বিজ্ঞাপন

যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর ৫ এলাকায় বেশি ডায়রিয়ার প্রকোপ

April 13, 2022 | 8:15 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে- চলমান ডায়রিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। ওই এলাকায় সপ্তাহে আক্রান্ত হচ্ছেন এক হাজারের বেশি মানুষ, যা অন্যান্য এলাকার দ্বিগুণ। মিরপুর, দক্ষিণ খান, বাড্ডা ও মোহাম্মদপুর এলাকাতেও রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর এই পাঁচ এলাকার ২৩ লাখ মানুষকে কলেরার ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মে মাস থেকে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হবে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১৩ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর আয়োজিত ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাব বিষয়ক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র ও সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম।

অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘দেশজুড়ে ডায়রিয়া রোগী বাড়তে থাকলেও সবাইকে কলেরার ভ্যাকসিন দেওয়া আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বজুড়েই কলেরার ভ্যাকসিনের সংকট রয়েছে। আমরা যা পেয়েছি, সেগুলো নাইজেরিয়া থেকে কিছু অংশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের দিয়েছে। সরবরাহ বাড়লে ঢাকার বাইরেও দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রথম ধাপে রাজধানীর পাঁচটি এলাকায় এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। সেগুলো হলো- যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সবুজবাগ।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘দুই ডোজের এই ভ্যাকসিন কর্মসূচির প্রথম ডোজ দেওয়া হবে মে মাসে। সবমিলিয়ে ২৩ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে জুনে।’

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রক্রিয়া বিষয়ে ডা. নাজমুল বলেন, ‘ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমটি নিয়ে আমরা এখনও কাজ করছি। এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে হলে আলাদা কোনো নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই। নির্দিষ্ট তারিখ ও কেন্দ্র বাছাই হলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। নিকটস্থ কেন্দ্রে গেলেই ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে।’

তিনি বলেন, ‘ডায়রিয়া রোগীদের সুস্থ ব্যবস্থাপনায় এবং ডায়রিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডায়রিয়া রোগীদের সুস্থ ব্যবস্থাপনার জন্য হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ডায়রিয়া ওয়ার্ড চালু করা হচ্ছে। ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে ৬০ জনের বেশি চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ ডায়রিয়ার চিকিৎসায় অনেক উন্নতি করেছে। প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্যালাইনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু মানুষ সচেতন হচ্ছে না। আমরা সবাই জানি পাতলা পায়খানা হলে স্যালাইন খেতে হবে। আক্রান্তরা যদি স্যালাইন খাওয়া ও স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে পারেন, তাহলে কষ্ট করে ঢাকায় আসতে হয় না।’

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রস্তুতি বিষয়ে জানিয়ে ডা. নাজমুল বলেন, ‘ডায়রিয়া রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ, আইভি স্যালাইন, মুখে খাওয়ার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ইত্যাদি চাহিদা অনুয়ায়ী পাঠানো হচ্ছে। সব বিভাগের ভাণ্ডারে পর্যাপ্ত আইভি স্যালাইন মজুত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সব উপদ্রুত এলাকায় মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সারা দেশে মোট ৪ হাজার ৫২৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে ৫০০ মিলি ব্যাগ আইভি স্যালাইন মজুত আছে ৩ লাখ ৩০ হাজারটি, ১০০০ মিলি ব্যাগ আছে ৪ লাখ। এ ছাড়াও ১০০০ মিলি ব্যাগের আরও ১ লাখ ৬০ হাজার আইভি স্যালাইন শিগগিরই ক্রয় করা হচ্ছে।’

ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে এ বছর কতজন মারা গেছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. নাজমুল বলেন, ‘এ বছর স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারের (এমআইএস) রিপোর্ট অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এটিই আমাদের কাছে থাকা তথ্য। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তাদের তথ্য আমাদের কাছে এখনও হস্তান্তর করা হয়নি। যদি তথ্য হস্তান্তর করা হয় তবে আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখব। আমরা এখনো তাদের কাছ থেকে সে সব তথ্য পাইনি।’

বিজ্ঞাপন

মার্চে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত প্রায় পৌনে দুই লাখ

মার্চ মাসে দেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ মানুষ।

ভার্চুয়ালি আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘মার্চে সারাদেশে ১ লাখ ১৭ হাজার ২৩৭ জন ডায়রিয়ার আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে শুধু রাজধানীতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ হাজার ৯১২ জন।’

বিভাগ ও এলাকাভিত্তিক ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা

অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে ৬৬ হাজার ৪৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮ হাজার ৪১৬ জন, খুলনা বিভাগে ৩৬ হাজার ২০৯ জন, বরিাশালে ৫ হাজার ৪১৫ জন, সিলেটে ১১ হাজার ১৯৩ জন, রাজশাহীতে ১২ হাজার ৪৮৪ জন, রংপুরে ১০ হাজার ৫৬৫ জন, ময়মনসিংহে ৯ হাজার ৯০৯ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘গত ৮ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত হাসপাতালে সবচেয়ে রোগী এসেছে যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে। এই এলাকা থেকে প্রায় এক হাজার ১৫০ জনের মত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে যা অন্যান্য এলাকার দ্বিগুণ। রাজধানীর মিরপুর থেকে ৫৫০, দক্ষিণখান থেকে ৫০০ জন, বাড্ডা থেকে ৩০০ জন ও মোহাম্মদপুর থেকে ২৫০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়াও কদমতলি এলাকা থেকে ২৫০ জন, মতিঝিল, ডেমরা, পল্লবী, শ্যামপুর, আদাবর থেকে ১৫০ জন করে ও আশুলিয়া থেকে ১০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া রমনা, লালবাগ, ঢাকা ক্যান্টমমেন্ট, গুলশান, সবুজবাগ, খিলগাও ও কাফরুল এলাকা থেকে অন্তত ৫০ জন করে রোগী এসেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত ৮ থেকে ১৫ মার্চ ঢাকার বাইরে আশপাশ এলাকা থেকেও ও ঢাকার হাসপাতালে রোগী এসেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন অন্তত ৪০০ জন। সবচেয়ে বেশি এসেছে টঙ্গী থেকে অন্তত ২৫০ জন। জয়দেবপুর ও নরসিংদি থেকে ১০০ জন করে। কেরানীগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, শিবপুর, শ্রীপুর, কাপাশিয়া, কালিয়াকৈর, মনোহরদি, মানিকগঞ্জ, লৌহাজং, গজারিয়া থেকে অন্তত ৫০ জন করে চিকিৎসা নিয়েছেন।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘যাত্রাবাড়ীতে নিরাপদ পানির সবচেয়ে সংকট। সাপ্লাইয়ের পানি যত দিন ঠিক না হবে, পানির উৎস নিরাপদ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই এসব এলাকার মানুষকে ব্যক্তি স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সতর্কতা বাড়াতে হবে।’

ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জরিপ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, আমরা আইসিডিডিআর,বি’র সঙ্গে যৌথভাবে এই জরিপ চালাচ্ছি। খুব দ্রুতই ফলাফল জানানো হবে।

ভার্চুয়ালি আয়োজিত এই ব্রিফিংয়ে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, ‘ডায়রিয়া প্রকোপ রোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। কেউ ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে খাবার স্যালাইন গ্রহণের পাশাপাশি নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। জেলা-উপজেলাসহ আমাদের প্রতিটি হাসপাতালই প্রস্তুত রয়েছে।’

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডায়রিয়া হলেই আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালটির নাম মাথায় চলে আসে। কারণ এই হাসপাতালটির আগে নাম ছিল কলেরা হাসপাতাল। এই কারণেই মানুষ হাসপাতালটিতে এসে ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রতিটি হাসপাতালই ডায়রিয়া চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত।’

ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, বাংলাদেশসহ বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার ৪৭টি দেশে কলেরা দেখা যায়। বিশ্বে প্রতিবছর এক থেকে চার কোটি মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়। আর বাংলাদেশসহ ৮টি দেশে কলেরার শিকার হয় লাখের বেশি মানুষ।

ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশে শীত, বর্ষা ও গরমের সময়ে কলেরার প্রকোপ বাড়ে। সে অনুযায়ী এপ্রিলের শুরুতে বাড়তে থাকে। তবে এবার হয়েছে ব্যতিক্রম। নির্ধারিত সময়ের আগে গরম আর রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় নিরাপদ পানির অভাবে মার্চেই প্রকোপ শুরু হয়। গত বছরের মার্চেও ডায়রিয়া রোগী দৈনিক ৬০০ থাকলেও এবার সেটি দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে।

সারাবাংলা/এসবি/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন