বিজ্ঞাপন

ডা. মিলন বেঁচে থাকলে এখন কী করতেন

November 26, 2021 | 6:09 pm

হাসান আহমেদ

সে সময়ের তরুণ চিকিৎসক ডা. শামসুল হক মিলন কেন টার্গেট হয়েছিলেন? কারণ সরকারি দলে বারবার যোগ দেওয়ার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে কোনো পোস্টই ছিল না সেই রংপুরে তাকে বদলি করা হয়েছে। একবার চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তারপরও তিনি সরেননি আন্দোলনের পথ থেকে। জীবন দিয়ে হলেও প্রকৃত আপসহীন থেকেছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

আমাদের স্বাস্থ্যখাত যে নাজুক অবস্থা তা করোনা ভাইরাসের মহামারিকালে পরিষ্কার। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লড়াই আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। জনমুখী একটি জাতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার আন্দোলনে অগ্রবর্তীদের একজন ছিলেন ডা. শামসুল হক মিলন। তার আকাঙ্ক্ষিত সেই চিকিৎসা ব্যবস্থা কি গড়ে উঠেছে এই ৩১ বছরে? না, মহামারিকালের দুই বছরে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্য কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। এ সময় তিনি থাকলে কী ভূমিকা রাখতেন?

ডা. মিলন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রভাষক। রাজনীতি করতেন সমাজতন্ত্রের জন্য, জাসদের হয়ে, শ্রেণী বৈষম্যহীনতার জন্য। এরশাদ সরকারের তৈরি গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা ডা. মিলনে আত্মদানের ৩১ বছর পর স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান হাল দেখে আজ ডা. শামসুল হক মিলন কী করতেন? ভাবা যায়? ভাবে কি কেউ কখনো? দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আজ বেঁচে থাকলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা দেখে সবচেয়ে সরব থাকতেন হয়ত তিনিই।

তার একমাত্র কন্যা শামা বিজয় আলম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োতে চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে পড়ছেন। তিনি কি ফিরবেন বাবার স্বপ্নের বাস্তবায়নে নতুন লড়াইয়ের সূচনা করতে?

বিজ্ঞাপন

কবিতায় আছে তেত্রিশ বছর কেটে গেল কেউ কথা রাখেনি। যে বিষয়ে এই লেখার অবতারণা তার ৩১ বছর পার হবে আজ। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর। মাঝের দূরত্ব ৩১ বছর। আর দুই বছরের অপেক্ষার প্রয়োজন কী? বোঝাই যায়, কেউ কথা রাখেনি।

সেই যে তিন জোটের রূপরেখা! স্বৈরাচার ও সামরিক একনায়ক এরশাদকে হটাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থি ৫ দল মিলে রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা কী হবে তার একটি রূপরেখা তৈরি করেছিল—তা কি বাস্তবায়ন হয়েছিল?

তিন জোটের রূপরেখায় যে অঙ্গীকারনামা ছিল তার প্রথম ভঙ্গ শুরু হয় বিএনপির আচরণবিধি না মেনে এম কে আনোয়ারদের দলে টানার মধ্য দিয়ে। মূল বিশ্বাসঘাতকতা হয় বিএনপি জামাত জোট তৈরির সঙ্গে সঙ্গে। ডা. মিলনের রক্ত তখনই হাহাকার করে উঠেছে বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায়। তারপর ৩১ বছরে সেই হাহাকার এখন ছড়িয়ে গেছে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতায়। রাজনীতি ধর্মের পেটে সেঁধিয়ে যাওয়ায় হতাশা এখন ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মৃত্যুর আগে কোনো এক নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, দেশ আজ বাজিকরের দেশে পরিণত হয়েছে। খুব একটা কি পরিবর্তন হয়েছে সেসময় আর এ সময়ের পরিস্থিতির? একের পর এক ই-কমার্স কেলেঙ্কারি, ব্যাংকখাতে ঋণ কেলেঙ্কারি— এসব এর স্বপক্ষে সাক্ষ্য দেয় না।?

নব্বইয়ে ১৩ বছরের এক কিশোরের মনে আজো গেঁথে আছে ডা. মিলনের মৃত্যু দিন। প্রশ্ন উঠতে পারে কিশোরের স্মৃতিতে কিভাবে একজন মিলন সম্পৃক্ত হয়? হয়! হয়ে যায়! সত্যিকারের গণআন্দোলনের ঢেউয়ে সব কিছু ভেসে উঠতে বাধ্য। ২৮৩/৩, রায়েরবাজার বাংলা সড়ক। পঞ্চম তলার বাড়িতে সমাজবাদী আন্দোলনের নেতা সাংবাদিক নির্মল সেন থাকতেন আত্মগোপনে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কারণে। ৩২৬২৩৮—টিএন্ডটি ফোন নম্বরটি স্পষ্ট মনে আছে। বেজে উঠেছিল ফোন সেদিন সকাল ১১টায়। সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া কিশোরের খুব মনে আছে নির্মল সেনের সেই আর্তচিৎকার।

‘কি! মিলন নেই! কিভাবে?’

কিশোর অবাক হয়েছিল, নির্মল সেনকে কাঁদতে দেখে। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, মামা! কাঁদেন ক্যান? কী হইছে?’ কিশোরের মাথায় হাত রেখে একজন নির্মল সেন বলেন, ‘মিলন মরে গ্যাছে!’ কিশোর সুধায় তারে, ‘মিলন কে?’ তিনি মাথায় হাত রেখে বলেন কিশোরকে, ‘বড় হয়ে বুঝবি!’ বলে ঝট করে বের হয়ে গেছিলেন। সাদা পাঞ্জাবি পরে।

বিজ্ঞাপন

এখন বোঝে সেদিনের সেই কিশোর আর ৩১ বছর পর হয়ে ওঠা মাঝ বয়সী যুবক—মিলন কে? এখন বোঝে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের জন্য স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে জীবন বিলিয়ে দেয়া বীর সে। যার নিঝুম স্থাপত্য ঘিরে আজ কেবলই দীর্ঘশ্বাসের বাতাস ঘুরে বেড়ায়।

ডা. মিলনের নিহত হওয়ার সন্ধ্যাতেই রমনা থানায় মামলা হয়েছিল। শাহবাগ থানা তৈরি হয়নি তখনো। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি আদালত চার্জ গঠন করেন। তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুল করিম ৩১ জনকে সাক্ষী করে চার্জশিট দেন। কিন্তু আদালত ১৪ জন সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়।

তারপর, ৩১ বছর পর দেখা যায়, তার কোনো হত্যাকারী নেই। কারো কোনো শাস্তি হয়নি। শুধু একজনকে অবৈধ অস্ত্র রাখার জন্য এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গুলিটা করল কে? ডা. মিলন হত্যার ৩১ বছর পরেও চিহ্নিত করা গেল না! শাস্তি দেওয়া হল না! নিঝুম স্থাপত্যের চারপাশে কষ্টরা গুমরে মরে। ১৯৯২ সালে বিচারিক আদালতে মিলন হত্যা মামলার রায় দেওয়ার পর অ্যাডভোকেট শামসুল হক চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি) মামলাটির পুনঃতদন্ত ও পুনঃবিচারের আবেদন করেছিলেন। তার ফলাফল আজো নেই। আদালত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এর খোঁজ কি নিতে পারেন না? তাতে হয়তো বেরিয়ে আসবে, ৯০ এর শেষ দিকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের জন্য বরাদ্দ করা গুলির বড় অংশ কেনো হারিয়ে গেল? কোথায় হারাল? কোন কাজে ব্যবহার হলো?

শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘গুলিবিদ্ধ শহর করছে অবিরাম অশ্রুপাত। কেন না মিলন নেই।’ সেই অশ্রুপাত ৩১ বছরেও থামল কি! ডা. মিলন বদ্ধ ঘরে থাকতে অপছন্দ করতেন। তার ডায়েরিতে লেখা কবিতা তাকে মনে করিয়ে দেয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘গভীর রাতে তখন, দেখতে পাবে আমার লাশ।/ আমার জ্যোতির্ময় লাশ/ তোমার হৃদয় ঘিরে খেলা করছে।’

৩১ বছরে অনেকটাই মলিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিঝুম স্থাপত্যের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় তিনি যেনো প্রশ্ন করছেন লাভ কি হলো বলতো এই সাধের জীবনটা বিলিয়ে দিয়ে? এই সামনে না থেকেও এমন প্রশ্ন যার তিনি ঢলে পড়েছিলেন রিকশায় চলতে চলতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনের রাস্তায়। নাম তার মিলন। গণতন্ত্রের জন্য শহীদ ডা. শামসুল হক মিলন। সত্যিকারের গণতন্ত্র সেদিনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন তার হত্যাকারীর খোঁজ মিলবে ও শাস্তি হবে। আর তার জীবন বিসর্জন সার্থক হবে যখন গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে দেশজুড়ে।

লেখক: সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন