বিজ্ঞাপন

বন্ধ ৩৩ ইটভাটা: বাঁচবে পাহাড়-বনভূমি, বিকল্প না রাখায় ক্ষোভ

February 19, 2022 | 8:46 am

জসিম মজুমদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

খাগড়াছড়ি: উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ধ করে দেওয়া হলো খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৩৩টি ইটভাটা। গত ৪ দিনে খাগড়াছড়ি জেলা সদরসহ অন্য আট উপজেলায় ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়ে ইটভাটাগুলো বন্ধ ঘোষণা করে তাতে লাল পতাকা উত্তোলন করেছে জেলা প্রশাসন। তবে বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে ভাটা বন্ধ করায় ক্ষুব্ধ মালিক-শ্রমিকরা। তারা বলছেন, এর ফলে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। অন্যদিকে এর ফলে জেলার বনাঞ্চল ও পাহাড় রক্ষা পাবে বলে মত দিয়েছেন স্থানীয়রা।

বিজ্ঞাপন

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘একটি রিটের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের সব ইটভাটাকে অবৈধ ঘোষণা করে সাত দিনের মধ্যে ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। সেই নির্দেশনা হাতে পৌঁছার পরপরই ইটভাটা বন্ধের অভিযান শুরু করা হয় এবং পর্যায়ক্রমে জেলার ৯টি উপজেলার ৩৩টি ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

এর আগে, গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো বন্ধে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন (পিটিশান নং- ১২০৪/২০২২) দায়ের করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)।


রিট আবেদনে অভিযোগ করে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় স্থাপিত ইটভাটাগুলো লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া পাহাড় কেটে মাটি ইটভাটার কাঁচামাল হিসেবে ও বনের গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রিটের শুনানি হয় গত ২৫ জানুয়ারি। শুনানি শেষে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার সব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করার জন্যে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি ফাতেমা নজীবের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ।

বিজ্ঞাপন

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার এই উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে বিপরীত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা। আর ইটের বিকল্প তৈরির বন্দোবস্ত না করে আকস্মিক এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উন্নয়ন কাজ স্থবির হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ঠিকাদাররা।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ ক্রমাগতভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছিলো। ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এতে পাহাড় তার আপন পরিবেশ ফিরে পাবে, প্রকৃতি পাবে নিজস্ব ভারসাম্য।’

খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ইটভাটাগুলোতে নির্বিচারেই পোড়ানো হতো বনের কাঠ। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনগুলো দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছিলো। জনবল সংকট এবং আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বন বিভাগের পক্ষে চাইলেও কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’

বিজ্ঞাপন

ইটভাটা বন্ধে আদালতের এমন নির্দেশনা পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে, যোগ করেন বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।

অপরদিকে, খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কমলছড়ি এলাকার ইটভাটা আর পি এস ব্রিকসের শ্রমিক মো. মোস্তফা, মান্নান মিয়া ও রতন মিয়া বলেন, ‘এই ইটভাটায় আমরা অন্তত ৪০০ থেকে ৬০০ শ্রমিক কাজ করছি। জেলার প্রতিটি ইটভাটাতেই এমন সংখ্যক শ্রমিক কাজ করতেন। ইটভাটায় কাজ করে সামান্য আয় দিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করি। আকস্মিকভাবে ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা কয়েক হাজার শ্রমিক পরিবার নিয়ে দারুণ অনিশ্চতার মুখে পড়েছি।’

মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি এলাকায় স্থাপিত ইটভাটা মেসার্স ইমরান এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী এটিএম রাশেদ উদ্দিন বলেন, ‘বেশিরভাগ ইটভাটার মালিকরাই ধার-দেনা করে এবং আগাম ইট বিক্রির টাকা দিয়ে ইটভাটা পরিচালনা করে থাকে। আদালতের এমন নির্দেশনা মৌসুম শুরুর আগে দেওয়া হলে ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই নতুন করে বিনিয়োগ করতো না। মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে ইটভাটা বন্ধের এমন নির্দেশনায় বেশিরভাগ ইটভাটা মালিক দেউলিয়া হয়ে যাবে।’

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় ঠিকাদার কে এম ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘খাগড়াছড়িতে উন্নয়ন কাজ করার জন্য এখনও ইটের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এ জেলায় কংক্রিটের ব্লক তৈরির কোনো কারখানা বা উদ্যোক্তাও নেই।’

জেলার আরেক ঠিকাদার রিপরিপ চাকমা বলেন, ‘বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে ইটভাটা বন্ধ কোনো কার্যকরী সমাধান নয় বরং এটি আপাতভাবে আত্মঘাতীও বটে। এর ফলে পার্বত্য এই তিন জেলার যাবতীয় উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।’

রিটকারী হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পাহাড়ের পরিবেশ বিনষ্টের প্রধান কারণ হলো ইটভাটা। আশাকরি ইটভাটা মালিকরাও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে ইটের ব্যবসা বাদ দিয়ে কংক্রিটের ব্লক তৈরির কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত হবেন।’

ইটভাটা ব্যবসায়ী ও খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বলেন, ‘আমরাও কংক্রিটের ব্লক তৈরির ব্যাপারে ভাবছি। তবে হুট করে ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া কার্যত কোনো সমাধানই নয়। এর জন্য কিছুটা সময় দেওয়া প্রয়োজন। না হলে এই ক্ষতি ইটভাটার মালিকরা কখনই কাটিয়ে উঠতে পারবেন না।’

সারাবাংলা/এমও

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন