বিজ্ঞাপন

সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ

October 24, 2021 | 6:43 pm

আঞ্জুমান রোজী

সাম্প্রদায়িক এবং অসাম্প্রদায়িক ঘেরাটোপে আমরা আটকে আছি। আমরা কি সঠিক অর্থে বুঝতে পারি সাম্প্রদায়িক এবং অসাম্প্রদায়িক বিষয়টি? মুখে মুখে বড় বড় বুলি আওড়াই। মানবতার কথা বলি। কিন্তু বাস্তবে প্রাত্যহিক জীবনে এর কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। যার কারণে, এতো এতো অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে; শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে তা নিয়ে ধোঁয়া তুলছে, কিন্তু বাস্তবে আমরা তার উল্টো চিত্র দেখছি। আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর, দেশজুড়ে যেন সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব নৃত্য চলছে।

বিজ্ঞাপন

‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’ বহু-উচ্চারিত দু’টি শব্দবন্ধ। এ দু’টি শব্দবন্ধের প্রায়োগিক ব্যবহারও বায়বীয়, অর্থাৎ যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ফলে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগুলো শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক কোনোকিছু সৃষ্টি করছে না।

যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা কী?’ তাহলে, এর স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছে, ‘যে চেতনা সাম্প্রদায়িক নয়’। স্পষ্টতঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’ কোনো স্ব-ব্যাখ্যাত ধারণা নয়। যেহেতু ‘অসাম্প্রদায়িক’ শব্দের অর্থ ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দের অর্থের উপর নির্ভরশীল, তাই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’র ব্যাখ্যা ‘সাম্প্রদায়িক চেতনা’র ব্যাখ্যা ছাড়া সম্ভব নয়। শব্দ হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক’ স্বনির্ভর নয়। এটি ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দের আগে তৎসম উপসর্গ ‘অ’ যোগে গঠিত। এই শব্দের অর্থ এর ভেতরে নিহিত নয়। ফলে, ‘অসাম্প্রদায়িক’ শব্দটি বলে না এটি কী; বরং বলে এটি কী নয়। কলামিস্ট মাসুদ রানা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে এমন প্রশ্নই রেখেছেন।

তারপরও অসাম্প্রদায়িক শব্দের একটা ব্যাখ্যা আছে। অসাম্প্রদায়িকতাবাদ বা অসাম্প্রদায়িকতা (ইংরেজি: Cosmopolitanism) হলো একটি আদর্শিক মতবাদ যেখানে সকল মানুষ পারস্পরিক নৈতিকতা ভাগাভাগি বা বিনিময়ের মাধ্যমে একটি একক সম্প্রদায়ের সদস্য হবে। যে ব্যক্তি অসাম্প্রদায়িকতার ধারণাকে যে কোন আকারে নিজের মাঝে ধারণ করেন, তাকে একজন অসাম্প্রদায়িক বা ইংরেজিতে cosmopolitan বা cosmopolite বলা হয়। একটি অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায় বা সমাজব্যবস্থা সার্বজনীন নৈতিকতা, বিনিময়মূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন জাতি দ্বারা পরিবেষ্টিত রাজনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে। একটি অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্থান বা দেশ থেকে আগত ব্যক্তিরা পারস্পারিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করেন। উদাহরণস্বরূপ, কোয়ামি অ্যান্থনি এপিয়াহ এমন একটি অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থার পরামর্শ দেন যেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ব্যক্তিগণ তাদের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মূলনীতি থাকা সত্ত্বেও পারস্পারিক শ্রদ্ধার একটি সম্পর্কে প্রবেশ করবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা এর ছিটেফোঁটাও দেখি না। বরঞ্চ দেখি গোত্রে গোত্রে বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র অসম্প্রীতির বাস্তবতা।

বিজ্ঞাপন

যার ফলে, অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাস নিয়ে জীবনযাপন করছে তাদের অনেকের বোধি মূলে প্রোথিত আছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ। বিষয়টা আপনি বুঝবেন, আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় ধর্ম বিষয়ে বেশি কথা বলে যখন। বুঝিয়ে দিতে চায় তার নিজ ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। অথচ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম ছাড়া আরও অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি, আলোচনা করতে পারি। আকারে ইঙ্গিতে নিজ ধর্মের গুণকীর্তন করা মানুষগুলো যখন অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বলে, তখন তার বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন জাগে। আরেকটা ব্যাপার আছে, নিজ ধর্মের মানুষের উপর অত্যাচার, নিগ্রহের বিষয়টা নেমে আসলে দেখা যায়, শুধু তার ধর্মের মানুষগুলোর জন্য আহাজারি করছে। এদিক থেকে মুসলমানরা মুসলমানদের জন্য ততটা সোচ্চার নয়, যতটা সোচ্চার থাকে শুধু রাজনৈতিক ফায়দা লুটার কারণে। যার কারণে, সব মানুষের জন্য মানুষ কাঁদে, এই দৃশ্য আমরা কমই দেখি। সব মানুষকে সমান চোখে দেখা, এমন ধর্মেরও কোনো আলাইবালাই নাই। আসলে বাস্তবে অসাম্প্রদায়িকতা বলতে ধোঁয়াশা একটা ব্যাপার ঘটছে।

অপরদিকে, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে যারা জীবনযাপন করে তারাই মূলত সাম্প্রদায়িক এবং এদের ধর্ম বিশ্বাসই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায়। এরা কখনই অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না। অথচ, এই শ্রেণির মানুষ অসাম্প্রদায়িকতার নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে। যাকে বলা যায়, ‘ভুতের মুখে রাম নাম।’ কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। সাম্প্রদায়িকতা কোনো সুস্থ সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হতে পারে না।

এবার আসি বাংলাদেশ সৃষ্টির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা অভিন্ন ভারতীয় জাতি তত্ত্বের বাতিলের মাধ্যমে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র দ্বিজাতি তত্ত্ব অভিন্ন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতাকে বাতিল করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা এনে দিয়েছিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিল না। আমরা পরবর্তীতে দেখি, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পূর্ব-বাংলার প্রয়োজন ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবীকৃত তথাকথিত মুসলিম সাম্যের বৈধতা বাতিল। বাঙালিকে তাই পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তিমূলে অর্থাৎ ধর্মবাদের উপর আঘাত করতে হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল কি-না জানি না।

বিজ্ঞাপন

তবে, আমাদের বুঝার জন্য প্রয়োজন যে, পূর্ব-বাংলার মানুষ তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে জাতিগত পরিচয়ের ন্যায্য দাবী নিয়ে যে-আদর্শবাদের জন্ম দিয়েছিল, তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। যেহেতু ২৪ বছর আগে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে বাঙালি পাকিস্তান গড়েছিল, তাই পাকিস্তান ভাঙার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম ছিল অনিবার্য। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ছাড়া পাকিস্তান ভাঙা সম্ভব ছিল না। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল বলেই যুদ্ধ-বিজয়ের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূল-নীতির দ্বিতীয়টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।

এখন কথা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা বিষয় কী এক? যদি তা না হয় তাহলে এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য কী? কেন আমরা সবসময় অসাম্প্রদায়িকতা শব্দটি বেশি উচ্চারণ করি, যার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ হয়ে আছে! কেন আমরা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি বেশি বেশি ব্যবহার করি না? যেহেতু বিষয়গুলো বোধের ব্যাপার, সেহেতু বোধের চর্চায় সঠিক শব্দায়মানে ব্যবহার করা কি ঠিক নয়? যদিও আমরা জানি, অসাম্প্রদায়িক শব্দটি একটি বিশেষণ পদ। অর্থাৎ, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত বর্জিত; দলগত নয় এমন এবং দল-নিরপেক্ষ ও উদার অর্থাৎ কোনো পক্ষকেই অবলম্বন করা হবে না; অর্থ যেমনই হোক না কেন বাস্তবতা কিন্তু বলে দিচ্ছে আমরা সাম্প্রদায়িকতার নামে অসাম্প্রদায়িক ছত্রছায়ায় আছি।

এখন আসি কানাডার কথায়। আমাদের প্রফেশনাল এথিকসে আছে, রাজনীতি এবং ধর্ম নিয়ে কথা বলা যাবে না। কারো সঙ্গেই না। পেশাদারিত্বের জায়গায় আমাদের বেশিরভাগ সময় কথোপকথন হয় ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে, নাহলে যে কাজ করি সেই কাজের বিষয় নিয়ে। এমনকি ক্রিসমাস সময়ে আমরা একে অপরকে উইশ করি হ্যাপি হলিডে বলে। কারণ, বছরের শেষ বলে সবার জন্যই ছুটি বরাদ্দ থাকে। ধর্মীয় উৎসব যারা করার তারা করছে, আবার যারা না করছে তারাও ছুটি এনজয় করছে। অর্থাৎ, শান্তি, সম্প্রীতি এবং সৌহার্দপূর্ণ এক পরিবেশ থাকে। যেহেতু ধর্ম নিয়ে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না, সেহেতু কারোর মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষয়টাও বুঝা যায় না। পেশাদার প্রতিযোগিতা ছাড়া আমাদের মধ্যে অন্যকোনো বিষয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এখানে সাম্প্রদায়িক বিষয় বুঝা যায় না বলে অসাম্প্রদায়িক হওয়ারও কোনো দরকার নেই। সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দিয়ে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার মানসিকতা একরকম সাম্প্রদায়িকতার কথাই বলে। বলতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতা।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (ইংরেজি: Secularism) শব্দটির বিস্তৃত অর্থ রয়েছে।ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলতে সাধারণত রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করাকে বোঝায়। রাষ্ট্রকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করতে হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের উপর নির্ভরশীল থাকে না। এছাড়া, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই পক্ষপাত করে না। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করবে না। কাউকে ধর্ম পালনে বাধ্য করা হবে না। সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো, তথ্য এবং প্রমাণের উপর নির্ভর করবে, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নয়। অর্থাৎ, বলা যায়, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’। রাজনৈতিক ব্যবহারের দিক থেকে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হলো ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করার আন্দোলন, যাতে ধর্মভিত্তিক আইনের বদলে সাধারণ আইনজারি এবং সকল প্রকার ধর্মীয় ভেদাভেদ মুক্ত সমাজ গড়ার আহ্বান জানানো হয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং অনুচ্ছেদ ৮(১) অনুযায়ী—রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ৪টি। সেগুলো হলো: ১. জাতীয়তাবাদ, ২. সমাজতন্ত্র, ৩. গণতন্ত্র এবং ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থাৎ, আমাদের ৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাই বলা আছে। অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা নেই। এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে গিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতে করতে অবশেষে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা শুরু করবে? প্রশ্নটা রেখে গেলাম।

সারাবাংলা/আইই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন