বারের চেষ্টায় ষড়যন্ত্রকারীরা জিতে যায়। আমানুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে ওঠে যার ফলে স্ত্রী সুরাইয়া তার্জিসহ পালিয়ে ভারতের মুম্বাই চলে যান। আর সেই থেকে আফগানিস্তানে শুরু হয় কখনো না থামা এক সংঘর্ষের। আর আফগানিস্তানের ক্ষমতা চলে যায় ইসলামি কট্টরপন্থীদের হাতে। সেবছরই ব্রিটিশদের সহযোগিতার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন নাদির শাহ। মাত্র দুই বছর স্থায়ী হয় নাদির শাহের শাসনামল। পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসে নাদির শাহের ছেলে জহির শাহ।

বিজ্ঞাপন

জহির শাহ
১৯৩৩ সালের পর আফগান রাজনীতিকে পুরোপুরি আদর্শ বলা না গেলেও অন্তত স্থির এবং ক্রম উন্নয়নশীল বলা যায়। এর কৃতিত্ব পরবর্তীতে প্রায় ৪০ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকা জহির শাহ। জহির শাহ আফগানিস্তানকে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে থাকেন। নারীদের জন্য আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা।

কর্মজীবী নারীদের ঘরে থাকার নির্দেশ তালেবানের

১৯৪৭ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা
আগেই বলেছিলাম বৃটেন যখন আফগানিস্তান দখল করে সে সময় তারা ব্রিটিশ ভারত রাজ এবং আফগানিস্তান বর্ডার এঁকে দেয়। যাকে ডুরান্ড লাইন বলা হয়ে থাকে যা আজও পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমানারেখা। পরে ১৯৪৭ সালে বৃটেন ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার আগে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুই দেশ তৈরি করে যায় তখন পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমানা নিয়ে আফগানিস্তান খুশি ছিল না। তার কারণ হল, আফগানিস্তানের প্রায় ৪০ শতাংশ নাগরিক জাতি হিসেবে পশতুন। আবার পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনও একই জাতের। তাই আফগানিস্তান খাইবার পাখতুন নিজেদের জন্য দাবি করে।

এই দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় খাইবার পাখতুনে চলা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আফগানিস্তান সমর্থন দিতে থাকে। তৎকালীন আফগানিস্তান প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান সরাসরি এই আন্দোলকে সমর্থন দেন। দাউদ খান ছিল সম্পর্কে জহির শাহের চাচাতো ভাই। পাকিস্তান সেসময় দাউদ খানের এই খাইবার পাখতুনের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন দেওয়া ভালভাবে নেয় নি। আর তাই পাকিস্তান আফগানিস্তানের সাথে সমস্ত বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। আর এই অচল অবস্থা কাটাতে রাজা জহির শাহ দাউদ খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৬৪ সালে জহির শাহ ঘোষণা দেয় এখন থেকে আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন হবে জনগনের সরাসরি ভোটে। কিন্তু শর্ত থাকে এই নির্বাচনে কোন রাজপরিবারের সদস্য অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এই নিয়মটা করা হয়েছিলো শুধুমাত্র দাউদ খান যেন পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না পারে তার জন্য।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সে নির্বাচনে নারীদের পুরোপুরি ভোটাধিকার ছিল এবং চাইলে যেকোন নারী নিজের প্রার্থীতাও ঘোষণা করতে পারত। সেই নির্বাচনের সময়েই আফগানিস্তানে দুই ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। একটা হল সামজতান্ত্রিক ভাবধারার ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান’ বা ছোট করে পিডিপিএ। এবং অন্যটা ‘ইসলামিস্ট পার্টি’।

আফগানিস্তানের শেষ রাজার পতন
১৯৭৩ সাল। রাজা জহির শাহ রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশ গমন করলে দাউদ খান তার সমর্থিত সেনাবাহিনী এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার নেতাদের সাথে নিয়ে এক বিনা রক্তপাতহীন সফল ক্যু করে আফগানিস্তানে। বিদেশে অবস্থানরত রাজা জহির শাহের সেই অভ্যুত্থান মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই তিনি ইতালিতে স্থায়ী হন।

বিজ্ঞাপন

৭০ দশকে আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অস্থিরতা চলছিল। আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে চলছিলো স্নায়ু যুদ্ধ। পুরো পৃথিবীই অনেকটা সোভিয়েত বলয় বা আমেরিকান বলয়ে ভাগ হয়ে যায়। খুব অল্প কিছু রাষ্ট্রই ছিলো যারা কিনা সোভিয়েত বা আমেরিকান বলয়ে যোগ না দিয়ে নিজেদের স্বাধীনভাবে রেখেছিলো। যাদের বলা হতো নন আলায়েন্ড মুভমেন্ট (ন্যাম) বা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন।  আফগানিস্তান ছিল সেই স্বল্পসংখ্যক রাষ্ট্রের একটি।

তালেবানের দখলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, পালালেন আশরাফ গানি

দাউদ খানের সময়কাল
সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর দাউদ খান আফগানিস্তানকে রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে পরিবর্তন করে দেয়। এবং হয়ে যান আফগানিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আর আফগানিস্তান ‘কিংডম অফ আফগানিস্তান’ থেকে বদলে ‘রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান’ হয়ে যায়। রাজতন্ত্র থেকে আফগানিস্তানকে প্রজাতন্ত্রে নিয়ে আসলেও বস্তুত আফগানিস্তানে তখন শুরু হয় স্বৈরতন্ত্র যেখানে দাউদ খানের কথাই শেষ কথা ধরা হত। দাউদ খান এক নতুন আফগানিস্তান গড়ার দিকে মনোযোগ দেয়। ক্ষমতা দখলের শুরুতেই তিনি দেশের সকল ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ঘোষণা করেন।

আগেই বলেছি সোভিয়েত-যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ু যুদ্ধের কারণে সেসময় বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছিল। জহির শাহের রাজত্বে দাউদ খান যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন দাউদ খান সোভিয়েত সাহায্য নিয়ে আফগানিস্তানের অর্থনীতির উন্নতি করেছিল। কিন্তু দশ বছর পরের এই সময়টা ছিল এক নতুন যুগ। দাউদ খান বুঝতে পেরেছিল শুধুমাত্র সোভিয়েতের উপর ভরসা করে আফগানিস্তান সামনে এগুতে পারবে না। আর তাই সোভিয়েতের পাশাপাশি আফগানিস্তান আমেরিকাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। সোভিয়েত খুব একটা খুশি হয় নি আফগানিস্তানের এই পদক্ষেপে। তৎকালীন সোভিয়েত শাসক লিওনেড ব্রেজনেক সেবার আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আফগানিস্তানের এখন সকল ধরনের সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুদের থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়া উচিৎ’। যার জবাবে দাউদ খান বলেন, ‘আফগানিস্তানের মালিক আফগানিস্তানিরা। আর তাই কেউ বলতে পারে না তারা কীভাবে চলবে’।

রাজনৈতিক অস্থিরতার এই সময়  আদর্শের দ্বন্দে পিডিপিএ দুই ভাগ হয়ে যায়। আর সেই সময় ১৯৭৭ সালে দাউদ খান নিজের রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন যার নাম ছিল ‘ন্যাশনাল রেভ্যুলেশনারি পার্টি। সাথে দাউদ খান দেশের সংবিধান নতুন করে গড়ে তোলে। যার তিনটি প্রধান মূলমন্ত্র ছিল—

বিজ্ঞাপন

*ইসলাম
*জাতীয়তাবাদ
*সমাজতন্ত্র

ক্ষমতার লোভে ইসলামী মৌলবাদীদের নিজের পক্ষে টানতেই সংবিধানে এই পরিবর্তন আনেন দাউদ খান। যার ফলে পিডিপিএ’র সাথে দাউদ খানের দূরত্ব বাড়তে থাকে। কিছুদিন আগেও যে আফগানিস্তান ছিল অনেকটাই শান্তিপ্রিয় সে আফগানিস্তানে এখন শুরু হয় গুপ্তহত্যা। ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে পিডিপিএ’র নেতা দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা হত্যার শিকার হন যা দাউদ খানের পতনের জন্য অনেকটাই দায়ী। আফগানিস্তানে আবারও অভ্যুত্থান হয়। দাউদ খান এবং তার অনেক সমর্থককে হত্যা করা হয়। যা ইতিহাসে ‘সাওর রেভ্যুলেশন’ নামে পরিচিত। এবার অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার নূর মোহাম্মদ তারাকী।

আফগানিস্তানে সঙ্গীত নিষিদ্ধ থাকবে

নূর মহাম্মদ তারাকী শুরুতেই আফগানিস্তানকে রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান থেকে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান করেন। অনেকগুলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনও নিয়ে আসেন তিনি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—

*কৃষি জমি কৃষকের মধ্যে সুষম বণ্টন
*নারী কেনাবেঁচা নিষিদ্ধকরন
*সুদের ব্যবসা নিষিদ্ধকরন
*নারী শিক্ষা চালু
*কট্টরবাদী এবং মৌলভীদের ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া
*আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আফগানিস্তানি টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন করা

নূর মোহাম্মদ তারাকী সরাসরি বলতেন ‘এক বছর পর আমাদের দেশে ঘুরতে এস। তখন তুমি এদেশের সবগুলো মসজিদ খালি পাবে।’

তালেবানের সাংবাদিক নিপীড়ন

কট্টরবাদীরা এসময় কোনঠাসা হয়ে পড়েন এবং তারা পিডিপিএ’র বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ ঘোষণা করেন। পিডিপিএ আগে থেকেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে ছিল। তাই দুর্বল পিডিপিএ উপর কট্টরবাদীরা নাখোশ হয়। আর এই গৃহযুদ্ধে ১৯৭৯ সালে নূর মোহাম্মদ তারাকীকে হত্যা করা হয়।

সোভিয়েতের জন্য এটা ছিল এক সুবর্ণ সুযোগ। সমাজতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে আর আফগানিস্তানকে কট্টরবাদীদের হাত থেকে বাঁচাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। স্নায়ুযুদ্ধের সে সময় আমেরিকাই বা বসে থাকবে কেন? তারাও সোভিয়েত ইউনিয়কে প্রতিহত করতে সোভিয়েতবিরোধী আদর্শকে সমর্থন দিতে শুরু করে। সেখান থেকেই শুরু হয় আফগানিস্তানের পতন। যার ফলাফল আজকের সময়ে তালেবানের হাতে পুনরায় ক্ষমতায় আসা। (চলবে…)

আরও পড়ুন, ১ম পর্ব: ইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায় থেকে আজকের আফগানিস্তান

রেহমান মোস্তাফিজ- ফিচার লেখক ও ব্লগার

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন