বিজ্ঞাপন

কিভাবে তৈরি হয়েছিল একুশের সেই অমর গান?

February 21, 2022 | 2:54 pm

এন্টারটেইনমেন্ট করেসপনডেন্ট

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…।

বিজ্ঞাপন

সুরের ছোঁয়ায় ফিরে যাই বায়ান্নতে। শব্দ আর সুরের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যেন লেখা হয়ে রয়েছে। এই গানটি আমরা ফেব্রুয়ারি মাস আসলে অনেকেই গাই এবং অনেককেই গাইতে শুনি। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের দেশে যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, তার কোনটিই এই গানটি কে বাদ দিয়ে ভাবা যায় না।

সেদিনের সেই আগুন ঝরা দিনেই কালজয়ী গানটি লিখেছিলেন সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী। প্রথমে সুর দিয়েছিলেন আবদুল লতিফ। পরে আলতাফ মাহমুদের সুরটিই কেড়ে নেয়া সবার মনপ্রাণ। ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরীতে প্রথমবারের মতো আলতাফ মাহমুদের সুরের গানটিই গাওয়া হয়। এরপর তা হয়ে যায় ইতিহাস।

৫২ এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত অমর ২১শে ফেব্রুয়ারীর গানটি শুরুতে লেখা হয়েছিল কবিতা হিসেবে। সেটি ছিল ৩০ লাইনের। পরবর্তীতে এই কবিতার প্রথম ছয়টি লাইনই গান গাওয়া হয়। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা সেই কবিতাটি হচ্ছে—

বিজ্ঞাপন

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

গানটির রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজের বিদায়ী ছাত্র ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারী মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে শুনে তিনি সেদিন খবর নিতে মেডিকেল কলেজে যান। আউটডোরে এক নিহত ছাত্রের লাশ দেখে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। গুলিতে ছাত্রটির মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। নিহত ছাত্রটি ছিলেন শহীদ রফিকুদ্দীন।

২২ ফেব্রুয়ারী নিহতদের স্মরনে গায়েবী জানাজা হয়েছিল এবং মওলানা ভাসানী সেই জানাজায় ইমামতি করেছেন। জানাজা শেষ হবার পর গনমিছিল শুরু হয়, যে মিছিলে আবদুল গাফফার পুলিশের মারের আঘাতে আহত এবং অজ্ঞান হন। ওনার বন্ধুরা ওনাকে প্রথমে কার্জন হলে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে গেন্ডারিয়ায় এক বাসায় নিয়ে যান। আহত অবস্থায় সে বাসাতেই তিনি এ কবিতাটি লিখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।

বিজ্ঞাপন

এরপর গেন্ডারিয়ায় গোপন এক সভায় এক ইশতেহার প্রকাশ করা হয় এবং সে ইশতেহারেই প্রথম এই কবিতাটি ছাপানো হয়। প্রথমে আবদুল লতিফ কবিতাটির সুরারোপ করেন এবং ১৯৫৩ সালে গুলিস্তানের ব্রিটেনিয়া হলে ঢাকা কলেজের নব নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে আব্দুল লতিফ ও আতিকুল ইসলাম প্রথম গানটি পরিবেশন করেন। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময় গানটি গাওয়ার অপরাধে তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অনুরোধে শহীদ শেখ সোহরওয়ার্দী বহিষ্কারের জন্য তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানালে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হয়। গানটি গাওয়ার অপরাধে সে বছর আবদুল লতিফ এর বাসাতেও গ্রেফতারের জন্য পুলিশ আসে।

পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদ, যিনি সে সময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগে আগে ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি ইংরেজি, হিন্দি, মালয়, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এএসজি

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন