বিজ্ঞাপন

গ্রামেও ‘গ্যাং কালচার’, তদন্তে বেরিয়ে এলো নির্মম খুনের ঘটনা

February 20, 2022 | 5:10 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিদেশ থেকে ফিরে পারিবারিক নানা টানাপড়েনে কাতর হয়ে মাজারে মাজারে ঘুরতেন শাহজাহান আলম বালু নামে এক ব্যক্তি। এক রাতে চট্টগ্রামের পটিয়ার আমির ভাণ্ডার দরবার শরীফ থেকে বের হবার পর তাকে ‘পেয়ে বসে’ গ্রামের উঠতি বয়সের কিছু তরুণ, যারা সংঘবদ্ধভাবে নানা অপরাধে জড়িত। প্রথমে তাকে আটকে টাকার জন্য মারধর করে।

বিজ্ঞাপন

এরপর তার পেটের ভেতরে ইয়াবা আছে সন্দেহে সেগুলোর জন্য আবার নির্যাতন করা হয়। ইয়াবা বের করার জন্য তাকে খাওয়ানো হয় ট্যাবলেট-সিরাপ। উচ্চমাত্রার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে শাহজাহান। শেষবারের মতো ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করতে থাকে। পানির জন্য তাকে নেয়া হয় গ্রামের গহীনে খালে। কিন্তু ততক্ষণে আর পানি পানের শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট ছিল না। তাকে লাথি মেরে খালে ফেলে উল্লাস করতে করতে ফিরে যায় সংঘবদ্ধ অপরাধীরা।

খালে ভাসতে ভাসতে লাশ চলে যায় পটিয়া থেকে বোয়ালখালীতে। পুলিশ উদ্ধার করলেও মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি। প্রায় দশমাসের চেষ্টায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তার পরিচয় শনাক্তের পাশাপাশি সূত্রবিহীন এই হত্যাকাণ্ডের পুরো রহস্য উদঘাটন করে গ্রেফতার করেছে দু’জনকে। পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, নগরকেন্দ্রিক ‘গ্যাং কালচার’ নামের ভয়ঙ্কর অপরাধ আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামগঞ্জেও, যার নির্মম বলি হয়েছেন এই শাহজাহান।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে গ্রেফতার দুই আসামিকে নিয়ে পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের খানমোহনা গ্রামের মহিষপাড়া এলাকায় চানখালী খালের পাড়ে, যেখানে শাহজাহানকে নির্যাতন করে লাশ ফেলে দেয়া হয় সেখানে যায় পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাজমুল হাসানের নেতৃত্বে একটি টিম। সেখান থেকে ‘খুনিদের’ ব্যবহৃত ছোরা, শাহজাহানকে খাওয়ানো সিরাপের বোতল, ওষুধের খালি পাতা উদ্ধার করা হয়। এরপর আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরে বোয়ালখালীতে যেখানে তার লাশ পাওয়া যায় সেখানেও যায় পিবিআই টিম।

গ্রেফতার দু’জন হল- মেহেদি হাসান হিরু (২৭) ও সাইফুল ইসলাম (৪০)। উভয়ই খানমোহনা মহিষপাড়া এলাকার বাসিন্দা।

বিজ্ঞাপন

নিহত মো. শাহজাহান আলম বালু (৩৮) চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের খিতাপচর গ্রামের নূর হোসেন মেম্বারের ছেলে। ২০২০ সালের ২ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে পটিয়া পৌর সদরে আমির ভাণ্ডার দরবার শরীফে জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন তিনি। ৫ অক্টোবর দুপুর আড়াইটার দিকে বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচরে রায়খালী খালে প্রসন্ন মাঝির ব্রিজের নিচ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

তবে লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় বোয়ালখালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সালামত উল্লাহ ৭ অক্টোবর ‘অজ্ঞাত ব্যক্তিকে খুনের পর লাশ গুমের উদ্দেশে খালে ফেলে দেয়ার’ অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। একইদিন নিহত শাহজাহানের ভাই জাহাঙ্গীর আলম বাদি হয়ে পটিয়া থানায় অপহরণের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন।

জাহাঙ্গীর মামলার এজাহারে অভিযোগ করেন, আটবছর ওমানে থেকে শাহজাহান ২০১৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। ওমান থেকে তিনি টাকা পাঠাতেন ভাবি রহিমা বেগমের অ্যাকাউন্টে। রহিমা তার পাঠানো ১৩ লাখ টাকা আত্মসাত করেন। এ নিয়ে রহিমা ও তার ভাই আরাফাত মিজান সোহেলের সঙ্গে শাহজাহানের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এছাড়া শাহজাহানের আরেক ভাবী ছবি আক্তারের সঙ্গে স্থানীয় জাকির নামে এক ব্যক্তির মেলামেশা নিয়ে তার আপত্তি ছিল। এ নিয়েও ছবির সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। এই চারজনের সঙ্গে বিরোধের জেরে শাহজাহানকে অপহরণ করা হতে পারে বলে সন্দেহ ছিল জাহাঙ্গীরের। পটিয়া থানা পুলিশ রহিমা, ছবি এবং জাকিরকে গ্রেফতার করেছিল।

বিজ্ঞাপন

বোয়ালখালী থানায় দায়ের হওয়া অজ্ঞাত ব্যক্তি খুনের মামলার তদন্তভার ২০২১ সালের এপ্রিলে দেয়া হয় পিবিআইকে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইয়ের পরিদর্শক (প্রশাসন) কাজী এনায়েত কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত শুরুর তিনমাসের মধ্যে আমরা লাশের পরিচয় নিশ্চিত করি। এরপর পটিয়া থানায় যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের পিবিআই কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি, তবে তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়নি। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে আমরা এ ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কোনো তথ্যপ্রমাণ পাইনি।’

এবার সম্পূর্ণই সূত্রবিহীন হয়ে পড়ে মামলা। তবে এর মধ্যে শাহজাহানের এক ভগ্নিপতি জানান, অপহরণের দিন অর্থাৎ ২ অক্টোবর রাত ৩টা ২১ মিনিটে তার মোবাইলে শাহজাহানের মোবাইল থেকে একটি কল এসেছিল। এসময় শাহজাহান আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘দুই লাখ টাকা তাড়াতাড়ি পাঠান, না হলে আমার হাত কেটে ফেলছে।’ কিন্তু ঠিকানা না দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেয়ায় শাহজাহানের ভগ্নিপতি আর যোগাযোগ করতে পারেননি। সেই ফোনকলের সূত্র ধরেই এগিয়ে যায় পিবিআইয়ের তদন্ত।

পিবিআই পরিদর্শক (প্রশাসন) কাজী এনায়েত কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি এবং সনাতন উভয় পদ্ধতিতে তদন্ত করি। ফোনকলের স্পট চিহ্নিত করে ছদ্মবেশে অবস্থান নিই। এলাকার বিভিন্ন চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিই। বিভিন্নজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। একপর্যায়ে খানমোহনার সংঘবদ্ধ চক্রের কথা জানতে পারি। এদের মধ্যে হিরু ও সাইফুলকে ফাঁদ পেতে নগরীর পাহাড়তলীতে এনে শনিবার ভোরে গ্রেফতার করি। আদালতের মাধ্যমে তাদের তিনদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে এর সঙ্গে জড়িত সবার তথ্য দেন। গ্রেফতার দু’জন এখনও আমাদের হেফাজতে আছেন।’

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার দুইজনসহ কিলিং মিশনে ছিল মোট ১০ জন। এদের অধিকাংশই ২০-২২ বছরের তরুণ। তারা এলাকায় মাদক সেবন করে, সংঘবদ্ধভাবে চলাফেরা করে এবং ছিনতাই-চাঁদাবাজি করে। এদের মূল নেতা সাদ্দাম হোসেন নামে একজন। সাদ্দামের দু’জন মূল সহযোগী হচ্ছে মহিউদ্দিন এবং সুজন। তাদের নির্দেশে শাহজাহানকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।’

কেন এই হত্যাকাণ্ড, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে ফিরে টাকাপয়সা হারিয়ে অনেকটা ভবঘুরে মাজারভক্ত হয়ে পড়েছিলেন শাহজাহান। ঘটনার রাতে তিনি মাজার থেকে বের হয়ে একা হেঁটে খানমোহনার রাস্তা দিয়ে বোয়ালখালীতে বাড়িতে ফিরছিলেন। গ্যাং কালচারে যুক্ত তরুণরা তাকে একা পেয়ে তুলে নিয়ে যায়। খানমোহনা গ্রামের একেবারে পশ্চিমে নির্জন চানখালী খালের অদূরে নিয়ে তাকে প্রথমে টাকার জন্য মারধর করে। এরপর হঠাৎ বলা হয় তার পেটে ইয়াবা আছে। পায়ূপথ দিয়ে ইয়াবা বের করার জন্য তাকে খাওয়ানো হয় উচ্চমাত্রার ওষুধ ও সিরাপ। এতে পায়খানা করতে করতে সে নিস্তেজ হয়ে যায়। তবে মারধরের কারণে এর আগে থেকেই সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পরে তাকে খালে ফেলে দিয়ে অপরাধীরা চলে যায়।’

ঘটনাস্থলে গিয়ে পিবিআই কর্মকর্তাদের গ্রেফতার হিরু ও সাইফুল জানায়, মারধরের কারণে দুর্বল হয়ে শাহজাহান বারবার ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করছিলেন। ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় নিস্তেজ হওয়ার সময়ও ক্ষীণ কণ্ঠে বারবার পানি খেতে চাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু গভীর রাতে লোকালয় থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চানখালী খালের পাড়ে পানির কোনো ব্যবস্থা তারা করতে পারেনি। পানি খাওয়ানোর জন্য তাকে খালে নামানো হয়। কিন্তু পানি পানের শক্তি ততক্ষণে হারিয়ে ফেলে। এসময় শাহজাহানকে পেছন থেকে লাথি মেরে খালে ফেলে তারা চিৎকার দিয়ে উল্লাস করতে করতে ফিরে যায়।

পুলিশ ‍সুপার নাজমুল হাসান বলেন, ‘সমাজে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা গ্যাং কালচার, তরুণদের খামখেয়ালিপনা, মাদকের প্রতি লোভ- এসব কারণেই শাহজাহানকে তারা অবলীলায় খুন করেছে। আমরা ১০ জনের নাম পেয়েছি। দু’জনকে গ্রেফতার করেছি। বাকি আটজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।’

এদিকে রোববার সকালে শাহজাহানকে খুনের সঙ্গে জড়িত দু’জনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাবার খবরে এলাকার প্রায় হাজারখানেক লোক জড়ো হয় রায়খালী খালে প্রসন্ন মাঝির ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায়। আসেন শাহজাহানের পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়স্বজনরাও। তারা পিবিআইয়ের গাড়ি ঘিরে ধরে আসামিদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে। পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বক্তব্য দিয়ে বাকি আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে বিক্ষুব্ধ জনতা শান্ত হয়ে সরে যায়।

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন