বিজ্ঞাপন

সম্প্রীতির গায়ে প্রশ্নচিহ্ন

October 23, 2021 | 5:17 pm

সজীব ওয়াফি

পদ্মা-মেঘনা, যমুনা অধ্যুষিত এই ভূখন্ডে বাঙালির সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান একে অপরের গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে সকলের বসবাস। ধর্মীয়ভাবে কেউ কারো প্রতিযোগী নয়, সহযোগী মাত্র। হিন্দু ময়রার তৈরি করা জিলাপিতে মসজিদে মিলাদ-মাহফিল হয়, ইসলামি জলসা হয়; তাতে কারো ধর্মের একচুল পরিমাণ খোয়া যায়নি। আবার মুসলমানদের হাতে তৈরি কাঁসার ঘটি-বাটি ব্যবহারে পুজোতেও কোনদিন অসুবিধা সৃষ্টি হয়নি। দুর্গাপূজার নাড়ু-সন্দেশ খেতে না পারলে মুসলমান বন্ধুরা যেমন অভিমান করে; ঠিক তেমনি ঈদের সময়ে সেমাই-পায়েস খাওয়ার দাওয়াত না দিলে হিন্দু বন্ধু মুসলমান বন্ধুর কাছে অভিযোগ করে। গলাগলি করে বেড়ে ওঠে আবার ভালোবাসায় পরিণত হয়ে এই মান-অভিমানের পালা। আর এর মাঝেই প্রবেশ করে স্বার্থান্বেষী মহল। বিভেদ তৈরি করে ভাতৃপ্রতীম এই দুই শ্রেণীর মানুষের মাঝে। শুরু হয় সামাজিক অস্থিরতা।

বিজ্ঞাপন

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি ভেঙে খানখান হয়েছে। পুজোর অষ্টমীর দিনে কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ে পূজা মন্ডপে প্রদর্শনী হিসেবে রাখা হনুমান দেবতার কোলে ইসলামের প্রবিত্র ধর্মীয়গ্রন্থ রাখার অভিযোগ আসে। তৈরি হয় হৈ-হট্টগোল। কুমিল্লাসহ সারাদেশে হামলা করে ভেঙ্গে ফেলা হয় অগুনিত মন্ডপ। অনাকাঙ্ক্ষিত সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বলে উঠে সারাদেশে। নোয়াখালী, রংপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেটে ঘটে সাম্প্রদায়িক হামলার ন্যাক্কারজনক বিভৎস ঘটনা। এর ভিতরে রংপুরের মাঝিপাড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট সম্প্রীতি নষ্টে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। অভিযোগ আছে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন আহত-নিহত হওয়ার।

কোন প্রকৃত সনাতন ধর্মাবলম্বী মন্ডপে পবিত্র কোরআন রাখতে যায়নি। নিজেদের সম্প্রদায়ের উপর মৌলবাদী আক্রমণ আসতে পারে এরকম আচরণ তারা পূর্বে কখনোই করেননি এবং ভবিষ্যতেও করবেন না। অন্যদিকে কোন প্রকৃত মুসলমান কোরআন শরীফ মন্দিরে নিয়ে গিয়ে দুর্গা উৎসব পন্ড করার ধৃষ্টতা দেখাবেন না; কারণ স্বয়ং ইসলামেই এ ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করা আছে। অথচ এটা নিয়েই হাঙ্গামা লাগলো, সাথে যোগ হয়েছে নানান দিকের নানান গুজব। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে- আমাদের এ ভূখন্ডে যতবারই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, ততবারই রাজনৈতিক নানান সমীকরণ সামনে এসেছে। অর্থাৎ মন্ডপে কোরআন রেখে অবমাননার অভিযোগ তুলে প্রতিমা ভাঙ্গচুর, হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ-লুটপাটে স্বার্থান্বেষী মহল যে জড়িত এটা দিনের মতো স্পষ্ট।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা। মোটা চালের দাম পৌঁছেছে প্রায় ষাট টাকার কাছাকাছি। বেড়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। শাক সবজির বাজারে আগুন। খরচ বাঁচাতে সাধারণ মানুষের খাওয়া দাওয়া কমাতে হচ্ছে। বাজারে গিয়ে ভাবতে হচ্ছে কি কিনবেন আর কি কিনবেন না। আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েও সরকারি-বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে নানান আলোচনা সমালোচনা চলছিলো। দেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের ন্যায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন করার উল্লেখ করেছেন। সরকারপক্ষ জানিয়েছেন আগের মতোই সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। বিশিষ্টজনদের পদক্ষেপের এই কারণ নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও আজ্ঞাবহ ভাবমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যার অন্যতম নজির- দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে একটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধনের নির্দেশ কমিশনকে দেওয়া হয়েছিলো, দলটি নিবন্ধনের সমস্ত শর্ত পূরণ করলেও অজানা কারণে কমিশন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অতঃপর আদালতের হস্তক্ষেপে রায়ের চিঠি পাওয়ার ৩০ কর্মদিবসের ভিতরেই কমিশন থেকে নিবন্ধন দেওয়ার কথা, কিন্তু তৎপরবর্তী প্রায় তিন বছর অতিক্রম হতে চললেও ইসি কোন ধরনের ভূমিকা রাখেনি। নির্বাচন কমিশন আজ্ঞাবহ এবং আদালত অবমাননা করেছে কাগজে কলমে এটা প্রমাণ করার জন্য ঐ রাজনৈতিক দল পুনরায় উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন মহামারী রূপে বেড়েছে, আছে ভোটারদের ভোট না দিতে পারার অভিযোগ। আস্থা এবং চ্যালেঞ্জের মুখে পরেছে নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এ সকল গণতান্ত্রিক সংকটগুলোর জোরেশোরে হল্লা তুলেছিলো।

বিজ্ঞাপন

করোনা প্রাদুর্ভাব স্থিতিশীল পরবর্তী চাকরির বাজারে একের পর এক দুর্নীতি ধরা পরছে। সামনে এসেছে করোনায় তরুণদের বয়সজনিত সমস্যা। তার উপরে সমন্বয়হীনতায় ২০-২৫টা পরীক্ষা একেই দিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আইনত সকল প্রার্থী পরীক্ষায় বসার অধিকার রাখে। সেখানে একসাথে একেই দিনে অনেক পরীক্ষা হওয়ায় তরুণদের মাঝে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। দায়িত্বশীল বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলেও ছাত্রদের সমাধান হয়নি। বরং একজন বেকারের বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিসিএস পরীক্ষার মতো দিনেও রাখা হয়েছে একাধিক পরীক্ষা। ছাত্র আন্দোলন গুছিয়ে উঠছিলো প্রায়। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, নির্বাচন কমিশনে আস্থার সংকট, বেকারত্বে তরুণদের হতাশায় চারিদিকে জনরোষ তৈরি হয়েছে এরকম সময়েই সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলায় অস্থির হয়ে উঠলো। তলিয়ে গেল মানুষের অধিকারের মিছিল।

বিগত বিশ বছরে বাংলাদেশ অসংখ্যবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হয়েছে। খোদ গত ১২ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হামলায় হামলায় সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বড় মানসিক আঘাতটা এলো এবারের দুর্গাপূজায়। সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি-মন্দিরে হামলার বিচারের আওতায় আনতে সব সরকারই অনিহা দেখিয়েছে। রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার বিচার হয়নি, বিচার হয়নি যশোরের অভয়নগরে জেলে পল্লীতে হামলারও, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলার বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও শূন্য। অত্যন্ত বিস্ময়কর যে সরকার না ঘুরতেই নাসিরনগর হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযুক্ত তিনজনকে আওয়ামীলীগ সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনে নমিনেশন দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। যদিও পরবর্তীতে গণদাবির মুখে এই মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়। অধিকন্তু নাগরিক তদন্তে এবং নির্যাতিতদের বয়ানে দেখা গেছে এই সকল হামলার সাথে কোন না কোনভাবে সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা জাড়িত। ফলে সাময়িক চাঞ্চল্য তৈরি হলেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সত্যি বলতে বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি কি নতুন করে হামলার প্রেক্ষাপট উস্কে দেয়নি? ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা কি নিরাপত্তার অভাববোধ করে নিজ ভূমি ত্যাগ করেননি! নতুবা স্বাধীনতা পরবর্তী যেখানে জনসংখ্যার ১৩.৫% হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, সেখানে এখন ৮% এ নামলো কি করে? কি করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামীলীগ সরকারের সময়েও সংখ্যালঘু সংখ্যার পতন ঘটলো!

মহা-অষ্টমীর দিনে কুমিল্লার ঘটনা দৃষ্টিগোচর হয় সকালে। সময় অতিবাহিত হলেও সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি, অল্পতে সমাধান করা সম্ভব হলেও তার কোন চেষ্টা প্রশাসন থেকে হয়নি। সেই সুযোগটাই মৌলবাদীরা নিয়েছে। নিরাপত্তা প্রদানের সদিচ্ছাই যদি থাকবে, তবে কুমিল্লার ঘটনার পরেও সারাদেশে কিভাবে পুজো মন্ডপগুলো অনিরাপদ হয়ে পড়লো? যেখানে সারাদেশে পাড়া-মহল্লায় ওয়ার্ড পর্যন্ত আওয়ামীলীগের দলীয় কমিটি আছে, সেখানে কি করে স্বার্থান্বেষী মহল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে? রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার তার আওতায় ঘটনা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, ফলে তার কপালে বদলি জুটেছে! অথচ এই লেখার সময় পর্যন্ত কুমিল্লা, নোয়াখালী বা চাঁদপুরে কিন্তু কারো বদলির ঘটনা ঘটেনি। দ্বিতীয়ত সাত দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ইকবাল নামের একজন কে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফুটেজে ইকবাল নামের ঐ ব্যক্তির আচরণ অত্যন্ত পরিকল্পিত ঘটনার ইঙ্গিত দেয়। পিছনে বৃহৎ শক্তি না থাকলে এতো বড় ঘটনা ঘটানো অসম্ভব। সুতরাং পর্দার আড়ালে প্রভাবশালী মহলের ইঙ্গিত আছে এটা পরিস্কার। উত্তেজনা প্রশমিত করতে কেন দ্রুত ঘটনার বিস্তারিত উদ্ঘাটন করা হল না? প্রভাবশালীদের পার পাইয়ে দিতেই এবং সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রান্ত বৃদ্ধি করতেই কি নাটকীয় আয়োজন? দ্রব্যমূল্য-নির্বাচন কমিশনের আলাপ চাপা দিতেই নতুন ইস্যু সৃষ্টির প্রয়োজন হয়েছিল? নাকি মৌলবাদীরা দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে আছে? খাপটি মেরে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দাবিদার দল আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও কেন মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি অথবা মূল ধারার রাজনীতিতে নিয়ে আসতে পারলো না? সর্বশেষ বছরগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিতরে কেন সহ্যশক্তি হারিয়ে গেল মহামারীর মতো? এই কি ছিলো তবে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা!

বিজ্ঞাপন

হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই এই দেশের নাগরিক। সকলের নাগরিক মর্যাদা সমান। আপাতত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপরে হামলা আসলেও পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মানুষের উপরে এ ধরনের গণ-আক্রমন ঘটবে এটা আশংকা করছেন অনেকেই। সুতরাং কেউ নিজেকে সংখ্যালঘু ভাববার প্রয়োজন নেই। ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে নিজ ভূমিতেই বাঁচার লড়াইয়ে জিততে হবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অপরাজনীতি এবং মৌলবাদ মোকাবেলার সময় এসেছে। নির্যাতিতদের বোঝার সময় এসেছে ‘দেশে থাকলে ভোট পাবো, দেশ ছাড়লে জমি পাবো’ এই তত্ত্বধারীদের। যে মন একবার ভেঙে গেছে তা হয়তো সহজে আর জোড়া লাগবে না, কিন্তু সম্প্রীতিটা অটুট থাকুক। আরেক হাজার বছর বাঙালি সংস্কৃতি একসাথে পাড়ি দেওয়ার প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন