বিজ্ঞাপন

একজন হাসান আজিজুল হক

November 15, 2021 | 11:50 pm

সারাবাংলা ডেস্ক

জন্ম ১৯৩৯ সালে, ভারতভাগের আগেই। কৈশোরেই চলে আসতে হয় বাংলাদেশে। দেশভাগের যন্ত্রণা আরও কোটি সংবেদনশীল মানুষের মতো বিদ্ধ করেছিল তাকেও। দর্শনশাস্ত্রে পড়ালেখা ও শিক্ষকতা করলেও মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল অন্তরজুড়ে। সেই কথা বলতেই বেছে নেন কলমকে। একের পর গল্প লিখে রীতিমতো বাংলা ছোটগল্পের এক অনন্য কারিগরে পরিণত হয়েছিলেন। দীর্ঘ সাড়ে দশক পর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসটিও রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় সাহিত্য অঙ্গনে। এক উপন্যাসেই জয় করে নেন লাখো পাঠকের মন, সমালোচকদের স্তুতি। আর পেশা হিসেবে শিক্ষকতা করতে গিয়েও হাজারও শিক্ষার্থীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি হাসান আজিজুল হক। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছোটগল্পের এক মহারথি। সবাই যখন ঢাকামুখী, তখন সাহিত্য অঙ্গনে তুমুল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও তার আবাস ছিল প্রিয় শহর রাজশাহীতে। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত থাকার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত জটিলতাগুলোও পিছু ছাড়ছিল না তার। সেখানেই নিজ নিবাস ‘উজান’-এ আজ সোমবার (১৫ নভেম্বর) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।

হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে সাহিত্য অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কবি-সাহিত্যিক, গল্পকার-ঔপন্যাসিকরা তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। শোকহত তার পাঠক-ভক্তকূল। তার মৃত্যুকে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ অভিহিত করে শোকবার্তা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আরও পড়ুন- হাসান আজিজুল হক আর নেই

বিজ্ঞাপন

স্কুলজীবনেই হাতেখড়ি, গল্পে খ্যাতি

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করা হাসান আজিজুল হকের লেখালেখির শুরুটা স্কুলজীবনেই। ১৯৫৬ সালে নাসির উদ্দিন আহমেদের সম্পাদনায় ‘মুকুল’ পত্রিকায় তার ‘মাটি ও পাহাড়’ শীর্ষক একটি গল্প প্রকাশের তথ্য জানা যায়। এছাড়া কলেজের সাময়িকীতে তার একাধিক গল্প ও কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল। ওই সময়েই বেশকিছু কবিতাও রচনা করেছিলেন। তবে ১৯৬০ সালে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সম্পাদনায় ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ এবং একই বছর সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় ‘শকুন’ প্রকাশ পাওয়ার পরই মূলত সাহিত্য অঙ্গনে সাড়া ফেলে দেন তিনি। এরপর গোটা ষাটের দশকেই একের পর এক কালোত্তীর্ণ ছোটগল্প উপহার দিয়ে হাসান আজিজুল হক বনে যান ছোটগল্পের অঘোষিত রাজপুত্র।

এর মধ্যেই ১৯৬৩ সালে খুলনায় সুহৃদ নাজিম মাহমুদের সহযোগিতায় ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন হাসান আজিজুল হক। তারা যুগ্মভাবে এই নামের একটি সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ছোটগল্পের পাশাপাশি তিনি লিখতে থাকেন প্রবন্ধ, উপন্যাসিকা, শিশুসাহিত্য। তার সম্পাদনায় সাহিত্য ছাড়াও সাহিত্য গবেষণা এবং দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক অনেক গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি লিখতে শুরু করে আত্মজৈবনিক বিভিন্ন রচনা। শূন্য দশকের শেষের দিক থেকে সেগুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পেতে থাকে।

‘আগুনপাখি’র ডানায় উপন্যাসযাত্রা

জানা যায়, হাসান আজিজুল হক সেই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তবে সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৬০ সালে ‘বৃত্তায়ন’ নামে আরও একটি উপন্যাস লেখেন তিনি। তবে ১৯৯১ সালে সেটি তিনি উপন্যাসিকা আকারে প্রকাশ করেন। লেখার চার দশক পরে ২০০৫ সালে প্রকাশ করেন তার আরেক উপন্যাস ‘শিউলি’। তবে এটিকেও তিনি বলেন উপন্যাসিকা। শেষ পর্যন্ত তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসটি হলো ‘আগুনপাখি’, যা ২০০৬ সালে প্রকাশ পায়।

বিজ্ঞাপন

ছোটগল্পের অনন্য কারিগরের স্বীকৃতি পাওয়া হাসান আজিজুল হক প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাস দিয়েও সাহিত্যাঙ্গনে ঝড় তোলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লব পরবর্তী সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতভাগ, বিলেতি পণ্য বর্জন, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো বিস্তৃত পরিসরজুড়ে বিস্তৃত এই উপন্যাসের কাহিনী। প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত এক মুসলিম পরিবারের নিরক্ষর এক নারীর বয়ানে এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের স্বীকৃতি ছাড়াও এই উপন্যাসের জন্যই ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে আনন্দ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

আরও পড়ুন- রাবি শহিদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা, হাসান আজিজুল হকের জানাজা বাদ জোহর

উল্লেখযোগ্য যত গ্রন্থ

হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রোদে যাবো (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)।

কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১), অপ্রকাশের ভার (১৯৮৮), সক্রেটিস (১৯৮৬), অতলের আধি (১৯৯৮), কথা লেখা কথা (২০০৩), ছড়ানো ছিটানো (২০০৮), রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনাসহ (২০১৪) বেশকিছু প্রবন্ধের বই রয়েছে তার। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের মধ্যে রয়েছে একাত্তর: করতলে ছিন্নমাথা (২০০৫)। গোবিন্দচন্দ্র দেব রচনাবলি (১৯৭৯), একুশে ফেব্রুয়ারি গল্প সংকলন (২০০০), রমেন্দ্রনাথ ঘোষ: দার্শনিক প্রবন্ধাবলি (২০১৪), দুই বাংলার ভালোবাসার গল্প (১৯৮৯) তার সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

বিজ্ঞাপন

ফিরে যাই, ফিরে আসি (২০০৯), উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২০১১) ও এই পুরাতন আখরগুলি (২০১৪)— এই তিনটি বই ত্রয়ী হিসেবে আজিজুল হকের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া টান (২০১২) ও লন্ডনের ডায়েরি (২০১৩) নামেও আত্মজীবনীমূলক দুইটি বই রয়েছে তার। লালঘোড়া আমি (১৯৮৪) নামে একটি কিশোর উপন্যাস এবং ফুটবল থেকে সাবধান (১৯৯৮) নামে শিশুতোষ গল্পের একটি বইও রয়েছে তার। এছাড়া জর্জ শেহাদের নাটক থেকে ভাষান্তর করেছেন নাটক ‘চন্দর কোথায়’।

অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা

কথাসাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন হাসান আজিজুল হক। ১৯৭০ সালেই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৯ সালে দেওয়া হয় স্বাধীনতা পুরস্কার।

এর বাইরেও হাসান আজিজুল হকের পাওয়া পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে— আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার (১৯৯৪), দিবারাত্রির কাব্য সাহিত্য পুরস্কার (পশিচমবঙ্গ) (১৯৯৭), ক্রান্তি পদক (২০০৪), হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬), শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮)।

‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ও কলকাতার আনন্দ পুরস্কারের কথা তো বলা হয়েছেই। এছাড়া ২০১২ সালে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান তিনি। ২০১৮ সালে আইএফআইসি ব্যাংক ‘সাহিত্যরত্ন’ সম্মাননা চালু করলে প্রথমবারই তাকে এই সম্মানায় ভূষিত করা হয়।

বেড়ে ওঠা বর্ধমানে, থিতু রাজশাহীতে

হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের যবগ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখা নিজ গ্রামেই। মাধ্যমিক তথা তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে। এরপরই চলে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ (বিএল কলেজ) থেকে পেরোন উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি।

ওই কলেজেই স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নের সময়ই যুক্ত হয়ে পড়েন রাজনীতিতে। সে কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলেও পড়তে হয়। মেধাবৃত্তি দেওয়া হয়নি তাকে। শেষ পর্যন্ত ওই কলেজই ছাড়তে হয়। পরে এসে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬০ সালে নেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া গেলেও বিদেশের পরিবেশ-সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি। পিএইচডি শেষ না করেই ফিরে আসেন দেশে।

স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৬০ সালে রাজশাহী সিটি কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হাসান আজিজুল হকের। এরপর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ ও সরকারি ব্রজলাল কলেজে শিক্ষকতা করেন।

হাসান আজিজুল হক ১৯৭৩ সালে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। সেখানে ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন তিনি। এরপর থেকেই রাজশাহী মহানগরীর চৌদ্দপাই এলাকার ‘বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটিতে (বিহাস)’ নিজ বাসা ‘উজান’-এ অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন।

নিভৃতে বাস, ঢেউ সাহিত্যাঙ্গনে

দর্শনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হওয়ার সুবাদে জীবনকে ভিন্নভাবে দেখার এক অনন্য কৌশলের অধিকারী ছিলেন হাসান আজিজুল হক। গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠার সুবাদে প্রান্তিক মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতেন বলে তাদের ভাব-ভাষা-ভঙ্গি-ভাবনা সবই ছিল তার নখদর্পণে। দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, দাঙ্গা, পাকিস্তানি জান্তার অপশাসনের মতো সব অভিজ্ঞতাও জীবন দিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন। তাই হাতে যখন কলম তুলে নিয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক, জীবনের সেই অভিজ্ঞতাই হয়ে দাঁড়াল তার লেখনির শক্তি। মানুষের জীবন, ধর্ম, রাজনীতি, ক্লান্তিকর যাপন, বিভক্তি, দেশ, রাষ্ট্র, মনোজগত— সবকিছুরই স্ফূরণ ঘটতে থাকল। নিজস্ব ভঙ্গির ভাষা আর গদ্যরীতিতে হয়ে উঠলেন ছোটগল্পের জাদুকর।

তবে সেই যে প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে সখ্য, সেটিই বোধহয় হাসান আজিজুল হকের অন্তর্কথা, একান্ত নিজস্ব অনুভূতি। সে কারণেই ঢাকা নয়, প্রকৃতিঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসই ছিল তার চিরআপন। অধ্যাপনার পর অবসরেও ঢাকার নাগরিকতায় মানিয়ে নিতে আসেননি। নিভৃতেই পাঠক-ভক্ত-শিক্ষার্থী-সহকর্মীদের ভালোবাসা নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে গেছেন রাজশাহী শহরেই। তবে তার লেখনি দিয়ে বরাবরই ঝড় তুলেছেন সাহিত্যাঙ্গনে। কোলাহল থেকে দূরে তার নিজ নিবাসের প্রয়াণও একইরকমভাবেই ঢেউ তুলে গেল গোটা দেশে। অনন্তলোকে ভালো থাকুন হাসান আজিজুল হক।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন