বিজ্ঞাপন

পুরুষতন্ত্রের আদিম চাল- নারীর আত্মত্যাগ!

December 14, 2017 | 11:17 am

একটা শর্টফিল্ম দেখলাম গতকাল ‘Juice’ নামে। ঘটনাটি এরকম- বাসায় পুরুষ কলিগ-বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছেন গৃহকর্তা। বেশ হাসিতামশা চলছে। অফিসের নারীবসকে নিয়ে রঙ্গ চলছে যে তিনি কিছুই পারেন না, সব অধস্তন পুরুষ কলিগটির বুঝিয়ে দেয়া লাগে। ভেতর থেকে একের পর এক খাবার সার্ভ করা হচ্ছে। একজন বন্ধু ঢুকলেন গর্ভবতী স্ত্রীসমেত। চাকরিজীবী স্ত্রীকে কটাক্ষ করে বললেন- ‘এমনিতে তো রান্নাবান্না পারো না, এখন ভাবীদের সাথে একটু রান্নাঘরে যাও।’ ক্যামেরা গেলো এবার রান্নাঘরের দিকে। সব স্ত্রীরা সেখানে জমায়েত হয়েছেন রান্নাবান্নার কাজের জন্য। গৃহকর্ত্রীকে সবাই জানালো রান্নাঘরে প্রচুর গরম। তিনি পুরান একটা টেবিল ফ্যান নিয়ে এলেন। এর মাঝেই কথা চলতে থাকে বাচ্চা লালনপালন, বাচ্চা জন্মের পর চাকরি থেকে বিদায় নেয়া, মায়ের/স্ত্রীর স্যাক্রিফাইস নিয়ে। ফ্যান নষ্ট বলে গৃহকর্তাকে ডেকেও যখন পান না তখন গৃহকর্ত্রী ব্যথিত হন। উল্লেখ্য তিনি সন্তান সংসারের জন্য চাকরি, ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন। আত্মপলব্ধির এক পর্যায়ে তিনি এক গ্লাস জুস আর একটা চেয়ার নিয়ে ঘর্মাক্ত অবস্থায় ড্রয়িং রুমে যেখানে স্বামী ও তার পুরুষবন্ধুরা বসে খোশগল্প করছিলেন সেখানে গিয়ে বসে পড়েন। ফিল্মটির এন্ডিং এখানেই।
ফিল্মটির মাঝে বেশ কিছু মেসেজ আছে। এর মাঝে একটি হলো ঘরের কাজ নারীর এবং সংসার সন্তান সামলাতে নিজের ক্যারিয়ার ছাড় দেয়াটাই স্বাভাবিক। মানে দাঁড়ায় – ক্যারিয়ার বা চাকুরি নারীর জন্য অপশনাল আর সংসার ম্যান্ডেটরি। সন্তান সংসারের জন্য স্যাক্রিফাইস করতে হবে তাকেই কেননা এটাই তার মৌলিক চাহিদার মত মৌলিক বা বেসিক দায়িত্ব। অথচ রি-প্রোডাক্টিভ কাজের মধ্যে সন্তান গর্ভধারণ, জন্মদান, স্তন্যপান ব্যতীত বাদবাকী কোন কাজই প্রাকৃতিকভাবে নারীর ওপর বর্তায় না। কিন্তু এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীকে বন্দী করবার উপায় হিসেবে তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিলো গৃহকর্মের বোঝা, যে বোঝা একবিংশ শতকেও আমরা নামাতে পারিনি। পুঁজিবাদ যদিও বা নারীকে অর্থনীতিতে যুক্ত করলো তবু এ বোঝা লাঘব হলো না। বরং নারীর ওপর ডাবল বার্ডেন দেয়া হলো।
আত্মনির্ভরশীল নারী যারা আছেন তারা জানেন তাদের এ যাত্রাপথ সুগম ছিলো না। আমার স্কুলজীবনের বন্ধু রিয়া (ছদ্মনাম) বিয়ে করে কলেজ জীবনে। পড়াশোনা চালিয়ে গেছে, চাকরিও করতো। এরপর স্বামীর বদলি চাকরিতে সেও চাকরি ছেড়ে স্বামীর সাথে বদলি হয়ে গেলো মফস্বলে। চাকরি আর করা হলো না।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জুনিয়র কোন এক ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ছিলো। শুনলাম সে স্বামীর সাথে এক অজপাড়া গাঁয়ে পড়ে আছে, চাকরি করতে হলে আলাদা থাকতে হবে এটা সম্ভব না। আমি ওর কথা শুনে অবাক হবার সাথে সাথে রাগে দুঃখে কেঁদে দিয়েছি। এভাবে নারীর সম্ভাবনাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে!
আপনারা কেউ শুনেছেন স্ত্রীর চাকরির জন্য কোন স্বামী নিজের চাকরি বিসর্জন দিয়েছেন? কিংবা সন্তান-সংসারের জন্য স্যাক্রিফাইস করে চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে আছেন ঘরকন্না করবার জন্য?
এটা হবারই নয়! যদি বা ঘটে তবে তা অনুপাতে এতই কম যে ওর ওজন দাঁড়িপাল্লায় মাপবার মতই না। কিন্তু নারীটির জন্য এটা যেনো এক অদৃশ্য নিয়ম, অদৃশ্য আইন। ঐ যে উপরে বললাম- ভাবা হচ্ছে গৃহকর্ম, সংসার, সন্তান দেখভাল নারীর জন্য ম্যান্ডেটরি আর অন্যদিকে চাকরি, ক্যারিয়ার, পড়াশোনা অপশনাল। দয়া করে দিলে করতে হবে, নিষেধ করলে ছেড়েছুড়ে সব বিসর্জন দিয়ে পাট হয়ে বসতে হবে ঘরকন্নার কাজে।
নারীর বাইরের কাজ বা অর্থনীতিতে সম্পৃক্ততাকে অপশনাল হিসেবে দেখবার বড় কারন কয়েকটি গুরুতর ভাবনা- নারীর দায়িত্ব পুরুষের/ নারী পুরুষের অধঃস্তন/ নারীকে পুরুষের জন্য তৈরি করা হয়েছে/ নারীর ভরণপোষণ পুরুষের দায়িত্ব/ নারী পুরুষের সেবা করবার নিমিত্তে সৃষ্টি ইত্যাদি। এসব কথা কোন নারী তার একজীবনে একবারও শোনেননি এটা অকল্পনীয়, আর প্রতিনিয়ত শোনেন এরকম নারীদের হাত তুলতে বললে অনুপাত হতে পারে দশে নয়। এই পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা থেকেই উৎসারিত হয় নারীর কাজের ধরণ, নারীর আত্মত্যাগের ধরণ। যেখানে আবার নারীর আত্মত্যাগকে মহানও করা হয়েছে।
নারীকে আত্মত্যাগের গরিমায় মহান করেছে পিতৃতন্ত্র। পিতৃতন্ত্রের এ মহানুভবতায় গলেও গিয়েছেন অনেক নারী! অথচ পিতৃতন্ত্রের এ লোকদেখানো মহানুভবতা স্রেফ একটা হ্যালুসিনেশন, এ নারীর জন্য ইলুশ্যন ব্যতীত কিছু নয়! কেননা নারী এই মুহুর্তে বাইরে বের হতে চাক, কাজ করতে চাক, নিজের মত বাঁচতে চাক, স্বাধীনতার স্বাদ চাক, প্রতিবাদ করুক, স্যাক্রিফাইসের বস্তাটা কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলতে চাক দেখবে কিভাবে পিতৃতন্ত্র তার দিকে তেড়ে আসে! পিতৃতন্ত্র তার মহানুভবতার মুখোশ খুলে দেখাবে আসল চেহারা।

বিজ্ঞাপন

‘নারী মানে আত্মত্যাগী’ দয়া করে এ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসো নারীরা। তোমার বাধ্যতামূলক কাজ ঘরের কাজ নয়, বরং তোমার বাধ্যতামূলক কাজ নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করা, নিজেকে স্বাধীন করা। তোমার বাধ্যতামূলক কাজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজের বক্তব্যকে প্যাসিভ না রেখে স্পষ্ট করা। যেখানে তুমি জোড়ালো গলায় বলবে- আত্মত্যাগী হয়ে জীবনত্যাগী হতে চাই না। আমি জীবনকে উপভোগ করতে চাই আমার মত। পুরুষের চোখে আর বিশ্ব দেখতে চাই না। আমার দুটো চোখ আছে হে মানবসভ্যতা। আমি পূর্ণমানুষ! আমি পুরুষের অধঃস্তন না হয়ে সঙ্গী হতে চাই যেখানে ভালোবাসা সমানে সমান, কর্ম-জ্ঞান-গরিমা সমানে সমান, আত্মত্যাগ সমানে সমান।

 

সারাবাংলা/ এসএস

বিজ্ঞাপন

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন