বিজ্ঞাপন

গুডবাই করোনা: কলেরার থাবা

April 9, 2022 | 4:59 pm

মোস্তফা কামাল

আনুষ্ঠানিক না হলেও বা কর্তৃপক্ষীয় ঘোষণা না এলেও দেশের মানুষ মোটামোটি করোনাকে গুডবাই দিয়েছে। করোনা গুডবাই দিয়েছে কি না তা করোনাই জানে। তবে, প্রায়ই করোনায় মৃত্যশূণ্য দিন পাচ্ছে বাংলাদেশ। কোনো দেশের জন্য এটি কতো আশীর্বাদের তা অল্পতে বলে শেষ করার মতো নয়। কিন্তু, এর মাঝে হঠাৎ ডায়রিয়ার হানা বিপদ কেটে আপদের মতো। প্রায় মাস খানেক ধরে রোগীর বেদম চাপ ঢাকার মহাখালিতে কলেরা হাসপাতাল নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবিতে। প্রতিদিন ১৩-১৪ পর্যন্ত রোগী ভর্তির রেকর্ড তৈরি হয়েছে। রোগীর চাপ সামলাতে আইসিডিডিআরবি প্রাঙ্গণে কয়েকটি তাঁবু টানানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিষ্ঠানটির ৬২ বছরে রোগীর এমন চাপ দেখা যায়নি বলে উদ্বেগের তথ্য জানানো হয়েছে আইসিডিডিআরবি থেকে। আগামী কয়েকদিন ডায়রিয়া রোগী বাড়তে পারে বলে হালঅবস্থা দেখে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। আরো শঙ্কার খবর হচ্ছে, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ২৩ শতাংশের মধ্যেই মিলছে কলেরার জীবাণু। এর মূল কারণ দূষিত পানি। অবস্থা এবারের মতো ভয়াবহতায় না গেলেও প্রতিবছরই এই মৌসুমে ডায়রিয়া রোগী বাড়ে। গরমের মধ্যে পানির চাহিদা বাড়লে পানিবাহিত এই রোগটির প্রকোপ দেখা যায়। আইসিডিডিআরবির সেই আলোকে প্রস্তুতিও থাকে। কিন্তু, এবার পরিস্থিতি ধারনাকে ছাড়িয়ে গেছে।

এবার আগের হিসাব বা ধারনা মিলছে না। পুরনো মহামারির নতুন করে আবির্ভাব ঘটলে ভয়াহতা বেশি হয়। কলেরা নিয়ে বেশি শঙ্কা এখানেই। প্রথমদিকে রোগী বেশি ছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মোহাম্মদপুর ও দক্ষিণখান এলাকার। পরে সেখানে যোগ হতে থাকে ঢাকার আশপাশের এলাকার মানুষ। এর মাঝে গবেষণার বিস্তর উপাদান রয়েছে। এডিস মশাবাহিত চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসার পর ভর করেছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা। এর যাই-যাই অবস্থায় হঠাৎ ডায়রিয়া। সঙ্গে কলেরার জীবানু। হঠাৎ কেন ডায়রিয়ার প্রকোপ বা ঢাকাসহ আশপাশ কেন এর হটস্পট- এ সংক্রান্ত গবেষণা কম। গবেষণার আওতা আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ভাইরাস নামের অদেখা জীবানু নতন নয়। কলেরা, অ্যানথ্রাক্স, পীত জ্বর, গুটি বসন্ত, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, প্লেগ ইত্যাদি মহামারি পৃথিবী ওলটপালট করে দিয়েছে। এক সময় দেশে-দেশে কলেরা মহামারীতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তা মোকাবেলাও হয়েছে। তবে, কোনোটি ফিরে এলে ভয়টা বেশি দেখা দেয়। কলেরা নিয়েও সে ধরনের কিছু আতঙ্ক কাজ করে। কলেরার মহামারি শুরু ১৮০০ সালের শুরুর দিকে। তখন একে ডাকা হতো “ওলা বিবি” নামে এবং বলা হতো ওলা বিবি যেই গ্রাম দিয়ে যায় সেই গ্রামকে নিঃস্ব করে দিয়ে যায়। এর একমাত্র কারণ হলো এই রোগ নিয়ে সেসময়ের অজ্ঞতা।

বিজ্ঞাপন

কলেরা মূলত একটি পানিবাহিত রোগ। এর পেছনে দায়ী “ভিবরিও কলেরা” নামের ব্যাকটেরিয়া যারা পানি এবং খাবারকে দূষিত করে আক্রান্ত ব্যাক্তির মলের মাধ্যমে। এখন কলেরার সেই ভয়াবহতা না থাকলেও, টিকাসহ এর দাওয়াই থাকলেও সমীক্ষায কিন্তু বাজে তথ্য দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষানুযায়ী প্রতি বছর ২১০০০ থেকে ১৪৩০০০ লোক মারা যাচ্ছে কলেরায়। সূচনা কাল থেকে এখন পর্যন্ত কলেরার ৭ বার মহামারীতে বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। উনিশ শতকে এর ভয়াবহতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, একমাত্র রাশিয়ায়, ১৮৪৭-১৮৫১ সালের মধ্যে ১০ লক্ষেরও বেশি লোক এই রোগে মারা গিয়েছিল। ১৯০০ এবং ১৯২০ সালের মহামারীতে ৮০ লক্ষের মতো মানুষ মারা গিয়েছিলো ভারতে। এছাড়াও এর ভয়াবহতার কবলে পড়েছে চীন, ইন্দোনেশিয়া সহ এশিয়ার অনেক দেশ। ইয়েমেনে ২০১৭ সালে এই কলেরার কারণে মাত্র এক সপ্তাহে ১১৫ জনের মৃত্যু হয়। কলেরার সর্বশেষ মহামারী দেখা গিয়েছিলো ২০১০ সালে, ভয়াবহ এক ভুমিকম্পের পর হাইতি তে কলেরায় প্রায় আট লক্ষের বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এবং সেই মহামারীতে ৯০০০ মানুষ মারা গিয়েছিলো। কলেরার একমাত্র চিকিৎসা শরীরের হারিয়ে যাওয়া তরল এবং খনিজ পুনরায় শরীরে ফিরিয়ে আনা।

বিদায়ী করোনার চিকিৎসা আসতে সময় লেগেছে খুব কম। এতো কম সময়ে বিশ্বে আর কোনো মহামারির চিকিৎসা বা প্রতিষেধক আসেনি। প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, যক্ষা, গুটিবসন্তের টিকা পেতে যুগের পর যুগ চলে গেছে। কলেরার দাওয়াই খুঁজতেও তাই। রোগটির কারণ জানতেই লেগে গেছে বছরের পর বছর। উনিশ শতকে বিভিন্ন দেশে কলেরায় লাখ লাখ লোকের মৃত্যুর সময় বিজ্ঞানীদের জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এর বিস্তারের রহস্য ভেদ করা। চিকিৎসকরা হিমশিম খেয়েই গেছেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের মানুষ তখন মনে করত দুর্গন্ধময় বাতাসের মাধ্যমে কলেরা ছড়ায়। সেই সময় ব্রিটিশ চিকিৎসক জন স্নো প্রথম ধরতে পারেন কলেরার জীবাণু সংক্রমিত পানির মাধ্যমে ছড়ায় রোগটি। সহজসাধ্য ছিল না তার সেই তত্ত্ব প্রমাণ দাঁড় করানো। দীর্ঘ গবেষণা ও চর্চায় কলেরা বিদায় হয়েছে দুনিয়া থেকে। কলেরা নিয়ন্ত্রণ যোগ্য বিবেচিত হওয়ার পর এর নাম হয়েছে ডায়রিয়া। খাবার স্যালাইন নামের সামান্য শরবত বা পানীয়তেই তা সেরে যাচ্ছে। এর মূল দাওয়াই বিশুদ্ধ পানি। কেবল চিকিৎসক নন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলেছেন, নগরীতে দূষিত পানির কারণেই কলেরার বিস্তার। কিন্তু, ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খান তা মানতে নারাজ। খাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলেও তিনি সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছেন সমানে। শুনিয়েই যাচ্ছেন। তারওপর এমন কঠিন সময়ে ‘ড্রিংকিং’ আর ‘ড্রিঙ্কেবল’ ওয়াটার এর তফাৎ বুঝিয়েছেন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন