বিজ্ঞাপন

মুনঈমের আঁকা ছবিতে মায়ের বেঁচে থাকার সার্থকতা

April 14, 2018 | 8:04 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: আশহাব মুনঈম চৌধুরীর বয়স ১১ বছর। আর দশটা সাধারণ শিশুর মতো নয়। ব্যথা পেলে কাঁদে না, আনন্দের সংবাদে হাসে না, মনের কথা বলে না। তবে মুনঈম খুব ভালো গান গায়, কোন তারিখ, কী বার- সেটা বলতে পারে, আর মুনঈম খুব ভালো ছবি আঁকে।

আর মুনঈমের আঁকা ছবিই খাদিজাতুল কোবরার বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। কারণ, আশহাব মুনঈম এক অটিস্টিক শিশু। চারপাশে যখন এই ছেলেকে নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়, তখন ছেলের আঁকা এই চিত্রকর্ম মাকে ভাসিয়ে নেয় আনন্দের জোয়ারে। সার্থক করে তোলে জীবন।

আজ পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে তরী ফাউন্ডেশন মুনঈমে আঁকা ছবি দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। সেই ছবি চিকিৎসক মা খাদিজাতুল কোবরা সবার সঙ্গে শেয়ার করছেন- বলছেন, এটা তার বৈশাখের সেরা উপহার।

বিজ্ঞাপন

কেবল এবারই নয়, এর আগেও মুনঈমের আঁকা ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ডেও স্থান পেয়েছিল মুনঈমের আঁকা ছবি। ২০১৪ সালে ইউনিলিভারের ক্যালেন্ডারে, এরপর ২০১১, ১২, ১৩ এবং ২০১৪ সালে দৃক গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত ফটো এক্সিবিজিশনেও পরপর চারবার ছিল বিশেষ এই চাহিদা সম্পন্ন শিশুর হাতে আঁকা ছবি।

চলতি বছরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের টেবিল ক্যালেন্ডারে রয়েছে তার আঁকা ছবি।

বিজ্ঞাপন

খাদিজাতুল কোবরা বলেন, গত বছর যখন প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ডে ওর ছবি যায়, তখন সে কী আনন্দ হয়েছিল আমাদের! ছেলেটা কিন্তু এত কিছু বোঝেনি, কিন্তু কিছু একটা যে করেছিল সেটা বুঝেছিল, আমাদের আনন্দ দেখে ওর মুখেও হাসি ফুটেছিল।

স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন-এর দ্বিতীয় বছরের শিক্ষার্থী মুনঈমের মা ডা. খাদিজাতুল কোবরা বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বরত। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এমনিতে ও খুব ট্যালেন্ট, কিন্তু নিজে থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে না, নিজে থেকে কিছু করবে না। মুনঈম অটিজমে আক্রান্ত এক বিশেষ শিশু। মুনঈম যখন আড়াই বছরের তখন তার অটিজম ধরা পরে।

খাদিজাতুল কোবরা সারাবাংলাকে বলেন, চিকিৎসকরা স্কুলে গেলে ভালো থাকবে বললেও মূল ধারার স্কুলগুলোতে ছেলেকে ভর্তি করাতে পারেননি তিনি। শেষে ছেলেকে ভর্তি করান স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন-এ। সেখানে ছেলে খুবই ভালো করছে।

বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের চাকরিটাই তিনি করছেন, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন না জানিয়ে খাদিজাতুল কোবরা বলেন, একবেলা চাকরি করি আর একবেলা ছেলেটাকে সময় দেই। কারণ, ছেলেটাকে তিনি তৈরি করে দিয়ে যেতে চান।
“যতটুকু আমি ছেলেটাকে তৈরি করে দিয়ে যেতে পারি। আমার লক্ষ্যই হচ্ছে, আমার ছেলেটা যেন পরনির্ভরশীল না হয়। খুব ভালো গান করে, ছবি আঁকে, খুব ভালো সবজি কাটে, রান্না করতে পছন্দ করে।”

বিজ্ঞাপন

কোনো রেস্তোরাঁয় সবজি কাটার কাজ করে হলেও যেন ছেলেটা আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। আমি যখন থাকব না তখন যেন কারো ওপর ওকে নির্ভর করতে না হয়- সে জন্যই আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, বলেন তিনি।

ছেলের আঁকা ছবি চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, কেমন লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব ভালো লাগে। যেখানে চারিদিকে কেবল অপ্রাপ্তি, সেখানে আমার এই ছেলের প্রতিভা আমাকে আনন্দিত করে। জীবনটাকে মনে হয় খুব আনন্দের, বেঁচে থাকার এটাই সার্থকতা। আমি মুনঈমের জন্যই খুশি- আমি এতটুকুতেই অনেক খুশি।

চারপাশে নানা রকম মানুষ, এসব শিশুদের জন্য সচেতনতা সবার মধ্যে তৈরি হয়নি। নানা কথা শুনেছি এতদিন। অনেকেই ছেড়ে কথা বলে না। আমার ছেলেটা অটিস্টিক- সেটা সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন, যেখানে আমার কোনো হাত নেই, তাই তার এইটুকু প্রাপ্তি আমার কাছে বড়।

যে ছেলের জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে, শুনতে হয় সেই ছেলের জন্যেই এখন গণমাধ্যমে কথা বলার সুযোগ হয়, অন্য মায়েদের সাহস দিতে পারি, বলেন খাদিজাতুল কোবরা। তিনি বলেন, তরী ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার রয়েছে এমন শিশুদের জন্য মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছিল ‘বলতে চাই’। সেটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছে। সেখানে মুনঈমকে নিয়ে বলা আমার বক্তব্য রয়েছে। ছেলের জন্যই এতটুকু যেতে পেরেছি। ছেলেটাও যেন অনেক দূর যেতে পারে- সেই চেষ্টা করছি।

তরী ফাউন্ডেশন ও স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন’র পরিচালক মারুফা হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, গত পরশু সকালে অফিসে গিয়ে দেখি আমার টেবিলে মুনঈমের এই উপহার রাখা ছিল। আর সেটা ছিল আমার জন্য মন ভালো করা ছবি। এই ধরনের শিশুদের প্রথমে সহজ আকৃতির ছবি আঁকতে শেখানো হয়। যেমন, বাড়ি, ঘর। মুনঈমের এই ছবিটা ছিল ওদের তুলনায় অনেক কঠিন। আর বৈশাখের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। তাই আমরা এই ছবি দিয়ে শুভেচ্ছা কার্ড করেছি।

সারাবাংলা/এটি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন