বিজ্ঞাপন

ফুরাল প্রাণের মেলা, প্রকাশের শীর্ষে কবিতার বই

March 17, 2022 | 10:16 pm

রাহাতুল ইসলাম রাফি, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দীর্ঘ একমাসেরও বেশি সময় পর শেষ হলো অমর একুশে বইমেলা ২০২২। বইমেলার সর্বশেষ দিনে আগতদের পরিচয় ‘পাঠক-দর্শনার্থী’র চেয়ে ‘ক্রেতা’ হিসেবেই ভালো মানানসই। শেষ দিনে বই না কিনে ফিরছেন এমন লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই দেখা গেছে কম বেশি বইয়ের ব্যাগ। গত এক মাস ধরে অনুষ্ঠিত বইমেলায় নতুন প্রকাশের শীর্ষে ছিল কবিতার বই। অন্যদিকে, উপন্যাসও বেরিয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) বইমেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা মিলেছে বিদায়ী দিনের চিত্র। শিশুচত্বরে আছে কোলাহোল, চলছে সিসিমপুর শো। লিটলম্যাগ চত্বর বরাবরের মতোই ছিলো ফাঁকা, জনশূন্য। আগত পাঠকেরা শেষ দিনে এসে বই কেনার সুযোগ যেন হাতছাড়া করছেন না। বিকেল গড়াতেই মেলায় বাড়তে থাকে জনসমাগম।

শেষ দিনে বই কিনতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সোলাইমান সাদনান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিনব কিনব করে ঠিক কিনে উঠতে না পারা বইগুলো নিতে এসেছি আজ। বইমেলা আবার আসবে কবে! সে সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকব?’

বইমেলার শেষদিনে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ ‘Political parties in India’ কিনেছেন সাজ্জাদ হোসেন রাহাত। ইউনিভার্সিটি প্রেসের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে রাহাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই বইটি কিনব কিনব করে কেনা হয়নি। শেষ দিনে এসে কিনে ফেললাম। নীলক্ষেত থেকে বই কেনা আর বইমেলা থেকে বই কেনার মাঝে পার্থক্য আছে। ওই পার্থক্য আসলে আত্মিক। বইমেলার সঙ্গে কেমন এক আত্মার বন্ধন অনুভব করি।’

বিজ্ঞাপন

করোনা মহামারির প্রকোপ বিবেচনায় নানান আলোচনা-সমালোচনার শেষে পনেরো দিন পিছিয়ে এবারের বইমেলার দ্বার খোলে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রথমদিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলার সময়কাল নির্ধারণ কর হলেও পরবর্তী সময়ে প্রকাশকদের দাবির মুখে মার্চের ১৭ তারিখ পর্যন্ত বইমেলার সময় বাড়ায় সরকার।

এবারের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে সাত লাখ বর্গফুট জায়গা জুড়ে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৪২টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩২টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩৪টি ইউনিট; মোট ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭৬টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছিল ৩৫টি প্যাভিলিয়ন।

বিজ্ঞাপন

সমান আলোচনায় নবীন-প্রবীণ লেখকের বই

এবারের অমর একুশে বইমেলায় খ্যাতিমান প্রবীণ লেখকদের বইয়ের পাশাপাশি নবীন লেখকদের বই বিক্রি হয়েছে ভালো। বিভিন্ন স্টলের বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঠকদের মাঝে নতুন লেখকদের বইয়ের প্রতি একধরনের জোর আবেদন আছে।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাম্রলিপি থেকে প্রকাশ পেয়েছে নবীন লেখক ও মিউজিশিয়ান জুনায়েদ ইভানের বই ‘অন্যমনস্ক’। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় কর্মীরা বলছেন, এবার সবচে বেশি বিক্রি হয়েছে জুনায়েদ ইভানের এই বইটি। ফয়সাল নামে এক বিপণনকর্মী সারাবাংলাকে বলেন, “সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে জুনায়েদ ইভানের ‘অন্যমনস্ক’ বইটি। এরপরে যদি বলি, জাফর ইকবাল স্যারের ‘আহ টুনটুনি, উহ ছোটচাচ্চু’ বইটি বিক্রি হয়েছে বেশি। এছাড়া আয়মান সাদিক ও মুনজারিন শহীদের বইয়ের বিক্রিও ভালো ছিলো। নতুন লেখকদের বইয়ে একটা আলাদা আগ্রহ খেয়াল করেছি আমরা।”

 

বিজ্ঞাপন

এছাড়া এবারের বইমেলায় আব্দুল্লাহ আল ইমরান, কিঙ্কর আহসানদের মতো নবীন লেখকদের বইয়ের কাটতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্যদিকে, বরাবরের মতোই পাঠক-আকর্ষণের শীর্ষে অবস্থান ছিল হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, আনিসুল হকদের বই। অন্যপ্রকাশের এক বিপণনকর্মী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে হুমায়ূন স্যারের বই চাইতেই আসেন পাঠকসমাজ। আমার মনে হয়, স্যারের বইয়ের প্রতি মানুষের যে আগ্রহ, সেটি অন্য কোনো লেখকের বইয়ে নেই।’

শেষ পর্যন্ত নিস্তেজই থাকল লিটল ম্যাগাজিন কর্নার

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিস্তেজ ছিল ছোট কাগজ আন্দোলন। এবার বইমেলায় নতুন সংখ্যা এনেছে ২০টির মতো ছোট কাগজ। বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের লিটলম্যাগ চত্বরে বরাদ্দ দেওয়া হয় সর্বমোট ১২৭টি স্টল। কিন্তু অনেকগুলো মেলার শেষ দিন পর্যন্ত অনেক স্টলই টিকতে পারেন। এক পর্যায়ে গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের।

দাবি দাওয়া এবং আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে বইমেলায় সংযুক্ত হয় লিটল ম্যাগ কর্নার। শুরুর দিকে এই কর্নার বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে থাকলেও ২০১৯ সাল থেকে একটি চত্বর হিসেবে এর স্থান হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে।

লিটলম্যাগ বা ছোট কাগজের এক সময়কার প্রবণতা ছিল— এগুলোতে উঠতি অখ্যাত লেখকরা লিখতেন। লিটলম্যাগের পথ ধরেই তাদের অনেকেই বৃহত্তর সাহিত্যজগতে প্রবেশ করতেন। প্রথাবিরোধী লেখা ছাপা লিটলম্যাগের শুরুর দিককার অন্যতম বৈশিষ্ট্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে সংযুক্ত হয়েছে প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, চলচ্চিত্র, সাক্ষাৎকার, গ্রন্থালোচনা, শিল্পকলা বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য উপাদান।

এক সময় লিটলম্যাগ চত্বর উঠতি কবি-সাহিত্যিক ও রুচিশীল জনতার আড্ডায় মাতোয়ারা থাকতো। কালের পরিক্রমায় দৃশ্যপট পালটে গেছে। এখনকার লিটলম্যাগ চত্বর যেন প্রাণহীন মরুভূমি। পাঠক-দর্শক কিংবা ক্রেতাশূন্য চত্বরে বিপণনকর্মীদের উদাস বসে থাকা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক রহমান রাজুর সম্পাদনায় বের হয় লিটল ম্যাগ ‘আনর্ত’। স্টলের বিপণনকর্মী ইয়ামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘একদম বাজে অবস্থা। ক্রেতাই নেই তেমন। আমাদের পুরো চত্বরে প্রায় সবার অবস্থাই এক। মানুষ নেই, বিক্রিও নেই।’

ভ্রমণসাহিত্যের কাগজ ‘ভ্রমণগদ্য’র স্টলের বিপণনকর্মী সোহরাব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শেষের দিকে বিক্রি একটু বেড়েছে। তবে সবমিলিয়ে বেচাবিক্রি আশানুরূপ হয়নি।

শেষের দিকে জমজমাট ছিল শিশুচত্বর

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বিবেচনায় বইমেলার প্রথম দুই ছুটির দিনে শিশুপ্রহর না রাখলেও পরে তা চালু করে কর্তৃপক্ষ। শিশুপ্রহরগুলোতে মেলায় শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বইমেলার শেষ দিনের বিকেল বেলা শিশুচত্বরে গিয়ে দেখা যায়, শেষ বারের মতো ইকরি-হালুম-টুকটুকিদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠেছে শিশুরা। কখনো শিকুর রহস্য কিংবা আবিষ্কারের গল্প শুনে, কখনো না হালুমের গল্প শুনে উচ্ছ্বাসে কেটে যাচ্ছে তাদের সময়।

এদিকে, শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশকেরা জানিয়েছেন, প্রথমদিকে শিশুপ্রহরের আগে বিক্রি একটু কম হলেও শেষে এসে দৃশ্যপট পালটে যায়। শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশনী ‘ইকরিমিকরি’ থেকে এবার নতুন বই বেরিয়েছে সর্বমোট সাতটি। বইগুলো হলো— ডাইনো, রঙের জাদু (পাখি), রঙের জাদু (জীবজন্তু), আদর্শলিপি, অস্ট্রেলিয়ার আরও উপকথা, টিক টিক টিক ও পৃথিবীর গান।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির বিপণনকর্মী মেনুচিং মারমা সারাবাংলাকে বলেন, “আমাদের নতুন সাতটি বই বেরিয়েছে। শিশুপ্রহর চালু হওয়ার পর বিক্রি বেড়ে গেছে। দুটো বই— ‘হালুম আলুম’ ও ‘কঙ্কাবতী’ বেশি বিক্রয় হয়েছে।”

ঝিঙেফুল প্রকাশনীর বিপণনকর্মী আরাফাত খান সারাবাংলাকে বলেন, “আমরা শিশুকেন্দ্রিক সবধরনের বই প্রকাশ করি। এবারে আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ‘শিশু-কিশোর সমগ্র’, ‘এলিয়েন বন্ধু’, ‘ছোটদের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা.)’সহ অনেকগুলো বই বেরিয়েছে। এবারের বিক্রি খুব ভালো। শিশুপ্রহরের আগেও ভালো বিক্রি ছিল। পরে আরও বেড়েছে।”

বইমেলায় যত বই প্রকাশ হলো

এবারের বইমেলায় সর্বমোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩ হাজার ৪১৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ হয়েছে কবিতার বই। কবিতার বই যেকোনো কিছুর চেয়ে যোজন-যোজন এগিয়ে। বইমেলায় এবার নতুন কবিতার বই এসেছে ১ হাজার ৬০টি। তবে উপন্যাস কম আসেনি বইমেলায়। এবার নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ৫০১টি।

এছাড়া ৪৬৭টি গল্পের বই, ১৭৯টি প্রবন্ধ, ১১২টি গবেষণাধর্মী, ৬৪টি ছড়া, ৯৪টি শিশুতোষ, ১০৩টি জীবনী, ১৭টি রচনাবলী, ১০২টি মুক্তিযুদ্ধ, ১৭টি নাটক, ৪৮টি বিজ্ঞান, ৫৬টি ভ্রমণ, ৭২টি ইতিহাস, ২৪টি রাজনীতি, ২১চিকিৎসা, ৮৫টি বঙ্গবন্ধুবিষয়ক, ১৭টি রম্য, ৪০টি ধর্মীয়, ৪০টি অনুবাদ, ১০টি অভিধান, ৫৬টি সায়েন্স ফিকশন/গোয়েন্দা, ২৪১টি অন্যান্য বিষয়-সংশ্লিষ্ট বই প্রকাশ পেয়েছে।

সারাবাংলা/আরআইআর/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন