বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘নথি গায়েব’ নতুন কিছু নয়!

November 2, 2021 | 11:20 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ থেকে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও একই মন্ত্রণালয়ে থেকে নথি গায়েব হয়েছে। মাত্র দেড় মাস আগেও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ থেকেই নথি গায়েব হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি বিষয়টির।

বিজ্ঞাপন

কর্তৃপক্ষ বলছে, মন্ত্রণালয়ের অফিস কক্ষ থেকে সম্প্রতি ১৭টি নথি গায়েব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে আরও একজনকে যুক্ত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কক্ষ থেকে নথি গায়েব কিভাবে সম্ভব?— এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান মো. শাহ্ আলম। স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। আর তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্যও নেওয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সব ফাইলই গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রণালয়ের মতো সুরক্ষিত এলাকা থেকে নথি চুরির ঘটনা নজিরবিহীন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে কেউ জড়িত না থাকলে এমনটা সম্ভব না। আর তাই এই ঘটনার পেছনে কারা দায়ী তা তদন্ত করে দ্রুত বের করে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।

সম্প্রতি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের ২৯ নম্বর কক্ষ থেকে ১৭টি নথি হারানোর কথা জানিয়ে বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের উপ-সচিব (প্রকল্প বাস্তবায়ন-১ শাখা) এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব (ক্রয় ও সংগ্রহ-২) নাদিরা হায়দার। এই ১৭টি ফাইল ছিল স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শাহাদৎ হোসাইনের কক্ষের পাশেই থাকা একটি কক্ষের কেবিনেটে। এই কক্ষটিতে বসেন স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা-২-এর সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. জোসেফ সরদার ও আয়েশা সিদ্দিকা। গায়েব হওয়া নথিগুলো এই দুই কর্মীর কেবিনেটেই ছিল। যার চাবি তাদের কাছেই থাকতো।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন-

জিডিতে বলা হয়, চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের ক্রয়সংক্রান্ত শাখা-২-এর কম্পিউটার অপারেটর জোশেফ সরদার ও আয়েশা গত বুধবার (২৭ অক্টোবর) কাজ শেষ করে ফাইলটি একটি কেবিনেটে রেখে যান। ওই ফাইলে ১৭টি নথি ছিল। পরদিন দুপুর ১২টার দিকে কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, ফাইলগুলো কেবিনেটে নেই।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই ১৭টি নথি গায়েব হওয়া এবারই প্রথম নয়। মাত্র দেড় মাস আগেও একই বিভাগ থেকে গায়েব হয় আরও একটি নথি। সেই নথিটি ছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কেনাকাটা সংক্রান্ত। পরে দায়িত্বে থাকা আয়েশা সিদ্দিকাকে নথিটি খুঁজে বের করতে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির জবাব না পাওয়ায় পরে তাকে একটি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। তবে আয়েশা সিদ্দিকা জানান, তিনি অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে শারীরিক অবস্থা ভালো না। খোয়া যাওয়া নথি সম্পর্কেও তিনি কিছু জানেন না।

মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, নথি হারানোর বিষয়ে আয়েশা সিদ্দিকার জবাব সন্তোষজনক ছিল না। এ জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে অনাগত সন্তানের উপরে প্রভাব পড়তে পারে বিবেচনা করে কঠোর হওয়ার প্রক্রিয়াটি ঝিমিয়ে পড়ে।

জানতে চাইলে সম্প্রতি নথি খোয়া যাওয়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মো. শাহ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত চলাকালীন সবকিছুই বিবেচনায় নেব। আগের নথি গায়েবের সঙ্গে বর্তমানের কোনো যোগসূত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘সম্প্রতি যে নথিগুলো গায়েব হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজসহ অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজের কেনাকাটা সংক্রান্ত একাধিক নথি, ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি, নিপোর্ট অধিদফতরের কেনাকাটা, ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত নথি। আর এগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও বিভাগের কেনাকাটার সঙ্গে সম্পর্কিত।

বিজ্ঞাপন

সেইসঙ্গে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতর ও স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদফতরের বিভিন্ন প্রকল্পের নথি রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র।

এ ঘটনায় স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) রাতে অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. শাহ্‌ আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আহসান কবীর এবং উপসচিব আবদুল কাদের। পরে কমিটিতে বিভাগের উপসচিব মল্লিকা খাতুনতে যুক্ত করা হয়। এই কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তদন্ত কমিটির প্রধান মো. শাহ্ আলম।

জানতে চাইলে চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শাহাদৎ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নথি গায়েবের ঘটনায় জিডি করা হয়েছে শাহবাগ থানায়। সিআইডি, এনএসআই এসেছে। এখন তো আমাদের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তারা আমাদের সবার মোবাইল নম্বর নিয়েছে। আগামীকাল থেকে এর হদিস বের করার চেষ্টা করা হবে।’

নথি গায়েব হওয়ার স্থান বিষয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে কেবিনেট থেকে ফাইলগুলো নেওয়া হয়েছে, সেটিতে কোনো ঘষামাজা নেই, দরজাও ভাঙা হয়নি। যে পয়েন্টে চাবি প্রবেশ করে সে জায়গাটিও স্বাভাবিক রয়েছে। এতে মনে হয়, হয়তো নকল চাবি অথবা অরজিনাল চাবি দিয়ে কেবিনেটটি খোলা হয়েছে। কারণ চাবি না থাকলে এত সূক্ষ্ণভাবে কেউ ফাইল নিতে পারত না। বাইরের কারও পক্ষে এ কাজ করা অসম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘যে নথিগুলো গায়েব হয়েছে সেগুলো আসলে কিছু ডকুমেন্ট। আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটার জন্য প্রশাসনিকভাবে অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। সেগুলোর অর্থ ছাড় হয়ে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। আমরা শুধুমাত্র অনুমতিটা দিয়ে থাকি, যা ডকুমেন্ট আকারে সংরক্ষিত থাকে। সেই ডকুমেন্ট নিয়ে কার কী লাভ তাই বুঝতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনিক আদেশপত্র নিয়ে কোনো লাভ কারও হওয়ার কথা না। ১৭টি ফাইল একসঙ্গে খোয়া যাওয়াটা আবার স্বাভাবিক চোখেও দেখা যাচ্ছে না। কারণ সরকারি দলিলের চুরি বিশাল অপরাধ। আর এটা কারা করছে তা বের করা জরুরি। যাতে এ ঘটনার কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

শাহদাৎ হোসেন বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই পুরো কেবিনেটের এলাকায় খোঁজ করেছি। আমাদের ধারণা যে, এই ফাইলগুলো একসঙ্গে চুরি নাও হতে পারে। আবার যেহেতু কেবিনেটে ভাঙার কোনো চিহ্ন নেই তাই ভাবছি এটা হয়তো এখানকার কেউ করে থাকতে পারে। মূল কথা হলো অপরাধীকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন।’

প্রায় দেড় মাস আগে খোয়া যাওয়া ফাইল বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভাগ থেকেই হয়েছে। সে বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। সচিব মহোদয়ের নির্দেশনা ছিল, দ্রুত ফাইলটি খুঁজে বের করা। কিন্তু মানবিক কারণে সেটির বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি।’

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. শাহ্‌ আলম বলেন, ‘আমরা প্রতিটি বিষয় যাচাই করে দেখব। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজেও সহায়তা করব। তবে তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকবে যে, পুরো ঘটনা যাচাই করে নির্ধারিত সময়ের মাঝে রিপোর্ট জমা দেওয়া।’

নথি গায়েব ঘটনায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগের সচিব আলী নূর সারাবাংলাকে বলেন, ‘নথি গায়েবের ঘটনায় কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। এ বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি টেকওভার করতে বলা হয়েছে সিআইডিকে। তারা সন্দেহভাজন যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। যাতে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না। এছাড়াও আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সেটির রিপোর্টও আমরা যথাসময়ে পেয়ে যাব বলে আশা করছি।’

জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি ফাইল চুরি কোনো স্বাভাবিক উদ্দেশে কখনো হতে পারে না। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। যাদের অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে তাদের এ ফাইলগুলো চুরিতে কোনো লাভ হতে পারে কি না তা তদন্ত কমিটির খুঁজে বের করা প্রয়োজন। নথি গায়েব করা হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। সেটা কীভাবে সম্ভব— তাও বের করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে যারা তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে জড়িতের চিহ্নিত করে ফাইলগুলো তাদের উদ্ধার করা উচিত।’

এদিকে, মন্ত্রণালয় থেকে নথি চুরির বিষয়টিকে নজিরবিহীন বলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যে বা যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা সংশ্নিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এটি করতে পারেনি। বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

সেইসঙ্গে ফাইলগুলো যেহেতু ক্রয়-সংক্রান্ত, সেজন্য ওই ফাইলে কোনো দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আলামত রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন