বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর যার প্রতি কিলোমিটারে শত গর্ত

September 24, 2021 | 11:09 am

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: কালুরঘাট থেকে পতেঙ্গা শাহ আমানত বিমানবন্দর। এই সড়কটিই চট্টগ্রাম নগরীর প্রধান সড়ক হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন ৫০ হাজারেরও বেশি যানবাহন আর লাখো মানুষের চলাচল এই পথে। এই সড়কটির তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। কিন্তু চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য সড়কটির লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে গিয়ে এই সড়কের ১৬ কিলোমিটারে প্রস্থ বরাবর এক-তৃতীয়াংশ ঘিরে রেখেছে সংস্থাটি।

বিজ্ঞাপন

সিডিএ’র এই উড়াল সড়ক নির্মাণের কাজ এখন নগরবাসীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের মধ্যে নগরীর চৌমুহনী থেকে আগ্রাবাদ বাদামতলীর মোড় পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৬৬টি গর্ত তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আগ্রাবাদ থেকে বারেক বিল্ডিং পর্যন্ত সড়কে ছোট-বড় মিলিয়ে গর্ত পাওয়া গেছে অন্তত ৯৩টি। এর বিপরীত দিকে বারিক বিল্ডিং থেকে চৌমুহনী মোড় পর্যন্ত সড়কে গর্ত আছে অন্তত ১২০টি।

সড়কের এই অংশটিতে প্রতি কিলোমিটারে গড়ে অন্তত শখানেক গর্ত দেখা গেছে। আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ের আশপাশে এত বড় বড় গর্ত আছে যে, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পর্যন্ত আটকে যায়। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে সল্টগোলা ক্রসিং হয়ে বন্দরটিলা পর্যন্ত এলাকা।

সড়কের যে অবস্থা, তাতে মোটরসাইকেল চলাচলেরও উপায় নেই [ছবি- শ্যামল নন্দী]

সড়কের যে অবস্থা, তাতে মোটরসাইকেল চলাচলেরও উপায় নেই [ছবি- শ্যামল নন্দী]

খোদ সিডিএ কর্মকর্তারাই বলছেন, এলিভেট এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ এবং বর্ষার কারণে নগরীর দেওয়ানহাট মোড় থেকে সিইপিজেড পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়কে এত গর্ত তৈরি হয়েছে যে যানবাহন চলাচলের প্রায় অনুপযোগীই বলা চলে। সেখানে পিচঢালা পথের অস্তিত্ব নেই। সিডিএ কর্মকর্তারা মুখে বিষয়টি স্বীকার করলেও কার্যক্রমে নগরবাসীর মনে হয়, অর্ধলাখ যানাবাহন এবং কয়েক লাখ মানুষের চলাচলে অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে যেন তাদের কোনো দায়বদ্ধতাই নেই।

বিজ্ঞাপন

গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের সঙ্গে যুক্ত আছে চট্টগ্রাম বন্দর, সিইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড, ছয়টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপো, শতাধিক কলকারখানা, ব্যাংক-বিমা, সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সেখানে কাজ করেন কয়েক লাখ শ্রমিক। শুধু ইপিজেডেই দিনে লক্ষাধিক শ্রমিকের যাতায়াত রয়েছে, যাদের দিনে সেখানে গিয়ে রাতে ফিরতে হয়।

বিমানবন্দর সড়কের একটি বেসরকারি ডিপোর কর্মচারী বিপ্লব দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ছয়-সাত মাস ধরে আমরা যে ভোগান্তি পোহাচ্ছি, সেগুলো ভাষায় বলার মতো নয়। আমাদের শিফটিং ডিউটি। দিনে কোনোমতে বাসে যেতে পারি। কিন্তু বাস গর্তে পড়লে মনে হয় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। রাতে ডিউটি পড়লে বাসই পাওয়া যায় না। আবার ছুটি শেষে রাতে বের হলে শহরের দিকে বাস পাওয়া যায় না।’

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের কর্মকর্তা বাবলা চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মোটরসাইকেলে অফিসে যাই। আমার বাসা দেওয়ান বাজার থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে আগ্রাবাদ অফিসে যেতে আগে সময় লাগত সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। এখন রাস্তা তো মোটরসাইকেল চালানোর উপযোগীও নেই। অফিসে যেতে ঘণ্টার ওপর সময় লাগে। এই দুর্ভোগ কবে শেষ হবে আমরা জানি না।’

বিজ্ঞাপন
কিছু দূর পরপরই এভাবে খুঁড়ে রাখা হয়েছে সড়ক [ছবি- শ্যামল নন্দী]

কিছু দূর পরপরই এভাবে খুঁড়ে রাখা হয়েছে সড়ক [ছবি- শ্যামল নন্দী]

নগরীর ১০ নম্বর রুটের বাসচালক মো. আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু বড় বড় গর্ত নয়, একবার যানজটে পড়লে ঘণ্টা পার হয়ে যায়। সকালে ইপিজেডের গাড়ির জন্য যানজট হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দর ও ডিপোর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, লরি যখন বের হয় তখন আবার যানজট হয়। ভাঙা সড়কের কারণে রাস্তার অর্ধেকে গিয়ে টায়ার নষ্ট হয়ে যায়, মেশিনারিজ নষ্ট হচ্ছে। ট্রিপ মারতে পারি কম। আমাদের ইনকামও কমে গেছে।’

সিইপিজেডের একটি পোশাক কারখানার কর্মী আব্দুল হাকিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাড়িতেও চলতে পারি না। রাস্তা ভাঙা, জ্যাম, ধুলোবালি। আবার রাস্তায় হাঁটতেও পারি না। গর্তে পানি জমে আছে। রাস্তায় কাঁদা। হাঁটার কোনো উপায় নেই। ফুটপাত দিয়ে হাজার হাজার মানুষ। ভোগান্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না।’

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) তারেক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেওয়ানহাট থেকে বাদামতলী মোড় ও সল্টগোলা ব্যারিস্টার কলেজ থেকে নেভিগেটের মোড় পর্যন্ত রাস্তার খুব বেহাল দশা। সেখানে গাড়ি চালানো দায়। পুরোটা সময় গাড়ির গতি থাকে ধীর। মাঝে মাঝে যানজট হচ্ছে। যানজট নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। কারণ রাস্তায় যেসব গর্ত হয়েছে, সেখানে পানি জমে থাকছে। যারা ফ্লাইওভারের কাজটা করছেন, তাদের উচিত সড়ক সংস্কার করা। কিন্তু তারা করছেন না। আমরা মাঝে মাঝে ডেকে এনে গর্তে ইট ফেলি। কিন্তু সেগুলো যানবাহনের চাপে ২৪ ঘণ্টার বেশি থাকে না। এছাড়া রাস্তায় গাড়ির গতি স্লো হওয়ায় বন্দরের গেটে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরি আটকে থাকছে। ফলে যানজট হচ্ছে। সব মিলিয়ে বেহাল অবস্থার মধ্যে থাকতে হচ্ছে আমাদের।’

খানাখন্দে ভরা সড়কে এভাবে প্রায়ই আটকে যায় ট্রাকসহ অন্য যানবাহন [ছবি- শ্যামল নন্দী]

খানাখন্দে ভরা সড়কে এভাবে প্রায়ই আটকে যায় ট্রাকসহ অন্য যানবাহন [ছবি- শ্যামল নন্দী]

তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার উড়াল সড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সিডিএ। প্রকল্প এলাকাকে চার ভাগে ভাগ করে নির্মাণকাজ চলছে। পতেঙ্গা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং মোড় পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার, সিমেন্ট ক্রসিং থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার, সল্টগোলা থেকে বারিক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এবং বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার— এই চার ভাগে ভাগ করে নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। এর মধ্যে পতেঙ্গা থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত দুই অংশের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বারিক বিল্ডিং থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত পাইলিংয়ের কাজ চলছে।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থায় ভাঙা সড়ক দ্রুত সংস্কারের জন্য সিডিএকে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। চিঠি পাওয়ার পর গর্তগুলোতে ইটের টুকরো ফেলে ভরাট করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে বলে সিডিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু প্রধান সড়কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ চলছে, তার প্রভাব সড়কের ওপর পড়ছে। সড়কে গর্ত হয়েছে, ভারি যানবাহন চলাচল করায় গর্ত আরও বড় হয়েছে। এখন জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে এবং সেই দুর্ভোগ যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য হচ্ছে সেটা তো অস্বীকার করা যাব না। এটাও স্বীকার করতে হবে, এবার প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। নালা-নর্দমাগুলো ভরাট হয়ে আছে। পানির স্বাভাবিক নিষ্কাশন বন্ধ থাকায় গর্তে পানি জমে গেছে।’

নির্মাণকাজের পাশাপাশি সড়ক সংস্কারে গাফিলতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেওয়ানহাট থেকে ইপিজেড পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়ক একটু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি সড়ক ঠিক আছে। আমরা মাঝে মাঝে ইট দিয়ে গর্তগুলো ভরাট করছি। এই মুহূর্তে তো পিচঢালাই সম্ভব নয়। এখন আবার গর্ত ভরাটের কাজ শুরু করেছি। কয়েকদিনের মধ্যে রাস্তায় গর্ত পাবেন না। অক্টোবরে বৃষ্টি থেমে যাবে আশা করি। তখন পিচঢালাইয়ের কাজ শুরু হবে।’

এই সড়কে চলাচল করতে গিয়ে নিত্য নাভিশ্বাস উঠছে নগরবাসীর [ছবি- শ্যামল নন্দী]

এই সড়কে চলাচল করতে গিয়ে নিত্য নাভিশ্বাস উঠছে নগরবাসীর [ছবি- শ্যামল নন্দী]

শুধু প্রধান সড়কের আট কিলোমিটার নয়, বর্ষা মৌসুমে কয়েক দফা টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ সড়কেই খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের জন্য নগরীর গুরুত্বপূর্ণ অন্তত চার-পাঁচটি সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। সব মিলিয়ে নাগরিক দুর্ভোগ এখন চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে চট্টগ্রাম শহরে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পিচঢালা, কংক্রিট, ব্রিক সলিং ও কাঁচা মিলিয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার সড়ক আছে। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটারের মতো সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার এই ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে আট কিলোমিটারের মতো সিডিএ’র কাজের জন্য হয়েছে, সেখানে আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। এখন ৪০ কিলোমিটারের বাইরে অন্যান্য সড়কে যে খানাখন্দ নেই, সেটা আমি বলছি না। তবে তুলনামূলকভাবে সেগুলো মানুষ ও যানবাহন চলাচলের প্রায় অনুপযোগী নয়। এখন বৃষ্টি থেমেছে। আমরা সড়ক সংস্কার শুরু করছি। মাসখানেকের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে প্রধান সড়ক ভাঙাচোরা হওয়ায় খানাখন্দগুলো বেশি চোখে পড়ছে।’

সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বিবৃতি দিয়ে নগরীর বেশ কয়েকটি ভাঙাচোরা সড়কের কথা তুলে ধরে দ্রুত সংস্কার করে জনসাধারণকে দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি সিডিও ও চসিককে ‘কথার ফুলঝুড়ি’ বাদ দিয়ে নাগরিক দুর্ভোগ কমাতে মনযোগী হওয়ার তাগিদ দেন।

খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের নামে নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শেখ মুজিব সড়ক এবং বিমানবন্দর সড়কটি যান ও জনগণের চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলবে।কিন্তু তাই বলে কি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রাস্তাগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে? অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রাস্তাগুলো চলাচল উপযোগী করে তোলা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাজ। কিন্তু তারা সেই কাজগুলো করছে না। মানুষের নিত্যদিনের দুর্ভোগ তাদের কানে যাচ্ছে না। স্বচক্ষে দেখলে মনে হবে যেন কোনো যুদ্ধবিদ্ধস্ত এলাকার ছবি। বিমানবন্দর সড়কের বেহাল অবস্থা, পোর্ট কানেকটিং সড়কটি চলাচল অযোগ্য, সদরঘাট-মাঝিরঘাট সড়কও খানাখন্দে ভরা। মূল নগরীতে প্রবেশ করা যেন দুঃসাধ্য ব্যাপার। এলাকাগুলো মূল নগরী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।’

ছবি: শ্যামল নন্দী

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন