বিজ্ঞাপন

শূন্য থেকে শ্রেষ্ঠ মাঝারি উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

April 6, 2018 | 5:07 pm

।।মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার, প্রসারে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে ‘জাতীয় এসএমই মেলা-২০১৮’। মেলার উদ্বোধনী দিনে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অবদান ও অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে ‘জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০১৮’ ঘোষণা করা হয়।

পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে একজন গাজী তৌহিদুর রহমান। তার ডিসপজেবল প্লেট, বাটি, গ্লাসের উদ্যোগ এফ এম প্লাস্টিক এ বছর শ্রেষ্ঠ মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। বাংলাদেশে যদিও এখন এসব ডিসপজেবল বাসন-কোসনের বাজার বেশ সচল কিন্তু তিনি যখন এ ব্যবসায় আসেন তখন বাজারটাই ছিল অনাবিষ্কৃত। মৃদুভাষী, দৃঢ়চেতা যোদ্ধা এ উদ্যোক্তা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন তার পথ চলার গল্প। সারাবাংলার অ্যাসিট্যান্ট এডিটর মাকসুদা আজীজের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি রইলো সারাবাংলার পাঠকদের জন্য।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: অভিনন্দন তৌহিদ, মাঝারি শিল্পে শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা স্বীকৃতি, নিঃসন্দেহে খুব আনন্দিত।
তৌহিদ: আমি আসলে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তবে হ্যাঁ খুব আনন্দিত।

সারাবাংলা: তাহলে এই আনন্দের মুহূর্তে জেনেই নেওয়া যাক কেমন ছিল শুরুটা…
তৌহিদ: একদম আনন্দের ছিল না। আমার জীবনে আমি অনেক গোত্তা খেয়েছি। পথটা খুঁজে পেতেই অনেক দিন পেরিয়ে গেছে।

সারাবাংলা: পথ চলার গল্পের আগে তাহলে পথ খোঁজার গল্পটাই শোনা যাক…
তৌহিদ: আমি লেখাপড়া করেছি মার্কেটিং এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ’৯৫ সালে যখন মাস্টার্স শেষ করি, আমার ইচ্ছা ছিল ব্যবসা করব, পরিবার থেকে খুব চাপ ছিল চাকরিতে ঢুকার। সবার বিরুদ্ধে গিয়েই নানান ব্যবসা শুরু করলাম, প্রিন্টিং এর ব্যবসা, মানি এক্সচেঞ্জ, ট্রাভেল এজেন্সির কিছু টাকা শেয়ার বাজারেও খাটালাম। এরপর একটা বায়িং হাউজে চাকরিতে ঢুকলাম, সেটাও পছন্দ হলো না বের হয়ে আবার ব্যবসা ধরলাম।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: তারপর?
তৌহিদ: এরপর আমি বিয়ে করলাম! (অট্টোহাসিতে ফেটে)
বোঝা গেল তৌহিদ মৃদুভাষী হলেও তার হাস্যরস বোধ প্রবল। তারচেয়েও জরুরি বিষয় তার জীবনের এই সিদ্ধান্তে বিয়ের একটা ভালো ভূমিকা আছে।

সারাবাংলা: বিয়ের পরে ব্যবসা বেড়ে গেল?
তৌহিদ: বিয়ের পরে হলো কী, দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ল, এখন স্থায়ী চাকরির চাপ অনেক বেড়ে গেল। এরপর ২০০২ এ যোগ দিতেই হলো একটি ব্যাংকে। সেখানে ২০০৭ আমি লোন ইনচার্জ ছিলাম, গ্রাহকদের ঋণ দিতাম।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: বাহ! উদ্যোগতাদের ঋণ দিতে দিতে নিজেই উদ্যোক্তা?
তৌহিদ: চাকরিটায় তখন আমি মোটামুটি থিতু হয়ে গেছি, লক্ষ্য করলাম ঐ যে শুরুতে আমি সাত বছর আমি চাকরি না করে ব্যবসা খুঁজেছি, সে সময়টা আমার বন্ধুরা বেশ এগিয়ে গেছে। এখন তারা আমার বস হয়ে যোগ দিচ্ছে আমারই প্রতিষ্ঠানে, এটা আমাকে পীড়া দিতো। তখনই আমরা একটা ব্যবসা উদ্যোগের প্রস্তাবনা পাই। তারা এসেছিলেন আমাদের কাছে ঋণ নিতে। ব্যবসাটি ছিল বিস্কুটের ট্রের। ২০০৭ সালে এই বিস্কুট ট্রে বিষয়টি খুব জনপ্রিয় ছিল না। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান এ কাজটা করত। এই উদ্যোক্তার সঙ্গে আমার ভালো সংযোগ তৈরি হয়। তারা আমাকে তাদের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন, আমিও রাজি হই। এরপর আসে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা!

সারাবাংলা: ব্যবসা ফেল করে?
তৌহিদ: সে ব্যবসাটা আমার কখনও হয়ই নেই। আমি ওদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে চাকরি ছেড়ে সঞ্চিত অর্থ নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু শুরুতে যা ভেবেছিলাম বিষয়টি তেমন হয় না। শুরু থেকেই ওরা কিছু পরিষ্কার করেনি। আমিও তখন ব্যবসায় নতুন, লিখিত কোনো চুক্তিতে আসিনি। এর মধ্যে একদিন তারা বলে বসলো, আমি যেন নিজের পথ দেখে নেই। অতগুলো টাকার লগ্নি, সব ফেলে খালি হাতে বের হয়ে আসতে বাধ্য হলাম বের হয়ে আসতে।

সারাবাংলা: মাথায় তো সেদিন আকাশ ভেঙে পড়লো!
তৌহিদ: মাথায় তো আকাশ পড়লোই, সঙ্গে পায়ের নিচের মাটিও সড়ে গেল। সেটা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। শেয়ার মার্কেটেও ধস নামলো। সব হারিয়ে আমি যেটা বুঝলাম, আমার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: এখান থেকে উঠে আসা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না!
তৌহিদ: ঠিক ঐ জায়গাটায় বসে আমিও তাই ভাবছিলাম, কীভাবে উঠে দাঁড়াবো কীভাবে উঠে দাঁড়াবো? সবদিকে হেরে গিয়েও বাড়িতে এগুলো বলার উপায় নেই। তারা ইতিমধ্যে আমার ঝুঁকি নেয়ার বিষয়ে বিরক্ত। আমার সন্তান আছে, তাদের বিষয় আছে। আমি তখন শেষ চেষ্টাটা করলাম।

ঐ অফিসে বসে বসেই আমি ব্যবসাটা কিছুটা দেখে নিয়েছিলাম। মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের লোকদের বললাম আমাকে এই প্লাস্টিকের বিস্কুট ট্রে বানানোর মেশিন বানিয়ে দিতে পারবে কি না। তারা রাজি হলো, তাদের সঙ্গে পার্টনারশিপে আসলাম।

সারাবাংলা: কিন্তু আপনার কাছে তখন টাকা ছিল না…
তৌহিদ: আসলেই ছিল না। তবে আমাকে সহায় হওয়ার জন্য আমার বাবা ছিলেন। উনি আমাকে বাড়ির নিচে একটা জায়গা দিলেন মেশিন বসানোর। আমি শুরু করলাম। কিন্তু বাজারটা তখনও তৈরি না। চাইলেই কাজ শুরু করব এমন না।
আমি নিজেই খুঁজে খুঁজে ক্রেতা বের করলাম। বিস্কুট প্রস্তুতকারীদের কাছে গিয়ে গিয়ে বলতাম এই ট্রের কথা। কিন্তু কাজ হতো না। এরপর আমি স্যাম্পল তৈরি করলাম, সে সময়ই আমরা ইউএই রাজ পরিবার থেকে একটা খাবারের ট্রের বানানোর অফার আসে। এইটা সে সময় একটা বিশাল বড় অর্ডার ছিল।

সারাবাংলা: তাহলে এটা জীবনের টার্নিং পয়েন্ট?
তৌহিদ: মজার কথা হচ্ছে এই কাজটা করতে গিয়ে আমরা অনেক টাকা অপচয় করি। কারণ আমরা এত বড় কাজ করে অভ্যস্ত ছিলাম না। তারপরেও আমাদের খুব লাভ হয়। তখন আমার আত্মবিশ্বাস জাগে, না আমি পারব! তবে এর চেয়ে বড়ও একটা টার্নিং পয়েন্ট আমার ব্যবসায় আসে।

সারাবাংলা: সেটা কেমন?
তৌহিদ: ২০১৩ আমেরিকার একটি ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা আমাদের কোনো শর্ত ছাড়াই ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। টাকাটা তখন আমাদের দরকার ছিল কিন্তু প্রোপজাল বানানোর সময় ছিল না। সৌভাগ্যই বলা চলে তারা নিজেরাই সব গুছিয়ে একটা ভালো টাকা ঋণ দেন। আমি যা চেয়েছিলাম ওরা তার চেয়েও বেশি টাকা দেয়।

২০১৫ সালে আমি আবার ওদের কাছে টাকা চাই, ওখান থেকে বলা হয়, আমরা আর লোনে যাচ্ছি না, তুমি যদি রাজি থাকো আমরা ইকুয়িটি শেয়ারে যেতে চাই, আমরা ইনভেস্ট বাড়িয়ে দিবো। আমার তখন ভালো টাকা দরকার ছিল। স্থায়ী একটা জায়গা দরকার ছিল, মেশিন কেনা দরকার ছিল। আমি রাজি হয়ে যাই, ওরা ৩৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। আমি আরও বড় করে তৈরি করার সুযোগ পাই।

২০১৬ সালে নরসিংদীতে সোয়া ২ একর, ৫৫ হাজার স্কয়ার ফিটের একটা স্থাপনা দিয়ে কাজ শুরু করি। অনেক মেশিন আসি, নতুন প্রযুক্তি আনি। কাজটা আরও নিখুঁত হওয়া শুরু করে।

সারাবাংলা: আপনার ব্যবসাটা প্লাস্টিক নিয়ে যেটা ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়া হয়, আমরা এখন পরিবেশ দূষণ নিয়ে খুব সোচ্চার। আপনি কি এটাকে আপনার একটা ঝুঁকি মনে করেন না?
তৌহিদ: প্লাস্টিক জিনিসের একটা রি-সাইকেল সাইকেল আমাদের দেশে খুব ভালোভাবে কাজ করে। শুধু পলিথিন আর স্টাইরো ফোম ছাড়া সব প্লাস্টিক জিনিস ৮০ শতাংশ পর্যন্ত আবার ব্যবহৃত হয়। পলিথিনটায় ধুলো ময়লা মিশে এমন হয়ে যায় যে সেটাকে আর ব্যবহার করা যায় না। তাই প্লাস্টিকের পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি আমাদের নেই বলেই আমার বিশ্বাস।

সারাবাংলা: আপনার ব্যবসা জীবনে আপনে বেশ চড়াই উৎরাই দেখেছেন, নিজেরও হয়তো কিছু ভুল ছিল, এগুলোর বিষয়ে কিছু বলুন…
তৌহিদ: আমি যখন ব্যবসা একটু গুছিয়ে উঠতাম তখনই আমি চেষ্টা করতাম ভালো থাকার একটা বিশদ চিত্র পরিবারের মানুষদের সামনে তুলে ধরার। অহেতুক খরচ করতাম, বোঝাতে চাইতাম আমি ভালো আছি। একবার ব্যাংক ঋণ নিয়ে একটা গাড়ি কিনে ফেললাম! গাড়ি কিনে সেটা চালাতে গিয়ে বুঝলাম এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আপনার যুদ্ধ যেহেতু কেউ ভাগ করে না, তাই কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছু করে নিজের ক্ষতি করা ঠিক না।

সারাবাংলা: তাহলে ভবিষ্যত উদ্যোগতাদের জন্য এটাই আপনার পরামর্শ?
তৌহিদ: (কিছুটা ভেবে) নাহ আমার আরেকটা পরামর্শ আছে। যারা উদ্যোগে আছেন বা ভবিষ্যতে আসবেন, তারা লক্ষ্য রাখবেন যেন আপনাদের সামনের পিছনের মানুষদের আরাম দিবেন, যেমন সাপ্লায়ারকে সময়মতো টাকা দিবেন, ক্রেতাকে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি করবেন, তারা আরামে থাকলে আপনার ব্যবসা মসৃণ হবে।

সারাবাংলা: তৌহিদ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তৌহিদ: আপনাদের এবং সারাবাংলার পাঠকদেরও অনেক ধন্যবাদ।

সারাবাংলা/এমএ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন