বিজ্ঞাপন

‘স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা মেয়েদের অপমান করাই যায়’

April 1, 2022 | 12:31 am

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: যেসব মেয়ে আচরণ ও পোশাকে সামাজিক আচরণ মানেন না, স্বাধীনভাবে চলতে চান এবং আচরণে নারী-পুরুষ বিভেদ করেন না বলে মনে হয়, তাদের প্রতি কটূক্তি, সমালোচনা, তীর্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করা যেতেই পারে বলে মনে করেন শতকরা ৬৪ জন মানুষ। এরমধ্যে নারী শতকরা ২৯ জন, পুরুষ শতকরা ৩৪ জন।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, শতকরা ৫৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন— যেসব মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় বা যৌন হেনস্তার শিকার হয়, তাদের নিজেদেরও দোষ আছে। অন্যদিকে, শতকরা ৮১ শতাংশ মানুষ মনে করেন— মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পরলে, অশালীন আচরণ করলে, খারাপ ভাষা ব্যবহার করলে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করলে, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয়। এমন মনোভাব পোষণকারীদের শতকরা ৩৯ জন নারী, ৪২ জন পুরুষ। আবার ৫২ শতাংশ মানুষ মনে করেন— মেয়েদের মিডিয়া বা সিনেমায় কাজ করা, রাতের শিফটে কাজ করা বা দূর-দূরান্তে পুরুষের সঙ্গে ভ্রমণ বা কাজে যাওয়া ঠিক নয়। এর মধ্যে ২১ শতাংশ নারী, ৩১ শতাংশ পুরুষ।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক এক গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, সেক্সিজম হচ্ছে মন্দ মেয়েদের শায়েস্তা করার একটি হাতিয়ার। মেয়েদের বিভিন্ন ভালো বিষয়ে সফল হতে উৎসাহী করা ও মন্দ বিষয়ে বাধা দেওয়া এবং তাদের নিরাপদে রাখা পুরুষের দায়িত্ব বলে মনে করেন ৮০ শতাংশ মানুষ, যাদের মধ্যে নারী ৩৫ শতাংশ ও পুরুষ ৪৫ শতাংশ।

নারীর প্রতি সহিংসতা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গবেষণাটি করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। বেসরকারি সংস্থা ডি-নেট দেশব্যাপী এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডি-নেট-এর ইনোভেশন অ্যাডভাইজার সিরাজুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

গবেষনায় পর্নোগ্রাফি ইস্যুটি নতুনভাবে ও ভিন্নভাবে উঠে এসেছে। ভিডিওতে বাংলায় অশ্লীল গল্প বলা, যৌনপল্লী থেকে সরাসরি, অশ্লীল খবর ও গল্প, বাংলা ইমোতে ভিডিও সেক্স, ওয়েব সিরিজগুলোতে অশ্লীলতা, বাংলা যৌন কামনা উদ্রেককারী ব্লগ, বাংলা ইমো ভিডিও সেক্স প্রমোশন, রিয়েল অ্যান্ড ভার্চুয়াল সেক্স সার্ভিস গ্রুপস ইন ফেসবুক, ইমো সেক্স সার্ভিস কাস্টমার ফেসবুক অ্যান্ড অথিনটিকেশন ইত্যাদি কনটেন্ট পাওয়া গেছে।

এসব কনটেন্টে নারীর প্রতি টিটকারি, অবমাননা, প্রতিশোধ, ভার্চুয়াল সেক্স, সেক্স ট্রেড প্রোমো, অশ্লীলতা এবং নিউজ প্রোমোর উপস্থিতি দেখা গেছে। এমজেএফ মনে করছে, অনলাইনে নারীর অবমাননাকর যে ইমেজ দেখানো হয়, তা সমাজে প্রচলিত ‘মন্দ মেয়ে’র ইমেজকে আরও শক্তিশালী করে।

বিজ্ঞাপন

গবেষণায় দেখা যায়, ৭৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন— সমাজে মেয়েরা ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’— এই দুই ধরনের হয়। সাধারণত একটি মেয়ে ‘ভালো’ না ‘মন্দ’— এটি নির্ধারিত হয় যারা কথা বলার সময় অশালীন শব্দ ব্যবহার করে (৬২ শতাংশ), পাশ্চাত্যের মতো পোশাক পরে (৫২ শতাংশ), অবাধ্য (৫৭ শতাংশ), অনলাইনে বেশ আকর্ষণীয় উপস্থিতি (৫৪ শতাংশ), সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা (৩৬ শতাংশ), ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা (৩৮ শতাংশ) এবং পোশাক (৩৮ শতাংশ)।

যখন কেউ ‘মন্দ’ মেয়ে বা নারীর মতো আচরণ করেন, তখন তার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করেন ও টিটকারি কাটেন শতকরা ৭১ জন পথচারী, এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী ও ৩৮ শতাংশ পুরুষ। বিরূপ মন্তব্যকারীদের মধ্যে শতকরা ৭৫ জন প্রতিবেশী, পরিবারের সদস্য শতকরা ৪৮ জন, আত্মীয় শতকরা ৬৪ জন এবং অপরিচিত মানুষ ৬৩ জন।

‘মন্দ’ মেয়ের মতো আচরণ সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সেটি অন্য ছেলেমেয়েদের নষ্ট করে ফেলবে বলে মনে করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা। এর মধ্যে নারী শতকরা ৩৬ জন এবং পুরুষ শতকরা ৪২ জন। এ কারণে অনলাইনে ‘মন্দ’ মেয়ের মতো আচরণকারীদের এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত রাখার জন্য তাকে হেয় করা, মন্দ বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করেন শতকরা ৪৪ জন উত্তরদাতা। এর মধ্যে নারী ১৮ শতাংশ ও পুরুষ ২৫ শতাংশ।

এদিকে, জরিপে অংশ নেওয়া ৬৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন— মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা দিলে তারা পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং শতকরা ৫৮ জন মনে করেন— মেয়েরা প্রায়ই ছেলেদের নির্দোষ আচরণকেও নির্যাতন মনে করে।

বিজ্ঞাপন

গবেষণায় দেখে যায়, ৮১ শতাংশ মানুষ মনে করেন— অসংখ্য কিশোর, যুবক ও পরিণত বয়সের পুরুষ নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট নিয়মিত দেখে থাকেন। দেখা গেছে, যেসব পর্নোগ্রাফিক আধেয় দেশীয়ভাবে বা রূপে তৈরি হয়েছে, সমাজে যেগুলোর প্রভাব ও বিস্তার অত্যন্ত বেশি। আর এখানে দেশীয় পর্নোগ্রাফি অশ্লীলতার চেয়েও বেশি ব্যবহৃত হয় নারীকে নিন্দা, নির্যাতন ও অপমান করার জন্য। আবার দেশীয় অনলাইন ও মিডিয়াতে নারীর প্রতি অবমাননাকর, নারীর অশালীন দেহ প্রদর্শন, যৌন আবেদনময় ও পর্নোগ্রফিক কনটেন্ট বা আধেয় বাড়ানোর পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কিছু মেয়ে বা নারী ছেলে বা পুরুষদের প্রলুব্ধ করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সচেষ্ট থাকে বলে এই গবেষণায় উঠে এসেছে।

অনলাইনে ‘মন্দ’ কনটেন্ট যেমন— অ্যাডাল্ট মুভি, ন্যুডিটি, পর্নোগ্রাফি শতকরা ৭৫ জন ছেলেরা দেখে থাকে বলে উত্তরদাতারা মনে করেন। এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ নারী ও ৩৭ শতাংশ পুরুষ।

ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন— তাদের সুখী ও নিরাপদ জীবন নিয়ে সমাজে অনিশ্চয়তা, ভীতি ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে বলে মনে করেন ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা, যার ৪৪ শতাংশ নারী ও ৪৬ শতাংশ পুরুষ। আবার ৭৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন— একটি মেয়ের জীবন তখনই সফল হয়, যখন একটি উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

যখন মেয়েরা ‘মন্দ’ মেয়েদের মতো আচরণ করেন অথবা অনলাইনে ‘মন্দ’ মেয়ের মতো আচরণ করেন, তখন তাকে সবচেয়ে বেশি শাসন করেন মা— এমনটি মনে করেন ৮৯ শতাংশ মানুষ। এছাড়া বাবা (৮৪ শতাংশ), ভাই-বোন (৮৪ শতাংশ), শিক্ষক (৭২ শতাংশ), আত্মীয়-স্বজন (৬৯ শতাংশ) ও বন্ধুরাও (৪৬ শতাংশ) তাদের শাসন করেন।

‘ভালো মেয়ে’ ও ‘মন্দ মেয়ে’ নিয়ে সমাজে প্রচলিত স্টেরিওটাইপ বা বহুল প্রচলিত ধারণার আলোকে মনে করা হয়— ‘মন্দ মেয়ে’রা ‘মন্দ ছেলে’দের চেয়ে বেশি বিপদজনক। এটি মনে করেন ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা, যার ৩২ শতাংশ নারী ও ৪২ শতাংশ পুরুষ। তারা বলছেন, এই ‘মন্দ মেয়ে’রা নায়িকাদের মতো যৌন আবেদনময়ী আচরণ অথবা পশ্চিমা সংস্কৃতির পোশাক পরেন ও আচরণ অনুসরণ করেন কিংবা টিকটক-লাইকি ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে অনলাইনে ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করেন।

ধর্মীয় নিয়ম অনুসরণকে ‘ভালো’ মেয়ের লক্ষণ বলে মনে করেন জরিপে অংশ নেওয়া ৬৬ শতাংশ মানুষ। এ ক্ষেত্রে হিজাব পরাকে ৪৪ শতাংশ, নিজেকে আকর্ষণীয় করে অনলাইনে না আসাকে ৪৯ শতাংশ , ছেলেদের সঙ্গে না মেশাকে ৪১ শতাংশ এবং অনলাইনে অ্যাকাউন্ট না থাকাকে ৩৮ শতাংশ মানুষ ‘ভালো’ মেয়ের লক্ষণ বলে মনে করেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংস ও নির্যাতনমূলক আচরণ বেড়েছে বলে মনে করেন ৮২ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী, পুরুষ ৪২ শতাংশ।

গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তরদাতারা মোবাইল ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করেন। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এ ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে স্মার্টফোনের ব্যবহারের হার অনেক বেশি। ৫১ শতাংশ ছেলে ও ৩৯ শতাংশ মেয়ে ফেসবুক ব্যবহার করেন। ইমো ব্যবহারে ছেলেদের হার ২৯ শতাংশ, মেয়েদের ২০ শতাংশ। এছাড়া টিকটক, লাইকি ও ইনস্টাগ্রামের মতো মাধ্যম মেয়েদের কাছে খুবই জনপ্রিয় বলে মনে করেন ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা, যাদের মধ্যে পুরুষ ৪৫ শতাংশ ও নারী ৩৮ শতাংশ।

দেশের আটটি বিভাগের ১৬টি জেলায় ৫১৮ জন ব্যক্তির ওপর এই জরিপটি করেছে এমজেএফ। ডেস্ক রিসার্চ, অনলাইন রিসার্চ, হাইপোথিসিস, সার্ভে ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। প্রতিটি সেন্টার থেকে ৩০ জন, গ্রাম ও শহর এলাকায় ৫০ শতাংশ করে নারী ও পুরুষ স্যাম্পল ধরা হয়েছে। গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যৌনতা, পর্নোগ্রাফি, সেক্সিজম ইত্যাদি ট্যাবু বিষয়ের ওপর গবেষণা করাটা ছিল খুবই কঠিন। এমনকি মুক্তমনা বলে পরিচিত দেশগুলোতেও পর্নোগ্রাফি নিয়ে যথেষ্ট তথ্য নেই।

অনুষ্ঠানটি মডারেট করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, পরিচালক আশফাক নিপুণ, সেইভ দ্য চিলড্রেনের সেক্টর ডিরেক্টর (সিপি অ্যান্ড সিআরজি) রেহনুমা ই জান্নাত, সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর ও সিনিয়র সাংবাদিক নওরোজ ইমতিয়াজ।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, কেবল পর্ন সাইট বন্ধ করা এই সমস্যার সমাধান নয়। কারণ এখন অনেকে অনেকভাবেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত। টিভি নাটক, সিরিয়াল, কিছু ওয়াজ ও বাংলা সিনেমায় সেক্সিজম ও নারীবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। দেশীয় পর্নোগ্রাফি কনটেন্টে কোনো বিধিনিষেধ নেই বলে তা সহজেই শিশুর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এছাড়া পর্নোগ্রাফি কেবল অশ্লীলতার জন্য হলে সেটি সহিংসতা ছড়ায় না। কিন্তু দেশীয় পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট নারী বা মেয়েকে ‘ভালো মেয়ে’ ও ‘মন্দ মেয়ে’র তকমা এঁটে দিচ্ছে। সমাজও সেভাবেই তাদের বিচার করছে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন