বিজ্ঞাপন

‘দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ’

April 2, 2022 | 9:35 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের বড় চ্যালেঞ্জ বাজেট ও সেবার মান বাড়ানো। সেবার মানের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক আছে। আমি খুবই হতাশ বাংলাদেশের সমসাময়িক (২০২১ সাল) স্বাস্থ্যসেবায় খরচ হওয়া জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) রেশিও সাউথ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (২ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ আয়োজিত ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, সুইডেন দূতাবাস ও প্রথম আলো।

বিজ্ঞাপন

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দেশের উচ্চবিত্তরা বিদেশে চিকিৎসা নেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও হাসপাতালের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তাই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যাপারে তাঁরা কোনো দায়বোধ করেন না।

তিনি আরও বলেন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মানে তারতম্য আছে। এ তারতম্য বৈষম্য সৃষ্টি করে। এ ব্যয় স্বল্প আয়ের দেশের তুলনায়ও কম। কিন্তু তার তুলনায় প্রাইভেটভাবে স্বাস্থ্যখাতেই ভালো পরিমাণে অগ্রগতি হয়েছে। তবে সেকারণে চিকিৎসা খরচের ৬৭ শতাংশের বেশি ব্যক্তির পকেট থেকে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। তবে উচ্চবিত্ত শ্রেণি বিদেশে চিকিৎসা নেয় বলে দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতের বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা মোকাবিলায় একটি কমিশন গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।

বক্তারা আরও বলেন, চলমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশে যেখানে বিনামূল্যে ও অতি সহজ উপায়ে জনগণকে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। স্বাস্থ্যনীতি থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। এছাড়া অন্যান্য দেশে জিডিপির বড় একটা অংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করলেও বাংলাদেশ সেখানে এক শতাংশের কম। ফলে বিনিয়োগ না বাড়ায় অনেককিছু অগ্রগতি হলেও পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহবায়ক আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী।

তিনি বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতা মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। আর্থসামাজিক উন্নতির একটি বড় সূচক গড় আয়ু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৩ বছর। স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৪ বছর হয়েছে। এ সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে।

বিজ্ঞাপন

নতুন বইটি স্বাস্থ্য ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মোশতাক রাজা চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. রওনক জাহান।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে দেশে তেমন লেখালেখি নেই। একই সঙ্গে তথ্যপ্রুযক্তি, অর্জনের সঙ্গে কোথায়, কেন আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ঘাটতি সেগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে বইটিতে। বাংলাদেশের যে অর্জন সেটি আমরা কেবল দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করি। পাশের নেপালও আমাদের অনেক ছোট মনে করে।

তিনি আরও বলেন, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আমরা কতটা এগোতে পেরেছি সেটি দেখা উচিত। থাইল্যান্ড গত ৬০ বছরে সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে। কীভাবে পেরেছে, সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের সঙ্গে কেন তুলনা করি না আমরা?

স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় অনিয়ম–দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা বিষয়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না। এটা চলতে দেওয়া যায় না।

অনুষ্ঠানে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে আমরা সবাই জানি। বিশ্বে আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে ইতিবাচক ধারণা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি ছিল, আর এখন কি অবস্থা সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেইসঙ্গে ২০০৯ সালের পর বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যখাতে কী পরিবর্তন করেছে সেগুলোও আলাদাভাবে আলোচনায় এলে আরও ভালো হতো।

তিনি বলেন, অনেক দেশ জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ ব্যয় করে স্বাস্থ্যখাতে, আমাদের এক শতাংশেরও কম। তারপরও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এগিয়েছে। যেটি ইতিবাচক। তবে অনেক অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। আমাদের পুষ্টি এখনো ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। এটির পরিবর্তন হওয়া দরকার।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ব্যক্তি খরচ অনেক বেশি। অভ্যন্তরীণ রোগীরা বিনামূল্যে ওষুধ পেলেও বহির্বিভাগে এখনো সেটি সেভাবে করা যায়নি। ফলে এ ব্যয় বেড়েই চলেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ক্লিনিক, জেলা সদর হাসপাতালসহ চিকিৎসার প্রতিটি স্তরে যে জনবল সংকট সেটিরও সমাধান দরকার।

জেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে রুহুল হক বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জেলাভিত্তিক পরিচালনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিয়মিত ডাক্তার থাকা, টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা রেফারেল সিস্টেম চালু করতে না পারব, ততদিন এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, উপজেলা পর্যায়ে একজন চিকিৎসক দুই সপ্তাহের ছুটিতে গেলে কয়েকদিনের জন্য আরেকজন চিকিৎসক এনে বসানো হয়। কিন্তু চিকিৎসক যদি পর্যাপ্ত থাকত, তাহলে এমনটা হতো না। মানুষও ঠিকমতো সেবা পেত। আমাদের অবকাঠামো অনেক ভালো। সঙ্গে যদি এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে প্রকৃতপক্ষেই মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সির (সিডা) স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যে যে বৈষম্য বাড়ছে, সেটি খুবই দুঃখজনক। এ জন্য এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, অনেক মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। গড় আয়ু বাড়লেও স্বাস্থ্যসেবা ভালো না হওয়ায় শেষ সময়ে গিয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বয়স্করা। এজন্য একটি স্বাস্থ্য কমিশন জরুরি। সরকার যদি নাও করে ব্যক্তি উদ্যোগে হলেও এটি হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো বৈষম্যহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আমাদের সংবিধানেও এটি ভালোভাবে বলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে যে নারী আন্দোলন হয়েছে, এর মধ্যে নারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, নিরাপদ গর্ভপাত রক্ষা করাসহ অনেক কাজ করেছে নারীরা। নারীর ক্ষমতায়নে নারীর অধিকার নিয়ে, পুরুষদের সচেতনতা নিয়ে কাজ করেছে মহিলা পরিষদ।

অনুষ্ঠানে সুইডিশ দূতাবাসের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম বলেন, বাঙালি একাই এক শ। কিন্তু এক শ বাঙালিকে এক করা যায় না। ৯৯ জন লেখককে একটি কাজে যুক্ত করে প্রায় অসাধ্যসাধন করেছেন উদ্যোক্তারা। তিনি বলেন, আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে একটি কমিশন করা দরকার।

আলোচনার শুরুতে লেখকদের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের পুষ্টি কর্মকর্তা আসফিয়া আজিম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কত পথ কীভাবে পাড়ি দিল, তার বর্ণনা আছে এ বইয়ে। ভবিষ্যতে যাঁরা স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করবেন, কাজ করবেন, তাঁদের বারবার ফেরত যেতে হবে এ বইয়ের কাছে।

অনুষ্ঠানে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যে মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশ হওয়া দরকার, কিন্তু আমাদের ব্যয় মাত্র ছয় শতাংশ। এটা দুঃখজনক। এছাড়াও আমাদের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আবার হাসপাতালগুলোতে নানা অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি আছেই। অনেক দামি দামি একুইপমেন্ট কেনা হয়, কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। হাজারো অনিয়মেও স্বাস্থ্যখাতের এই এগিয়ে চলা এক বিস্ময়।

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক খায়রুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা নোশিন সাইয়ারা।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ’ গ্রন্থে দেশি ও প্রবাসী ৯৯ জন জনস্বাস্থ্যবিদ, গবেষক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, শিক্ষক এবং সাংবাদিক তাদের লেখনীর মাধ্যমে গত পাঁচ দশকে স্বাস্থ্য খাতে কী কী পরিবর্তন এসেছে, কতটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, এবং তা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কতটা অনন্য তা তুলে ধরেছেন।

 

সারাবাংলা/এসবি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন