বিজ্ঞাপন

গ্রামীণ মানুষের প্রাণশক্তি

April 13, 2018 | 2:50 pm

সুমনকুমার দাশ

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা গ্রামীণ মানুষের জীবন। ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এ প্রবাদবাক্যটি গ্রামীণ সাধারণ মানুষের কাছে যেন আরও একটু বেশিই প্রাসঙ্গিক। সংকট এবং প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গ্রামে এখনও প্রতি মাসে ঘটা করে পালিত হয় নানা ধরনের উৎসব, আচার ও অনুষ্ঠান। সেগুলো কখনও ধর্মীয় লোকাচার, কখনও চিত্তবিনোদনের মাধ্যম আবার কখনও লোকসমাজের প্রাত্যহিক সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হিসেবে আয়োজিত হয়।
ঋতুকেন্দ্রিক নানা আয়োজনের পাশাপাশি বারো মাসজুড়েই পালা-পার্বণ আর উৎসবে মুখর থাকে বাংলাদেশের গ্রামগুলো। তবে এসব উৎসবের প্রায় সবই বাংলা মাসের দিন-তিথি-নক্ষত্র মেনে পালিত হয়। এখনও গ্রামীণ মানুষ বাংলা মাসের তারিখ দেখে ফসল বোনেন, পঞ্জিকা দেখে যাত্রাপথের গন্তব্য নির্ধারণ করেন। যুগের পর যুগ ধরে বাপ-দাদার লৌকিক সংস্কারগুলো মানুষেরা এখনও পরম মমতায় ধারণ করে রেখেছেন। বাংলা বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় গ্রামীণ মানুষের মধ্যে চৈত্র ও বৈশাখ মাস ভিন্ন আমেজ নিয়ে হাজির হয়। এ দুটি মাসে ঘটা করে বর্ণিল সব আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠেন গ্রামের মানুষ।
পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে চৈত্র ও বৈশাখ মাসের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ধারাগুলো প্রতি বছরই নতুনভাবে হাজির হয়। নানা কৃত্যানুষ্ঠান আর উৎসবমুখরতায় গ্রামের মানুষ চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকেন। বর্তমানকালে এসব সংস্কার আর আচার পালনের রীতিনীতিতে কিছুটা পরিমার্জিত-রূপ এলেও তাতে উৎসব আয়োজনে তেমন ভাটা পড়েনি। শহুরে করপোরেট সংস্কৃতির ছোঁয়া গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে মৃদু ঢেউ তুললেও সেটা বৈশাখী ঝড়ের মতোই হুটহাট বিদেয় হয়। নগরায়ণের প্রভাবে অনেক রীতি-রেওয়াজ হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আনন্দ-উচ্ছ্বাস কিছুটা ফিকে হলেও গ্রামীণ মানুষ তাঁদের নিজেদের আচার-সংস্কৃতিতে এখনও সাবলীল।
আবহমানকাল থেকে বর্ষ শেষের দিনটি গ্রামের মানুষের কাছে বর্ণিল উৎসবের উপলক্ষ্য। নানা আচার-অনুষ্ঠান আর কৃত্যের মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরের দুঃখ-ক্লান্তি-জ্বরা দূরে ঠেলে নতুন বছরের প্রত্যাশায় বছরের শেষদিনটিতে জাঁকজমকভাবেই চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব পালিত হয়। ওইদিন বাড়িঘর থেকে শুরু করে হাঁড়ি-পাতিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পাশাপাশি হরেক রকমের রান্নাবান্না করার রেওয়াজ গ্রামীণ জীবনে প্রচলিত। দই-চিঁড়া-খই-মুড়ি-মুড়কি-মিষ্টি-জিলাপিসহ পাড়া-প্রতিবেশীদের আমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এমনকি দেহকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে তিক্ত স্বাদের খাবার খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে কোনও কোনও এলাকায়। যুগের পর যুগ ধরে এমন লোকবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান এখনও গ্রামের মানুষেরা উত্তরাধিকারসূত্রে ধারণ করে রেখেছেন।
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গাজন, চড়কপূজা, শিব-গৌরীর নৃত্য, দেল উৎসব, নীলনৃত্য, অষ্টক, গম্ভিরা, লোকগানের আসর, লাঠিখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, সাপের খেলার আয়োজনসহ নানা ধরনের উৎসব পালিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন আবেদন নিয়ে এসব উৎসব গ্রামীণ হিন্দু-মুসলমান ধর্মালম্বীরা নানা আয়োজনের মাধ্যমে পালন করে থাকেন। চৈত্রসংক্রান্তিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে গ্রামে গ্রামে মেলা বসে। হাঁড়ি-পাতিল, মুড়ি-মুড়কি-মিষ্টিজাত দ্রব্য, ঢোল, ডুগডুগি, একতারা, শোলার ফুল-পাখি, বাঁশি, রঙিন কাঁচের চুড়ি, ফিতেসহ নানা কুটির শিল্পের পসরা বসে মেলাগুলোতে। এর বাইরে নানা লোকবিশ্বাসকে ধারণ করে ঢাক-ঢোলের বাদ্যে হিন্দু ধর্মালম্বীরা কৃষিকেন্দ্রিক নানা পূজা-অর্চনাও করে থাকেন। বাংলাদেশের আদিবাসীরাও নববর্ষ পালনে পিছিয়ে নেই। কালেক্টর, বৈসাবি, বিজু, সাংগ্রাই, দ-নাচসহ নানা আয়োজন তাঁরা ঘটা করে পালন করে থাকেন।
চৈত্রসংক্রান্তি শেষে পরদিন বাংলা নববর্ষকে ঘিরেও চলতে থাকে উৎসবের রেশ। দোকানপাটগুলো পরিচ্ছন্ন করে ক্রেতা ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য বিক্রেতারা অনেকটা ঘটা করে হালখাতা-উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। সাধ্য অনুযায়ী মিষ্টিমুখ করানো হয় ক্রেতাদের। নতুন বছরের পঞ্জিকা কেনার ধুম পড়ে স্থানীয় হাটবাজারগুলোতে। এসব তো বাঙালির আচারিক বিষয়-আশয়। এর বাইরে ওই দিনটিতে গ্রামের পাশের মাঠে আয়োজিত মেলা আর বাড়ির উঠোনে বাউলগানের আসরের যে আয়োজন হয়ে আসছে সেই সুদীর্ঘকাল ধরে, সেটার আবেদন কিন্তু এখনও সর্বাধিক।
বৈশাখ মানেই গ্রামীণ মানুষের কাছে ধান কাটা, গরুর গাড়ির ঘচং ঘচং আওয়াজ, ধান মাড়াই, রাত জেগে খলা (ধান শুকোনোর মাঠ) পাহারা দেওয়া এবং খেতের ধান লুকিয়ে জিলেপি অথবা মিষ্টিজাতীয় জিনিস খাওয়া প্রভৃতি অতি পরিচিত দৃশ্য। বর্ষারম্ভের মুহূর্তটুকু তাই গ্রামীণ জীবনে অন্যমাত্রায় উদ্ভাসিত হয়। এ কারণেই নববর্ষের দিনটিকে ঘিরে কৃষকেরা নানা আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করেন। এককথায় চৈত্রসংক্রান্তি গ্রামীণ মানুষের কাছে যেমন আবেগ নিয়ে হাজির হয়, তেমনি বাংলা নববর্ষেও একই আবেগে উদ্বেলিত হন সবাই।
দ্রুত সময় পাল্টাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনধারা। নানা গতিপ্রকৃতি পাচ্ছে লোকগান ও স্বশিক্ষিত প্রজ্ঞাবান সাধক, গায়ক ও গ্রামীণ মানুষের আচার-কৃত্যানুষ্ঠানগুলো। চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখের উৎসবও যে বৈচিত্র্য হারাচ্ছে তাও কিন্তু নয়। গত বছর দশেক আগেও নানা জাতের, নানা বর্ণের ধান ব্যাপকহারে কৃষকেরা ফলাতেন। অথচ এখন সেসব ধান ফলানো তো দূরের কথা, অনেক ধানের প্রজাতি আশঙ্কাজনকভাবে হারিয়ে গেছে। আধুনিক সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কেবল ধানই নয়, বরং কতকিছুই লুপ্ত হচ্ছে, বিলীন হচ্ছে পরিচিত গান ও সংস্কৃতির ধারা-উপধারাগুলো। তা সত্ত্বেও চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ গ্রামীণ মানুষের কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণশক্তি হিসেবে হৃদয়ে হিল্লোল তোলে। গ্রামীণ জীবনে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠার এক মহিমান্বিত মিলনসূত্রস্বরূপ। শত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা বাংলার এই নিজস্ব সাংস্কৃতিক রূপটির চেতনার প্রকৃত উদ্দেশ্য দেশবাসীর কাছে ছড়িয়ে দিতে পারলেই কেবল সকল কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও সাম্প্রাদায়িক অপশক্তিকে অতি সহজেই মোকাবেলা করা যায়।
পশ্চাৎপদ সমাজ হিসেবে যে গ্রামীণ শ্রেণিটিকে আমরা অভিহিত করে আসছি, চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের দিনটিতে কিন্তু আমরা সেই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও দর্শনকেই উচ্চাসনে বসিয়ে মাতামাতি করছি। সেটা কেবল ওই নির্দিষ্ট একদিনের জন্য লোকদেখানো আচারানুষ্ঠান না-করে প্রতিটি দিনই চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসারে লালন করা উচিত। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতি ও চেতনার কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই। চিরাচরিত ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটাতে না-পারলে বারবারই কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তি সুযোগ বুঝে নখের আঁচড় বসাবে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ও আদর্শের ঠিক মর্মমূলে। যত দ্রুত সম্ভব তাই আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমরা আসলে কেমন বাংলাদেশের প্রত্যাশা করি?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন