বিজ্ঞাপন

মঙ্গল কামনার বৈসাবি

April 12, 2022 | 5:37 pm

চলন্ত চাকমা, চবি করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: গত দুই বছর করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে ম্লান হয়ে পড়েছিল জু-সাংক্রাই-বৈসু-বিষু-বিহু-চাংক্রান তথা পাহাড়ের প্রধান সমাজিক উৎসব। গত বছর করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সে উৎসব আয়োজন করা হয়েছিল, তবে তা সীমিত পরিসরে। তবে এবার জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে মেতে উঠছেন পাহাড়ের জনগোষ্ঠীরা।

বিজ্ঞাপন

ঐতিহ্যবাহী সামাজিক রীতিনীতি পালনে মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে বর্ষবরণের এই উৎসব। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠরাও নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানান। এসময় তারা মঙ্গলকামনায় প্রার্থনাও করেন।

রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হৃদ, খাগড়াছড়ি চেঙ্গী নদী, দীঘিনালা মাইনী নদীসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে ফুল বিজু পালন করা হয়েছে। শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের যারা বাড়িতে যেতে পারেননি, তারা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মতো করে এই উৎসবে সামিল হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

এর আগে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়িতে বিজু মেলা, র‌্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা ও ঐতিহ্যবাহী বলি খেলাও আয়োজন করা হয়। এসব আয়োজনে পুরনো দিনের দুঃখ-বেদনা ভুলে নতুন দিনের পথচলার আশার সঞ্চারিত হয়। নতুন বছরে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বয়ে আনবে— এমন প্রত্যাশা সবার।

ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসু, মারমাদের ভাষায় সাংগ্রাই, ম্রোদের ভাষায় চাংক্রান, খিয়াংদের ভাষায় সাঙলান, খুমিদের ভাষায় সাংক্রাই, চাকমাদের ভাষায় বিজু, তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় বিষু, অহমিয়াদের ভাষায় বিহু— পাহাড়ি সম্প্রদায়ের প্রাণের এই উৎসবকে সম্মিলিতভাবে ‘বৈসাবি’ নামেও ডাকা হয়।

উৎসবে চাকমা ও তনচংগ্যাদের প্রথম দিন ফুল বিজু-বিষু, দ্বিতীয় দিন মূল বিজু-বিষু, তৃতীয় দিন গোজ্যেপোজ্যে দিন। মারমারা প্রথম দিন পাইংছোয়াই, দ্বিতীয় দিন সাংগ্রাইং আক্যা, তৃতীয় দিন সাংগ্রাইং আপ্যাইং পালন করে। ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রথম দিন হারিবৈসুক, দ্বিতীয় দিন বৈসুকমা, তৃতীয় দিন বিসিকাতাল নামে এই উৎসব পালন করা হয়। এভাবে প্রত্যেক বছর আনন্দ-উৎসবে পালিত হয়ে আসছে উৎসবটি।

বিজ্ঞাপন

চৈত্রের শেষ দুদিন ও নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ এই উৎসব পালন করা হয়। বিজু উৎসবের তিন দিন হলো— ফুল বিজু, মূল বিজু ও গোজ্যাপোজ্যা দিন। ফুল বিজুর দিন ভোরের আলো ফুটার আগেই ছেলেমেয়েরা ফুল সংগ্রহ করে। পরে নদীতে গঙ্গা মা’র উদ্দেশে ফুল উৎসর্গ মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব। ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়।

এছাড়া কলা পাতায় ফুল নদী, ছড়া বা পুকুরে গিয়ে পানির দেবী ‘গঙ্গা মা’র উদ্দেশে ফুল উৎসর্গ করা হয়। একইসঙ্গে বাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়। ছেলে-মেয়েরা নদী বা ছড়া থেকে পানি এনে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদেরও স্নান করায়।

চৈত্র মাসের শেষ দিন হলো মূল বিজু। এদিন ৩২ ধরনের সবজি দিয়ে ‘পাঁজন’ রান্না করা হয়। এছাড়া প্রতিটি ঘরে মদ, জগরা, কানজিসহ নানাবিধ খাদ্য আয়োজন করা হয়। বন্ধুবান্ধব-আত্নীয়স্বজন বেড়াতে আসে এবং এসব খাবার দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করা হয়। সারাদিন ধরে চলে এই উৎসব।

বিজ্ঞাপন

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পালন করা হয় গোজ্যাপোজ্যা দিন (গড়িয়ে পড়ার দিন)। এই দিনেও থাকে বিজুর আমেজ। এদিনে ছেলেমেয়েরা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেয়।

কাপ্তাই থেকে নিলা চাকমা বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে আমাদের এই বিজু উৎসব উদযাপন করতে পারিনি। কিন্তু এবারের বিজু জাঁকজমকপূর্ণ, উৎসবমুখর পরিবেশে হচ্ছে। করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবী থমকে দিয়েছিল। এমন দুর্দিন যেন আর ফিরে না আসে। সবার উদ্দেশে মঙ্গল প্রার্থনা করেছি আমরা এই উৎসবে।

স্পিনা চাকমা বলেন, ফুল বিজু আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ একটি দিন। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, যুগ যুগ ধরে আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা পালন করছে। এই ঐহিত্যবাহী রীতি পালনে আমরা ফুল ভাসাতে এসেছি। ফুল ভাসানোর মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানাই। আমরা মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করি।

বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টুমনি তালুকদার বলেন, এবারের বিজু বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে হচ্ছে। ফুল বিজু পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে সবার জন্য সুখ-সমৃদ্ধি বয়ে আনুক— এমনটিই প্রত্যাশা।

সারাবাংলা/সিসি/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন