বিজ্ঞাপন

সবজি রফতানির রোডম্যাপ মন্ত্রণালয়ে, বৃহত্তমখাত হওয়ার হাতছানি

November 18, 2021 | 1:29 pm

নূর সুমন, নিউজরুম এডিটর

ঢাকা: সবজি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর এখন রফতানিতে চোখ রাখছে বাংলাদেশ। কীভাবে সবজি রফতানি করা যায়, তার কলাকৌশলগুলোতে এখন বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। কিন্তু সবজি রফতানির ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। সেগুলো অতিক্রম করে কীভাবে সবজি রফতানিতে সফল হওয়া যায়, তার জন্য একটি রোডম্যাপের খসড়া প্রণয়ন করেছে কৃষি বিপণন অধিদফতর। প্রস্তাবিত সেই রোডম্যাপটি এরই মধ্যে জমা পড়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। রোডম্যাপ চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করে নীতিগত সহায়তা দেওয়া গেলে এই খাত দেশের তৈরি পোশাক শিল্পকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশাবাদী রফতানিকারকসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

কৃষি বিপণন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফের নেতৃতাধীন সাত সদস্যের একটি কমিটি ছিল এই রোডম্যাপ তৈরির দায়িত্বে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞ ও বফতানিকারকদের সঙ্গে ১৭টির মতো বৈঠক করেছে এই কমিটি। সবার মতামতের ভিত্তিতে তারা প্রস্তাবিত রোডম্যাপটি তৈরি করেছেন। এরই মধ্যে সেটি কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়েছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, গত বছর সবজি রফতানি খাত থেকে আয় হয় ১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের মধ্যে এই খাতের রফতানি আয় ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য সরকারের। এই লক্ষ্য পূরণেই রোডম্যাপটি তৈরি করা হয়েছে, যেটি সফলভাবে বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর সংশ্লিষ্টরা।

আমদানি-রফতানি ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদেনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০টি কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে রফতানি হয়। গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৫০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের তাজা ফল ও সবজি রফতানি হয়েছিল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়েছিল ২০৯ মিলিয়ন ডলার। তবে এর পরের বছর থেকে কমতে শুরু করে রফতানির পরিমাণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ১২৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। একই অর্থবছরে ১০ দশমিক ০৬ মিলিয়ন ডলারের আলু বিদেশে রফতানি হয়েছিল, যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল শূন্য দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮টি দেশে সবজি রফতানি করা হয়। এর মধ্যে সৌদি আরবে ২৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, কাতারে ১৫ দশমিক ০৪ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ, কুয়েতে ৯ দশমিক ২১ শতাংশ, বাহরাইনে ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ইতালিতে ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, মালয়েশিয়াতে ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং অন্য দেশগুলোতে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ সবজি রফতানি করা হয়। এদিকে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৬টি দেশের ফল রফতানি করা হচ্ছে।

তবে কিছু কিছু ফল ও সবজিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে রফতানি কমে যায় বলে ইপিবি’র ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ইইউয়ের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণগুলোর মধ্যে ছিল— আমদানিকারক দেশে সবজির স্বাস্থ্যগত মান রক্ষা করার শর্ত যথাযথভাবে পালন না করা; ফল, সবজি ও পান পাতার মধ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পোকা ও ভাইরাসের উপস্থিতি; পণ্যে পচনশীল ব্যাকটেরিয়া ও আলুর মধ্যে কন্দ পোকার উপস্থিতি; পণ্যের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে না পারা; এবং পণ্যের স্বাস্থ্যগত মানের সনদ (পিসি) না থাকা।

এ পরিস্থিতিতে সরকার সবজি রফতানির বিশাল সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে এসব সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগ থেকেই সবজি রফতানির রোডম্যাপ তৈরিতে কাজ শুরু করে কৃষি মন্ত্রণালয়। রোডম্যাপ অনুসরণ করে আগামী কয়েক বছরে মধ্যে সবজি রফতানি দেশের গার্মেন্টস শিল্পকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে সবজি রফতানিকারক ও আলুবাড়ি অ্যাগ্রো-প্রডিউস লিমিটেডের মালিক রাশেদ শামীম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সবজি রফতানি বড় একটি খাত। এটি দেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকায় একটা কারখানা করলে সেখানে গ্রাম থেকে এসে মানুষকে কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করে। কিন্তু সবজি গ্রামেই উৎপাদন হয়, এজন্য তাকে ঢাকায় আসতে হয় না। আর গ্রামের অর্থনীতি যদি ভালো হয়, তাহলে কিন্তু দেশের পুরো চিত্রটাই পাল্টে যাবে। তাই সবজি রফতানির ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর দ্রুত সমাধান জরুরি।’

সবজি রফতারি সম্ভবনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এখানে বিশাল সম্ভবনা দেখি। সরকার যদি রফতানির ক্ষেত্রে বিদ্যামান সমস্যাগুলো দূর করে নীতিগত সহায়তা দেয়, তাহলে এই খাত গার্মেন্টসকেও পেছনে ফেলে দেবে।’

এ বিষয়ে রফতানিকারক ও দ্বীপ ইন্টান্যাশনালের মালিক পরিতোষ চন্দ্র দাসের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। প্রায় ৩২ বছর ধরে এই ব্যবসায় যুক্ত। বাংলাদেশ বর্তমানে সবজি উৎপাদনের দিক দিয়ে তিন নম্বরে রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ রফতানি হচ্ছে দেখে কৃষকরা এত উৎপাদন করছেন। তা না হলে শুধু দেশের বাজারের জন্য এত সবজি উৎপাদন করতেন না কৃষকরা। কারণ তারা সেই দাম পেতেন না। এতে করে একটি পচনশীল পণ্য বিদেশে রফতানি করে আমরাও ডলার আনছি, আর কৃষকরাও ভালো দাম পাচ্ছেন।’

প্রতিনিয়ত রফতানি বাড়ছে উল্লেখ করে পরিতোষ চন্দ্র বলেন, ‘আমরা ২০১৫ সালে আম রফতানি করেছি ৯০০ টন। ২০১৬ সালে এটা নেমে ১৫০ টনে আসে, ২০১৭ সালে আবার বেড়ে হয় ২৫০ টন। আর চলতি বছরে আমারা প্রায় ৮০০ টন আম রফতানি করেছি। আমরা যে এক্ষেত্রে উন্নতি করছি, এটি তারই প্রমাণ। একইভাবে সবজির ক্ষেত্রে রফতানির পরিমাণও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে এক্ষেত্রে আরও ভালো করা যাবে। এর সম্ভবনাও বিশাল।’

বিজ্ঞাপন

কৃষি বিপণন অধিদফতরের (ডিএএম) উপপরিচালক ও রোডম্যাপ তৈরিতে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, ‘আমার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশে সবজি রফতানি করছি। সেই রফতানি বাড়ানোই আমাদের লক্ষ্য। গত বছর আমারা ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সবজি রফতানি করেছি। এখন আমাদের টার্গেট এর পরিমাণ বাড়ানো। এজন্য একটি স্বল্পমেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি করে কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। স্বল্প মেয়াদি রোডম্যাপ বলছি এই কারণে— এর আপাতত লক্ষ্য ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে যেন আমরা সবজি রফতানির পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘এই লক্ষ্য তখন পূরণ হবে যখন এই খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর চিহ্নিত করে তা সমাধান করা সম্ভব হবে। সেই সমস্যাগুলোকে আমারা এরই মধ্যে চিহ্নিত করেছি। সেসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করা সম্ভব তা প্রস্তাব আকারে রোডম্যাপে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষি বিপণন অধিদফতর (ডিএএম), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হর্টেক্স ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ ভাগ করে দেওয়া হবে। ডিএএম’র মহাপরিচালক বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। দেশে ফিরলেই এ বিষয়ে কাজ শুরু হবে।’

রাজু আহমেদ আরও বলেন, ‘আমাদের মাটিতে তো যা লাগাই, তাই হয়। এটাকে যদি একটু সিস্টেমের মধ্যে আনা যায়, তাহলে গার্মেন্টস শিল্পকেও ছাড়িয়ে যাবে এই খাত (সবজি রফতানি)। এই বিষয়টি আমরা সবাই বুঝি এবং জানি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নির্দেশনা দিয়েছেন। স্যারও কিন্তু নির্দেশনা মতো এ বিষয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের নানা চ্যালেঞ্জ আছে। সেগুলো তো একবারে মোকাবিলা করা সম্ভব না। তবে এটি বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভবনাময় একটি ক্ষেত্র। আমাদের দেশে পণ্য উৎপাদন হবে, আমার দেশের লোক কাজ করবে। আমাদের কৃষকরা ভালো দাম পাবে। আমাদের দেশের সবজির উৎপাদন বাড়বে।’

রোডম্যাপ প্রণয়নে এ বছরের মাঝামাঝি ডিএএম মহাপরিচালককে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে কৃষি মন্ত্রণালয়। ডিএই’র মহাপরিচালক বা প্রতিনিধি, বিএডিসি’র চেয়ারম্যান বা প্রতিনিধি, হর্টেক্স’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিএই’র প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইনের পরিচালক, বাংলাদেশ ফল ও সবজি রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশেনের (বিএফভিএপিইএ) সভাপতি বা প্রতিনিধিকেও এই কমিটিতে রাখা হয়। ডিএএম উপপরিচালক মোহাম্মদ রাজু আহমেদ এই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজু আহমেদ বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে— আমরা শুধু শ্রমিক দিচ্ছি। এই খাতের সব কাঁচামাল আমরা দেশের বাইরে থেকে আমদানি করছি। এখানে আমরা শুধু এখানে সস্তায় শ্রমিক দিচ্ছি। তবে তৈরি পোশাক শিল্পকেও আমি কোনোভাবে খাটো করে দেখছি না। কারণ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে এই পোশাকের অনেক বড় অবদান রয়েছে। কিন্তু এই একটি খাতের ওপর দেশের অর্থনীতি নির্ভর করতে পারে না। কারণ একটি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা থাকলে কোনো কারণে ওই খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে দেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে। এ ক্ষেত্রে আমরা সবজি রফতানিকে একটি বিকল্প রফতানি খাত হিসেবে মনে করছি।’

সারাবাংলা/এনএস/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন