বিজ্ঞাপন

শিক্ষাবঞ্চিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের ভবিষ্যৎ কী?

September 2, 2021 | 11:35 am

রায়হান রিয়াজ

বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশ কাজ করে আসছে রোহিঙ্গাদের সেইফ হেভেন হিসেবে। এরা পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে রাষ্ট্র ও উগ্র বৌদ্ধদের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৮ সালে এ ধরনের দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসে আরও ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। এই দুই পর্বে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে নানা দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটিয়ে আবার নিজ দেশ মিয়ানমারে চলে যায়। তবে অনেকেই ফিরে যায়নি। এরা রয়ে গেছে বাংলাদেশেই। বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দেয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় ২০১৭ সালের আগস্টে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সরকার, বর্মী সেনাবাহিনী আর সেদেশের উগ্রবাদী বৌদ্ধদের জুলুম নির্যাতন ও গণহত্যার কারণে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ইতিহাস খুবই দীর্ঘ ও জঘন্য। মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। নাফ নদীতে ডুবে মারা গেছে শত শত নারী পুরুষ শিশু।

শিশু অধিকার রক্ষায় ১৯৮৯ সালে নভেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সবার মতামতের ভিত্তিতে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ পাশ হয়। এরপর ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে এটি আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশে পরিণত হয়। ইতিহাসে এটি হচ্ছে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত মানবাধিকার চুক্তি। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯১টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করেছে।

এই শিশু অধিকার সনদের ৫৪টি ধারায় শিশু কল্যাণ নিশ্চিত করাসহ সকল প্রকার শোষণ, বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষার বিবরণ রয়েছে। সনদে স্বীকৃত অধিকারের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও মা-বাবার সম্পর্কে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নাগরিক অধিকার, শিশু শোষণ এবং আইনের সঙ্গে বিরোধ জড়িত শিশুসহ অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু আজকে আমরা কী দেখছি? শিশুদের প্রতি অমানবিক জুলুম নির্যাতনের মহোৎসব চলছে চারদিকে। আক্রোশ সব যেন শিশুদের উপরেই। যুদ্ধ-সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে শরণার্থী শিশুদের ঢল নেমেছে। বিশেষ করে মুসলিম শিশুরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। আগ্রাসন আর যুদ্ধের ফলে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়িাসহ বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু আজ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। শিশুদের উপর জুলুম, নির্যাতন আর শিশু অধিকার লঙ্ঘনের সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা।

রোহিঙ্গা শিশুরা বেড়ে উঠছে শিক্ষাবঞ্চিত অবস্থায়। কখনো কোনো শ্রেণীকক্ষের ভেতরটা না দেখা প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে। এসব শিশু কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপন করছে।

শরণার্থীরা কি নিরাপদে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত হবে, নাকি তারা তৃতীয় কোনো দেশের শরণাপন্ন হবে? না অন্য কোনো উপায়ে হবে সংকটের সমাধান? এসব নিয়ে আমরা যত আলাপ করি না কেন, শিক্ষাবঞ্চিত অবস্থায় বড় হলে রোহিঙ্গা শিশুদের একটি প্রজন্ম ভবিষ্যতে নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ হারাবে। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো অথবা যেখানে বাস করবে, সেখানকার অর্থনীতিতে অবদান রাখারও সুযোগ পাবে না তারা। প্রায় ৪ বছর ধরে তাদের জীবন থমকে আছে, অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে, অচল হয়ে পড়ে আছে ভবিষ্যৎ। আমি যেসব রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কারও কারও স্কুলের পড়াশোনা পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে সমাপ্ত হওয়ার পর্যায়ে ছিল, এমন সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে ওই শিশুরা আরও দুটি শিক্ষাবর্ষ হারিয়েছে। যত দীর্ঘ সময় তারা ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, শিশু হিসেবে যেসব অধিকার তাদের পাওয়ার কথা, সেগুলো অর্জনের সম্ভাবনা তত সুদূর পরাহত হয়ে উঠছে। তারা একটি ‘হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মে’ পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজারের স্থানীয় বাংলাদেশি শিশুরাও একই রকম দুর্ভাগ্য বরণ করছে। ইউএসএইডের ২০১৯ সালের ‘র‍্যাপিড এডুকেশন অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস’ রিপোর্টের তথ্যমতে, কক্সবাজারে প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনার উপযোগী বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার হার মাত্র ৭১ শতাংশ, যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন, একই সঙ্গে ঝরে পড়ার হার এখানে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ।

২০১৭ সালে বিশালসংখ্যক শরণার্থীর আগমন স্থানীয় অর্থনীতিতে আরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ইউএসএইডের একটি রিপোর্ট মতে, সেখানে জীবনধারণের ব্যয় বেড়েছে পাঁচ থেকে সাত গুন, দক্ষ শিক্ষকেরা স্কুল ছেড়েছেন এবং রোহিঙ্গা শিবিরে কাজের সুযোগ পেতে কক্সবাজার এলাকার শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। এসব বিষয় স্থানীয় বাংলাদেশি শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সব শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণ করতে হবে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে এবং বাংলাদেশে শিশুদের যথাযথ, স্বীকৃত ও মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে আগ্রহী।

আমাদের জন্য বেশি গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করার বিষয় হলো একটি প্রজন্মের শিক্ষাবঞ্চিত অবস্থায় বেড়ে ওঠার পরিণতি। শিক্ষা ছাড়া বেড়ে উঠলে কোনো প্রজন্ম নিজেদের পক্ষে কথা বলা বা অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার মতো সক্ষম হয়ে উঠবে না। সক্রিয় ও আলোকিত মননের অধিকারী হওয়ার মাধ্যমে নানা সুবিধা ভোগ করা কিংবা নিজেদের কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

বিজ্ঞাপন

জাতিসংঘের বাধ্যতামূলক শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এতে স্পষ্ট বলা আছে, শিক্ষা এমন হওয়া উচিত, যা শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠন, মেধা, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার সর্বোচ্চ বিকাশের পাশাপাশি মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং মুক্ত সমাজে দায়িত্বশীল জীবনযাপনে প্রস্তুত করে তোলার নিশ্চয়তা দেয়।

এটা আশাব্যঞ্জক যে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য যথাযথ, স্বীকৃত ও মানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ অনুধাবন করেন। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা প্রাধান্য পায় না। সম্প্রতি এক রোহিঙ্গা তরুণ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শুধু পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গা তরুণদের যেসব প্রজন্ম নিপীড়নের নিশানায় পরিণত হয়েছে, তাদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পদক্ষেপ নিতে পারে।

আমাদের নিজেদের এই প্রশ্নটাও করতে হবে, বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া একটি দেশ কী একটি প্রজন্মকে পেছনে রেখে এগোতে পারবে? বরং আমরা ধনী দেশগুলোকে উৎসাহিত করছি বিরাটসংখ্যক শরণার্থী আগমনের কারণে বাংলাদেশ যে সংকটে পড়েছে, তাতে নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্য। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও যদি এই মুহূর্তটি কক্সবাজারের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজে লাগায়, তা হবে ইতিবাচক পদক্ষেপ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কক্সবাজারে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নে কানাডার ১৬ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প রয়েছে, যা ২০২৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত চলবে।

‘কক্সবাজারে শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা জোরদারকরণে’ ৫ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। দুটি প্রকল্পই স্থানীয় এবং রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে কাজ করছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ১২৭ মিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিক্ষার সুযোগ এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভুক্তভোগী সদস্যদের জন্যও সহায়তা রয়েছে। এসব সহায়তাকে স্বাগত, তবে আরও অনেকই কিছু করা প্রয়োজন। বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’-এর চলতি বছরের আবেদনে।

রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় বাংলাদেশি সম্প্রদায় উভয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য রক্ষা করে এমন যথাযথ, স্বীকৃত ও মানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজন। আর এ জন্য যেসব জিনিসপত্র ও সহায়তা দরকার, তা নিয়ে আরও আলোচনা হতে হবে। কিন্তু এটা শুধু তখনই সম্ভব, যখন আন্তর্জাতিক মহল নীতিগতভাবে এটার গুরুত্ব মেনে নেবে এবং সমর্থন জানাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন