বিজ্ঞাপন

ই-কমার্সে কলঙ্কের দাগ

January 1, 2022 | 1:50 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বিদায়ী বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ই-কমার্স। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার এই সেবার জনপ্রিয়তা এ বছর আরও বাড়ছিল। তবে বছরের শেষ দিকে এসে ই-কমার্সের ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হওয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। লাখ লাখ গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় ই-ভ্যালিসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রাহক হয়েছেন নিঃস্ব, স্বর্বস্বান্ত। অর্থ ফেরত পেতে গ্রাহকরা বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ-সেমিনার ও মিছিলও করছেন। তবে গ্রাহকের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি।

বিজ্ঞাপন

ইভ্যালি

চটকদার বিজ্ঞাপন ও কমমূল্যে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের অফার দিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। তবে দীর্ঘদিনেও অর্ডার করা পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছে না দিতে পারার অভিযোগের পারদ সর্বোচ্চে উঠতে থাকে। চারদিকে ছড়াতে থাকে নানা গুঞ্জন। ইভ্যালির ব্যবসায়িক মডেল নিয়েও প্রশ্ন উঠে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, প্রতিষ্ঠানটির মোট দায়ের তুলনায় মূলধন ও সম্পদের পরিমাণ নগণ্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এটি লোকসানি কোম্পানি।

এমন প্রতিবেদনের খবরে গ্রাহকের মধ্যে বাড়তে থাকে শঙ্কা। প্রতারণার অভিযোগে এক সময় গ্রেফতার হন প্রতিষ্ঠানটির সিইও ও চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন করা হবে কি না, তা নিয়ে চলতে থাকে আলোচনা। হাইকোর্টের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচলানায় গঠিত হয় একটি বোর্ড। সেই বোর্ড এখন প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করছে। তবে গ্রাহক তাদের অর্থ ফেরত পাবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি।

চলতি বছরের জুনে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর তাদের চলতি সম্পাদ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কোনো অবস্থাতেই কোম্পানিটি দায় শোধ করতে পারবে না বলেও এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে আগস্ট মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ই-ভ্যালি জানায়, তাদের দায় ৫৪৪ কোটি টাকা ও চলতি সম্পদ ১০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করলেও গ্রাহক ও মার্চেন্টদের দেনার মাত্র ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

বিদায়ী বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর গুলশান থানায় আরিফ বাকের নামে এক ভুক্তভোগী ইভ্যালির সিইও রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর সেই মামলায় দু’জনকেই গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিন (র‌্যাব)। র‌্যাব জানায়, ইভ্যালির কাছে গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের পাওনা হাজার কোটি টাকারও বেশি। নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পানা ছিল ই-ভ্যালির সিইও রাসেলের।

অরেঞ্জ

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে এ বছর। তাহেরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক আগস্ট মাসে গুলশান থানায় এ অভিযোগ জানিয়ে মামলা করে। মামলায় ই-অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, মালিক বীথি আকতার, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আমানউল্লাহ চৌধুরী, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা কাওসার আহমেদসহ প্রতিষ্ঠানটির সব মালিককে আসামি করা হয়। আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে যান সোনিয়া মেহজাবিন ও মাসুকুর রহমান। কিন্তু আদালত তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা বিভিন্ন সময় সড়ক অবরোধ করে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর মাশরাফি বিন মুর্তজার বাসায়ও হামলা করে। তখন মাশরাফি জানান, তিনি ই-অরেঞ্জের সঙ্গে আর সম্পৃক্ত নন। তবে গ্রাহকের টাকা ফেরত পেতে তিনি সর্বোচ্চ সহায়তা করবেন।

বিজ্ঞাপন

আলেশা মার্ট

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের বিরুদ্ধেও গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে না পেরে ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আলেশা মার্ট ১ ডিসেম্বর তাদের দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটি তখন জানায়, তাদের অফিসে কিছু লোক গিয়ে কর্মকর্তাদের গায়ে হাত তোলেন এবং বলপ্রয়োগের চেষ্টা করেন। এ কারণে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে আলেশা মার্টের সব কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

এরপর ৫ ডিসেম্বর ৩০০ কোটি টাকা সহায়তা ও নিরাপত্তা চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় আলেশা মার্ট। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়া এবং কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে সরকারের কাছে এই অর্থ সহায়তা চায় প্রতিষ্ঠানটি।

কিউকম

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের কাছে গ্রাহকের ২৫০ কোটি পাওনা রয়েছ বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এসব অর্থ আত্মসাৎ করেছে— এমন অভিযোগ গ্রাহকদের। পরে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কিউকম সিইও’র মো. রিপন মিয়াকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি জানায়, কিউকম মূলত মোটরসাইকেলকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটায়। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য তারা ‘বিজয় আওয়ার’, ‘স্বাধীনতা আওয়ার’, ‘বিগ বিলিয়ন’ ইত্যাদি অফার দিয়ে অনেক কম দামে মোটরসাইকেল বিক্রির কথা বলত। ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকার মোটরসাইকেল ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় পাওয়ার অফার পেয়ে ক্রেতারা নগদ টাকা পরিশোধের মাধ্যমে মোটরসাইকেল অর্ডার করেন। কিন্তু সময়মতো পণ্য না পেয়ে ক্রেতারা কিউকমে যোগাযোগ করেন। পরে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে বলে বুঝতে পারেন।

আলাদীনের প্রদীপ সিরাজগঞ্জ শপ

ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের অফারের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে সিরাজগঞ্জের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জশপ ডটকম ও আলাদীনের প্রদীপ। এ দুই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও পণ্যের অর্ডার করে অগ্রিম টাকা দিয়ে এখন বিপাকে পড়েন হাজারও গ্রাহক।

বিজ্ঞাপন

ধামাকা

প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে ধামাক শপিংয়ের বিরুদ্ধেও। পণ্য না দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে টঙ্গী পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করেন এক ব্যবসায়ী। পরে ধামাকা শপিংয়ের সিওও সিরাজুল ইসলাম রানাসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন