বিজ্ঞাপন

পঞ্চাশের বাংলাদেশ: নারী স্বত্ত্বা ও স্বাধীনতা

December 15, 2021 | 11:07 pm

হাসনে আরা ডালিয়া

মানুষের বেড়ে ওঠা, জীবন অভিজ্ঞতা এবং তার ভাবনার জগত ব্যক্তি বিশেষে বৈচিত্রতায় ভরা। যা অনেকাংশেই তার পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ-সংস্কৃতি, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তার পরও কোনও কোনও মানুষ এই সমস্টিক সমাজ-স্ংস্কৃতির বাইরে ভিন্ন সত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। খুব কম বয়সেই ডারউইনের ‘সারভাইভেল অফ দা ফিটেষ্ট’ দারুণভাবে ভাবিয়ে তোলে। একটু বড় হয়ে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করি: এই সমাজ নারীকে নারী ও পুরুষকে পুরুষ হয়ে উঠতে বাধ্য করে। কিন্ত জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই অনুধাবন করতে শুরু করি পরিবার ও সমাজের কাঙ্ক্ষিত নারী আমি হয়ে উঠতে পারিনি। যা আমি কখনো হতেও চাইনি।

বিজ্ঞাপন

মায়ের মুখে কতবার যে শুনেছি যুদ্ধে তাদের বেঁচে যাওয়ার গল্প। আমার বয়স তখন কয়েক মাস। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বাবা মুক্তিযুদ্ধে। মা আমাদের দুইবোনকে নিয়ে নৌকায় করে দাদাবাড়ি থেকে নানা বাড়ি এসেছেন নিরাপদ থাকবেন বলে। নানা বাড়ি অনেক বড়, যৌথ পরিবার। বাড়ির তিনদিকে তিনটে পুকুর। তার একটিকে বলতো দিঘি। এপারে দাঁড়ালে ওপারে দেখা যায় না। বিশাল চাষাবাদ থাকায় ঘর-গৃহস্থালী সবসময় মানুষে গমগম করে। মা বলতেন প্রতিদিন আধামন চালের ভাত রান্না হতো। বাড়ির মা-বৌ-মেয়েদের কাজ ভাগ করা ছিল। যিনি সবজি কাটতেন তার দায়িত্ব ছিল কেবল সবজি কাটা। এভাবে কেউ মাছ, কেউ মশলা বাটা, কেউ পরিচ্ছন্নতার কাজ, কেউ খাবার পরিবেশন করতেন। প্রতিদিন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন জন মানুষ খাওয়ার শেষে বাড়ির মহিলাদের খাওয়া। নানা বাড়ি পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনে হঠাৎ একজন খবর দিল, নদীর ঘাঁটে পাক আর্মিদের ট্রলার দেখা গেছে। বাড়ির বৌ-ঝি সবাইকে বলা হলো বাড়ির পেছনে দূরে জঙ্গলে বাচ্চাসহ চলে যেতে। বয়স্ক মহিলা ছাড়া সবাই পেছনের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকলেন প্রায় কয়েক ঘন্টা। তাদের সেই কি আতঙ্ক! এ যাত্রায় প্রাণ বাচঁবে কিনা! সম্ভ্রম রক্ষা হবে তো! নানান ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় মহিলাদের প্রাণ যায় যায়।

মায়ের মামা ছিলেন স্কুল মাস্টার। সবাই ডাকতেন পন্ডিত। মা ডাকতেন পন্ডিত মামা। ওনার মাথায় নাকি অসম্ভব বুদ্ধি। পাকিস্তানি আর্মি ঘাটে এসেছে শুনে তিনি তাড়াতাড়ি করে ঘাটে পৌঁছে গেলেন। পন্ডিত নানা ইংরেজি ও উর্দুতে কথা বলতে পারতেন। ওদের সাথে নানান কথাবার্তা বলতে বলতে বিভিন্ন মজাদার খাবারের আয়োজন করলেন। আর্মিদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের বাড়ির দরজায় বিরাট মসজিদ সুতরাং গ্রামের সবাই খুবই ধর্মপ্রাণ। এই গ্রামে কোনও মুক্তিযোদ্ধা নেই। দেশ স্বাধীন হলে বাবা ফিরে আসলেন। নতুন দেশ। নতুন স্বপ্ন।

ছোট বেলায় স্কুল ছুটি হলে বছরে অন্তত একবার দাদা বাড়ি যেতাম। গ্রামে একটা জিনিস খুব মনে প্রশ্ন তৈরি করতো। মহিলাদের বেড়াতে যাওযার দৃশ্য। মোটামুটি কাছে হলে পায়ে হেঁটে যাওয়া। বোরকা পরা আবার সামনে ছাতা ধরা। দূরের পথ হলে রিকশা, পালকি অথবা নৌকা। ভেতরে মহিলারা বোরকা পরা হলেও বাইরে একটা বড় শাড়ি দিয়ে প্যাঁচানো থাকতো। কিছুতেই বুঝতে পারতাম না এরা দেখে কীভাবে। দাদা বাড়ির কাছেই অনেকগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ছিল। প্রায়ই ঐ বাড়িগুলোতে বেড়াতে যেতাম। কেমন যেন অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করতো। শাঁখের আওয়াজ, পূজা, প্রসাদ, ঢাকের শব্দ। ১৯৯০ সালে সারাদেশে দাঙ্গা। আমাদের জেলা শহরে বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ী, কাপড়ের এবং স্বর্ণের দোকানের মালিক ছিল হিন্দু। ব্যাপক লুটপাট, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও হল। বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। মেয়েদের নির্যাতন করা হলো, ধর্ষণ করা হলো।

বিজ্ঞাপন

গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে দমনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র নারীদের অসম্মান এবং তাদের সম্ভ্রমে আঘাত করা। মানুষকে ভয় দেখানো, ভিটে ছাড়া করা, অন্যের সম্পদ দখল করার অথবা দেশ ছাড়া কারার সবচেয়ে সহজ কৌশল। ছোটবেলার অতিচেনা হিন্দু বাড়িগুলো একে একে কমতে থাকলো। একসময় সবই ম্লান হতে লাগলো। সেই গমগমে বাড়িগুলো, প্রাণহীন নিঃশব্দ হতে থাকলো ধীরে ধীরে। তখন বুঝতাম না কেন ওদের জন্য আমার এতো কষ্ট হতো। একটু বোঝার বয়স যখন হয়েছে তখন অনুধাবন করলাম। এতো মাতৃভূমি থেকে উৎখাত। শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা। একবার, তখন স্কুলে পড়ি। লঞ্চে ঢাকায় আসছি। মুখ ঢাকা সাদা থান কাপড় পরা এক বিধবা নারী। লঞ্চে আমাদের কেবিনের সামনে বাইরের ডেকে বসে মুখ ঢেকে সারাক্ষণ গুনগুন করে কাঁদছে। কোন দুঃসংবাদ বা বিপদ আপদ হবে হয়তো। না হলে মহিলা একভাবে কেঁদে যাচ্ছেন কেন। এক লোক একটু পর পর এসে ধমক দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম মহিলার হয়তো আত্মীয়। এক পর্যায়ে শুনলাম লোকটা বলছে ভিটা মাটির জন্য তো টাকা দিয়েছি। মুখ বন্ধ না হলে টুকরা টুকরা করে নদীতে ফেলে দেব। ভাবলাম লোকটা বলে কি! এই মহিলাকে এমন ভয় দেখাচ্ছে কেন? বয়সটা এত কম ছিল সাহস করে কোন প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করতে পারিনি সেদিন। বড়দের বিষয়টি দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করলাম কিস্তু তারা কোনও ঝামেলায় জড়াতে চাননি। আজও মহিলার সেই করুণ কান্না কানে ভাসে।

আমার ছোট বেলার শিশুমনের সেই যন্ত্রণা, এই মধ্যবয়সেও ভুলতে পারিনি। কোনও মানুষের দেশত্যাগের কথা শুনলে আজও ভেতরটা আঁৎকে ওঠে। কেঁপে ওঠে। হাহাকার করে। পরবর্তীতে, চাকুরিকালীন সময়ে সুযোগ হলো বম্বের টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোস্যাল সাইন্সেস-এ পড়ার। সেখানে পিএইচডি করছে কলকাতার এক বাঙালি মেয়ের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব হলো। ওর বাবা বোম্বেতে বড় বিজ্ঞানী ছিলেন। প্রায়ই আমাকে বন্ধু খোঁচা দিয়ে বলতো: এই বাংলাদেশের মেয়ে, আমার বাবা-মা তো সারাক্ষণ খুলনা আর বরিশালের গল্প করে। তাদের ছোট বেলা- নদী, নৌকা, মাঠ, পুকুর, মাছ। তাদের জমিদারী, প্রভাব প্রতিপত্তি সব ফেলে রাতারাতি পালিয়ে আসতে হয়েছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। কলকাতায় এসে সেই দীর্ঘ জীবনযুদ্ধ। সারাদিন মানুষের বাসায় ছাত্র পড়াতেন, আর অপেক্ষা করতেন কখন এক কাপ চা আর সাথে দুটো বিস্কুট আসবে। বন্ধু বলতো: বাবা-মা’র এসব গল্প শুনলে খুব রাগ হয়, যে দেশ তাদের রাখলো না, শুধু হাত-পা নিয়ে তাড়িয়েছে, সে দেশের জন্য এত মায়া কেন। এখনও দেশ দেশ করছো।

একবার বম্বে থেকে কলকাতায় আসছি ট্রেনে। বন্ধুর সাথে ওদের কলকাতার বাড়িতে বেড়াতে। পথে এক স্টেশনে ট্রেন থামবে ২০ মিনিটের জন্য। আমাকে বললো- ওর এক পিসি আসছে দেখা করতে আর আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছে। ট্রেন থামলো। দেখলাম আমাদের বগিতে জানালার পাশে এসে দাড়ালেন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা এবং বৃদ্ধ। বন্ধু আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। নীল শাড়িপরা, কপালে মাঝারি খয়েরি টিপ, সুন্দর ছিপছিপে চেহারা। আমার হাতের উপর হাত রাখলেন। প্রথম কথা- ‘আমার দেশের মেয়ে’। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। পিসি আমার সমস্ত হাত এভাবে ছুঁয়ে দেখছিলেন মনে হচ্ছিল উনি আমাকে না, বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মাটিকে ছুঁয়ে দেখছেন। আমার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কোনভাবে নিজেকে সামলে নিলাম। মনে হলো অতি আপনজন, আমার খুব চেনা এবং কাছের। পিসি খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চাচ্ছিলেন, বাংলাদেশ এখন কেমন? রাস্তাঘাট, মানুষ কি এখনও নৌকায় যাতাযাত করে? এখনও কি ইলিশ পাওয়া যায়? জীবন-যাপনে সব কি পরিবর্তন হয়ে গেছে? স্টেশনে ঘন্টা বাজলো। ট্রেন আবার ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। একটি হাত আমার হাতের উপর থেকে আস্তে আস্তে সরে গেল। মনে হলো একটি মর্মস্পর্শী ছোঁয়া অনেক দূরে সরে গেল। যতদূর দেখা গেল দেখলাম পিসি তাকিয়ে আছেন। দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, কিছুতেই সংযত করতে পারছিনা। জানিনা জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে কিনা। আমার মনে হলো খুব আপন কাউকে ফেলে যাচ্ছি। পরের ধাক্কা খেলাম বন্ধুর বাসায় পৌঁছে। শুভ্র, বনেদি, খুবই স্মার্ট মাসিমাকে দেখে। এত সুন্দর মানুষ জীবনে কম দেখেছি। আমাকে দেখেই বললেন: ডালিয়া আইসো, তুমি ফ্রেস হইয়া আসো, খাবার দিতাছি। আমি অবাক। মাসিমা বরিশালের টোনে কথা বলছে! আমাকে প্রথম দেখায়ই মেয়ের মতো আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছিলেন। আমি যে ক’দিন ছিলাম খুটিয়ে খুটিয়ে কত কথা যে জানতে চাইতো। দেশে এখনও রাজাকার আছে কিনা? দেশের এতো পরিবর্তন! অনুভব করতে পারতাম মাসিমা মনে মনে খুব খুশি হতেন। এরপর মাসিমার সাথে জীবনে অনেকবার দেখা হয়েছে। মনে হচ্ছিল একটা যোগসূত্র খুঁজছিলেন- মৃত্যুর আগে একবার বাংলাদেশে আসার। মনে মনে হাহাকার। যতবারই দেখা হতো দুজনে পরিকল্পনা করতাম। মাসিমা বাংলাদেশে আসলে কোথায় কোথায় নিয়ে যাবো। মনে শঙ্কা ছিল, এতো কিছু কি দেখতে পারবেন, শরীরে কুলাবে? তবে বরিশাল তার যেতেই হবে। বরিশালে মাসিমাদের বাড়ির পাশের ছোট্ট নদীতে দশ বছর বয়সে নৌকায় বেড়ানোর গল্প আমাকে অনেক বার শুনিয়েছেন। মাসিমার বরিশালে যাওয়া হয়নি কিন্তু পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে চলে গেছেন। বাংলাদেশের মাটিঁ আর ছোঁয়া হলো না। এভাবে, অনেকেই সারাজীবনের অভিমান, আক্ষেপ, আকাক্সক্ষা নিয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে একে একে চলে গেছেন। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো এই অনুশোচনা থেকে মুক্তি পাব না।

বিজ্ঞাপন

১৯৯৭-৯৮ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাশ করে সবচেয়ে বড় একটি এনজিও’তে জেন্ডার গবেষণা কাজে শিক্ষানবীশ হিসেবে যোগদান করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও ছাত্র রাজনীতি করিনি কিন্ত মার্কসবাদ দ্বারা সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। সরকারি চাকুরিতে শুধু নিজের আখের গোছানো এবং সরকারি তাবেদারই হতে বাধ্য করবে। তাই সরকারি চাকুরির প্রতি বিরূপ মনোভাব। বাবার ইচ্ছেয় বিসিএস প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে যাইনি। স্বপ্ন দেখেছি এনজিও’ই হবে সমাজ বিপ্লবের মূলমন্ত্র। সমাজে নারীদের স্বাধীনতা, পশ্চাদপদতা, অত্যাচার, নিপীড়নে মুক্তির সোপান। নারীর ক্ষমতায়নের যাত্রাপথ তৈরি করবে এনজিও। তৎকালীন প্রচুর বাম নেতা তখন এনজিও’র নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশে তখন এনজিও এবং নারী অধিকার আন্দোলন খুবই সক্রিয়। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম মৌলবাদী গোষ্ঠীর এনজিও বিষয়ে গাত্রদাহ। কারণ এনজিও’রা সারাদেশে গ্রামে গঞ্জে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের নষ্ট করছে। তাদের ঘর থেকে বের করছে। অন্য দশজন নারী-পুরুষের সাথে বসে মিটিং করছে, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এনজিও’র ভাই ও আপাদের সাথে দেখা করছে। ফোরামে কথা বলছে। তাদের বেপর্দা ও বেদায়িতি পথে নিয়ে যাচ্ছে। কঠিন এক্সসাইটমেন্ট নিয়ে বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছি। নারীর দৈনন্দিন কাজের চাপ এবং বিভিন্ন সম্পদে তাদের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে গবেষণার কাজে। প্রথম নিজ জেলা ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মানুষের জীবনধারা দেখার সুযোগ হলো। টিম করে যেতাম। সারাদিন কাজ, রাতে আড্ডা, গান-বাজনা। পরদিন আবার ফ্রেস, উদ্যোম এবং উদ্দীপ্ত মনে কাজ করা।

একবার কুড়িগ্রাম গিয়েছি কিশোরী মেয়েদের জীবনধারা নিয়ে একটি গবেষণার কাজে। একজন অভিভাবক প্রশ্ন করলেন- কদ্দুর পড়াশুনা করেছি? বেতন কতো পাই? বিয়ে-শাদী করলে তো গ্রামে গ্রামে ঘুরে এত কষ্ট করতে হতো না। তখন কুড়িগ্রামে মোটামুটি দশ থেকে বার বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। কারণ বাবার বাড়িতে যদি মেয়েদের ঋতুস্রাব হয় তবে সেটা মহাপাপ। অভিভাবককে দোজখের আগুনে পুড়তে হবে। এছাড়া মেয়ের বয়স যত বাড়বে, যৌতুকও তত বাড়বে। এই যৌতুক দেওয়ার ব্যাপারটির সাথে মেয়েদের শিক্ষার কোনও সম্পর্ক না থাকলেও ছেলেরা শিক্ষিত হলে দাম চড়তে থাকে। প্রাইমারি পাস, ক্লাস এইট কিংবা দশম শ্রেণি পাস মেয়েকেও লেখাপড়া না জানা অথবা মেয়ের চেয়ে অনেক কম লেখাপড়া জানা ছেলের সাথে বিয়ে দেয়।

হিসেবটা আশির দশকে একটি দরিদ্র পরিবারের জন্য এমন ছিল, যদি বর শিক্ষিত না হয় তবে দশ থেকে বিশ হাজার টাকায় দফারফা। এক্ষেত্রে সামর্থ্য না থাকলে বাবা মাকে- আত্মীয়-পরিজন ও গ্রামে সাহায্য চেয়ে অথবা চাঁদা তুলে দিতে হতো। মাধ্যমিক অথবা উচ্চমাধ্যমিক পাশ হলে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা। চাকুরিজীবী শিক্ষিত ছেলের লাখ টাকার সাথে ঘড়ি, সোনার আংটি, মোটর সাইকেল। এলাহি ব্যাপার। বিয়ের নামে মেয়েদের বেঁচাকেনার দারুণ ব্যবস্থা। একসময় পৃথিবীতে দাসপ্রথা ছিল। মানুষকে হাঁটে নিয়ে আসা হতো বিক্রির জন্য। সেখান থেকে পছন্দমতো দেখে শুনে কিনে নেওয়া। বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায় দেখেছি বছর চুক্তি কামিন থাকা। পুরুষ ও নারী উভয়ে ধান, চাল বা টাকার বিনিময়ে কামিন চুক্তিতে কাজ করতো। গ্রামের এই শিশু মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারটি আমার কাছে সেইরকম একটি বিনিময় প্রথা মনে হয়েছিল। বাবা-মা শিশু মেয়েটিকে বিয়ের মাধ্যমে অন্য একটি লোকের হাতে তুলে দিচ্ছে। সে খাবার ও অন্যান্য ভরণপোষণ দেবে, বিনিময়ে মেয়েটি ঘর-গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ, অন্যদের সেবা , মাঠের কাজ এবং পুরুষের যৌন চাহিদা মেটাবে। অথচ মেয়েটি এগুলোর কোনও কিছুর জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযুক্ত নয়। যুগ যুগ ধরে এই সামাজিক প্রথা চলে এসেছে। আজকে হয়তো মেয়েদের বিয়ের বয়স নয় দশ থেকে বেড়ে চৌদ্দ অথবা পনের বছর হয়েছে। বিষয়টি হচ্ছে সামাজিক প্রাধান্য। স্ত্রীর বয়স কম মানে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে সুবিধা। যদিও বাংলাদেশে যৌতুক নিরোধ আইন প্রনয়ণ করা হয়েছে কিন্তু এখনও যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া তার নিজস্ব গতিতেই চলছে। ধনিক শ্রেণি একে উপহার হিসেবে জায়েজ করছে আর সামর্থ্যহীন বাবা-মা সর্বস্ব দিয়ে অথবা সর্বশান্ত হয়ে যৌতুক নামক শোষণের মহান প্রথা আজও চালু রেখেছেন।

সেইবার কুড়িগ্রাম জেলার পাটগ্রামে কয়েকজন মেয়ের সাথে কথা বলেছিলাম। যাদের বয়স দশ থেকে পনের কি ষোল হবে। এদের কেউ কেউ তালাকপ্রাপ্ত হয়ে বাবার বাড়ি ফেরত এসেছে। কারও ইতিমধ্যে দুই তিনবার বিয়ে হয়েছে। একজন পেলাম কয়েক মাসের সন্তানসম্ভাবা, আরেকজনের কোলে কয়েক মাসের সন্তান। ওখানে দেখলাম বহুবিবাহ কোন সমস্যা না। একজন লোক কয়েকটি বউ রাখে সুপরিকল্পিতভাবেই। বউরা কেউ ঘর গৃহস্থালির কাজ করে আবার কেউ কেউ দিনমজুর অথবা পাথর তোলার কাজ করে। এতে লোকটার ব্যক্তিগত ও আর্থিক দুটোই লাভ। আবার দিনশেষে যে স্ত্রীর সাথে মন চায় রাত কাটাতে পারে, যা খুবই সমাজসিদ্ধ। একজন পেলাম কয়েক মাস বিয়ে হয়েছে কিন্তু বাবা-মা কোনভাবেই তাকে জোর করে আর ফেরত পাঠাতে পারছে না। খুবই দরিদ্র পরিবার। বাবা-মা দিনমজুর। পাথর কুড়ানোর কাজ করে। মেয়েটির সাথে একা কথা বললাম। বয়স এগারো কি বার হবে। চোখে মুখে আতঙ্ক, চোখ বসে গেছে। ওর বিয়ে হয়েছে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের সাথে যার আগের স্ত্রী মারা গেছে। জানতে চাইলাম কেন সে স্বামীর বাড়ি যেতে চায় না? মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো, উত্তর দিচ্ছে না । মাথায় হাত রেখে বললাম, কি অসুবিধা আমাকে বলো? মেয়েটি খুব মৃদু স্বরে বলল: লোকটাকে ভয় লাগে। প্রতিদিন রাত হলেই ওর ভয়ে গা কাঁপতে থাকে। আর কোনও কথা ওর সাথে আগাতে পারলাম না। বললাম: তুমি ভয় পেওনা। আমি বাবা-মায়ের সাথে কথা বলব। আসার সময় ওর মাকে বলে আসলাম: মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে আপনাদের ওর কথা শুনতে হবে। জানিনা শেষ পর্যন্ত ঐ মেয়েটির পরিণতি কি হয়েছিল। কিন্তু একটি বিষয় এখনও নিশ্চিত জানি- পয়ত্রিশ বছরের পুরুষ আজও চৌদ্দ বছরের মেয়েকে বিয়ে করছে। বিয়ের একমাসের মধ্যে প্রতিদিনের রক্তক্ষরণে অকালে করুণ মৃত্যুবরণও করছে। আইন-আদালত-এনজিও সবই আছে। মেয়েরা শিক্ষায় অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু সারাদেশের মেয়েদের জীবন পাটগ্রাম থেকে এখনও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।

বিজ্ঞাপন

জীবনাদর্শ আর বোধ কখন যে পেশাগত সংগ্রামের সাথে একাকার হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। তাই জীবনে প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নারীমুক্তি আন্দোলনে সবসময় সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছি। মাঠ ময়দানে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছি। শুরুটা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এনজিও সমাবেশ থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পীর এনজিওদের কর্মকান্ডে, বিশেষ করে নারীদের সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ অনেকটা জিহাদ ঘোষণা করে। অন্যদিকে এনজিওরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ঢাকা অফিস থেকে আমরা কয়েকটি মাইক্রোবাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছালাম। আমাদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল সমাবেশ শেষ হলে গাড়ি কোথায় থাকবে। আমরা সবাই যথাসময়ে এসে গাড়িতে উঠবো। ঐ সমাবেশে দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ কর্মী এবং এনজিও’র কমিউনিটি সদস্যরা যোগ দেন। সভার এক পর্যায়ে বোমার শব্দ, গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করলো। চিৎকার আর কান্নার শব্দে চারিদিক ভারী হয়ে উঠলো। হাজার হাজার আলখেল্লা পরা বাচ্চা-বুড়া হুজুর, হাতে লাঠিসোটা। আবার কারও কারও হাতে জিহাদী তলোয়ার। আমি আর আমার অন্য দুই নারী সহকর্মী কোন রকমে দৌড়ে মাঠ থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলাম। দেখলাম তলোয়ার নিয়ে আমাদের পেছনে পেছনে ছুটে আসছে কয়েকজন। রিকশাওয়ালাকে কোনভাবে না থামিয়ে জোরে চালাতে বললাম। হঠাৎ আমাদের কাছাকাছি এসে আমাদের রিকশা ঘিরে দাঁড়ালো। আমাদের তিনজনের একজন রিকশার হুটে বসা ছিল। আমি বায়ে বসা। আস্তে আস্তে বললাম: আমরা পাশের ধান ক্ষেতে ঝাঁপ দিব। হঠাৎ তিনজন রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে লাফিয়ে পরে দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রামে গিয়ে এক বাড়িতে আশ্রয় চাইলাম। তারা আশ্রয় দিবে না কারণ ওদের পরে বিপদ হবে। দিশেহারা হয়ে ঐ বাড়ির পেছনে টয়লেটের আড়ালে আমরা প্রায় দুই ঘন্টা থাকার পর- কাছাকাছি অফিসের গাড়ি আসলো এবং আমরা উদ্ধার পেলাম। সেদিন বহু এনজিও কর্মী, নারী সদস্য এবং শিশুরা হতাহত হয়।

নারী উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষিত হয় ৮ই মার্চ ২০০৮ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষণার পরপরই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিবাদ, ভাংচুর এবং জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে। সরকার এক পর্যায়ে কারফিউ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারা জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এরা কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। যারা সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে আঘাত করেছে। এদের সঙ্গে মতান্তর হলেই যে কাউকে নাস্তিক, মুরতাদ ঘোষণা দেয়। এই গোষ্ঠী ধর্মের অজুহাত দিয়ে সবসময়ই নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তৎপর। নারীর মানবাধিকারকে এরা সবসময় ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে গুলিয়ে ফেলে। এই দল এবং সংগঠনগুলো তখন স্লোগান তোলে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। কি অদ্ভুত- এই দেশের খেয়ে এই দেশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। এদের সাথে সাথে তৎকালীন কিছু বুদ্ধিজীবি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ধোয়া তুললেন ’পর্দাই নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা’। নারীর অধিকার হরণের বেলায় সব শিয়ালের এক রা। কেননা এখানে স্বার্থ জড়িত। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালায় বলা হয়েছে নারীর অর্জিত সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার ও নিয়ন্ত্রনের কথা। বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারের কথা। সেই সময়টা সিলেটে যেতে হয়েছিল। সারাদেশে হরতাল চলছে। কাজের প্রয়োজনে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে হেঁটে যেতে হচ্ছে। রাস্তায় পায়ে পায়ে হুজুরদের মিছিল। আট দশ বছর বয়স হবে, বাচ্চা হুজুরও সরকার বিরোধী স্লোগান দিচ্ছে। খুব জানতে ইচ্ছে করলো এই শিশুটি কি জানে সে কেন লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে? জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিল: সরকার মহিলাগোরে সব কিছু দিয়া দিতাছে। খুবই অবাক হলাম ওর উত্তর শুনে। কোনও সরকারই এই মৌলবাদী গোষ্ঠীকে খুব একটা ঘাটায় না। রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে থেকে যায় এদের গোপন আতাত। এদেরই কেউ কেউ আবার মন্ত্রী হয়। শহীদ মিনারে ফুল দেয়। প্রথম যেদিন রাজাকার স্মৃতিসৌধে ফুল দিল- বাবা সারাদিন ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে রইলেন। কিছুই খেলেন না। শুধু বললেন: এই দৃশ্য দেখার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় মরে গেলেই সবচেয়ে ভালো হতো। একদিন পরই বাবা হার্ট অ্যাটাক করলেন। জীবনের শেষে এসে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দেখে যেতে পেরে নিশ্চয়ই বাবার আত্বা শান্তি পেয়েছিলো।

স্রোতের বিপরীতে এই দীর্ঘ পথচলা। গত দুই দশকের অধিক বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় ঘুরেছি। নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতি ফসলের মাঠ থেকে খেলার মাঠ। গৃহস্থালি থেকে কর্মপ্রতিষ্ঠান। সেনাবাহিনী থেকে আকাশে উড্ডয়ন। তবু নারীর জীবনের যে অন্ধকার, তাকে ঘিরে ধর্ম-রাজনীতি, শক্তি-রাজনীতি, আধিপত্যবাদের খেলা কিছুই মুছে যায়নি। পারিবারিক নির্যাতনে হত্যা করা কোহিনুর, তার দুই বছরের শিশুর নির্বাক চাহনি। অপমান অপবাদ সহ্য করতে না পেরে আতহত্যা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সিমু। গণধর্ষণের পর সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা মহিমার ছবি। মাদ্রাসার ছাত্রীকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করার পর পুড়িয়ে মারা। কিশোরী সালেহার ফতোয়ার শিকার হয়ে একঘরে জীবনযাপন। ঘটনা একই থাকে কেবল পাল্টায় দৃশ্যপট, পাল্টে যায় ধরণ । বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আজও জীবনের দৈনন্দিন যাপনে এদের ছায়া এসে পড়ে। এখনও প্রতিদিন এদের গল্প কোনও না কোনও ভাবে ধারাবাহিক উপস্থাপিত হচ্ছে।

কোন শক্তির কাছে আমরা মুক্ত চিন্তা-মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা বারবার পরাজিত হই। মনে হয় একা কোন দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছি। শিক্ষা-মানবতা, যুক্তি-বিজ্ঞান সব যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবু সভ্যতার গভীরে লুকিয়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যের বিকল্প অনুসন্ধান করে যাব। সেবাদাসী থেকে নারীর উত্তরণ ঘটবে। নারী নিজেই নিবে নিজের অধিকার আদায় করে নেবে। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের ক্ষমতাকেন্দ্রে আঘাত করে তচনচ করে দিয়ে নির্মাণ করব নবাঞ্চল।

সারাবাংলা/আরএফ/

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন