বিজ্ঞাপন

মজিদ মাহমুদের ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম: সাধারণ পাঠ

April 16, 2022 | 1:11 pm

ড. খন্দকার শামীম আহমেদ

কবি মজিদ মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে; জুলাই ২০১৯ প্রকাশিত মজিদ মাহমুদের কবিতার সংকলন কাব্যসমুচ্চয়-এর তথ্য মোতাবেক। ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম কাব্যগ্রন্থে মোট ৪৭ টি কবিতা আছে। প্রথমে তালিকাটিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে গণনা করে ঠিক করে উঠলাম কোন কবিতাটি আগে পড়ব! চোখ গিয়ে পড়ল ‘দোজখে এক আলেমকে দেখার পর’ কবিতাটিতে। প্রথমে কৌতুহল হল জীবিত অবস্থায় দোজখ দেখা একজন কবির অভিজ্ঞতাটা জেনে নেয়া যাক! কাব্যসমুচ্চয়-এর ১৩৪-৩৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী এই কবিতাটি। অনেকটা গল্পের মতো / গণিতের ‘মনে করি’ ঢ়ংয়ে কবিতাটি শুরু হলো : ‘‘আচ্ছা এক আলেমকে যখন জাহান্নামের মাঝখানে নিক্ষেপ করা হলো / এবং পেটের মধ্য থেকে বের হয়ে পড়ল পাকস্থলী ও অগ্নাশয়…’’ এভাবে। কবি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন দোজখের কোন জায়গায়, কাকে ফেলা হবে, তার নাড়িভুড়ি বের হয়ে যাবে, তার দুর্গন্ধও কবি পেয়েছেন, শরাবান ত্বহুরা তো দোজখবাসীর পানীয় নয়— তাকে সে পাবে কেন? আর দোজখে আপন স্ত্রীকে দেখতে পাওয়া গেল, লালত করতে দেখা গেল!? যা-হোক এটা কোন ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল নয়; কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার প্রথম প্যারা মাত্র। কবিরা অনেক কিছুই কল্পনা করে নিতে পারেন। আর মজিদ মাহমুদের কল্পনা কতটা বিপুল বিস্তারী তা কাব্যসমুচ্চয়-এর ভূমিকা থেকে আচ করা যায়। কবিতাটির দ্বিতীয় প্যারায় কবি বলেছেন : “কবি হিসেবে তো আমার এসব দেখারই কথা, আর আমি তা দেখছিলামও।” দোজখের অধিবাসী হিসেবে কবি নিজেকে সহ ইমরুল কায়েস, র‌্যাবো ও বোদলেয়ারকে পেয়েছিলেন; তাদের নিয়ে তার ক্ষোভ নেই একরত্তি। কারণ দুনিয়াকেই তারা ‘নরকগুলজার’ করেছিলেন। আপত্তি তাই ওই আলেমকে নিয়ে! যে আলেম আল্লাহর কালাম রাত জেগে মুখস্থ করেছে, মুখে সুন্নতের দাঁড়ি রেখেছে, ওয়াজে নসিহত করেছে, দোজখের আজাবের ভয়াবহতার কথা শুনিয়েছে; তাকে কেন এই দোজখে দেখা যাচ্ছে? কবি তার কর্মফল অনুযায়ী নিশ্চিতভাবেই “আমরা তো নিশ্চিত ছিলাম আমাদের দোজখবাস; কিছু মানুষ আর / পাথর যে সেখানে থাকবে সে কথা তো তুমি আগেই বলেছ”— নিজেকে দোজখবাসী কল্পনা করেছেন। সুরা বাকারায় উল্লেখিত আয়াত “সে আগুনকে ভয় করো, যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর।” (আয়াত # ২৪) এর কথাই যে কবি মজিদ মাহমুদ বলেন, বোঝা গেল।
কবিতার উপসংহারে আলেমের দোজখবাসের রহস্য উন্মোচন করেন কবি:

বিজ্ঞাপন

ঈশ্বর বলেন, শোন তবে মন দিয়ে, …
এই আলেম আমার কথা বলতো তার নিজ প্রয়োজনে
পাকস্থলি তার প্রকৃত কাবা; পরকাল মানেই সত্যের উন্মোচন।

বোঝা গেল ব্যক্তিস্বার্থে, পেটের দায়ে আলেম আল্লাহর কালামকে ব্যবহার করেছিলেন, তাই তার এই শাস্তি। কবিতা পাঠকের মনে এই অনুভব জাগতে পারে— দোজখে সুদখোর, ঘুষখোর, যেনাকারী, দুর্নীতিপরায়ণসহ অন্যান্য পাপীদের ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব থেকে আলেমকে নিয়ে কবির এত আগ্রহ বিশেষ কি কারণে! কবিই এর উত্তর জানবেন!
‘শবে বরাত’ অর্থ ভাগ্যরজনী। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবে বরাত হিসেবে পালন করা হয়। এই রাতে আল্লাহ শিরককারী এবং হিংসাপোষণকারী ব্যতীত সবাইকে মাফ করে দেন। বাংলাদেশে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে রাতটি পালন করা হয়। কিছু আরোপিত আচার এই রাত উপলক্ষে হয়ে থাকে— আতশবাজি, আলোকসজ্জা প্রভৃতি— এগুলো বর্জন করতে উপদেশ দেয়া হয় মসজিদে মসজিদে। দল বেধে মানুষ সাবধানবাণী শুনতে মসজিদে যান। যদিও এ রাতের এবাদত একান্তই ব্যক্তিগতভাবে পালনীয়।

এই কবিতাগুলো সেজদারত অসংখ্য ফেরেশতার মাঝে একাকী আদম; ইন্দ্রের সভায় নৃত্যরত বেহুলা, মৃতের জগত থেকে ফিরে না আসা গিলগামেস, ছয়দিনে জগত নির্মাণ। এই কবিতাগুলো শিকার যুগ থেকে কৃষি যুগ, পলিলিথিক থেকে নিওলিথিক, ককেকশাশের পর্বতশৃঙ্গে বন্দি প্রমিথিউস, বরফের নিচে চাপাপড়া খনিশ্রমিক। এই কবিতাগুলো পুত্রহন্তা একিলিসের কাছে প্রার্থনারত প্রায়াম, থেয়ানেস পর্বতে লেয়াসের পুত্র, নিয়তি তাড়িত জোকাস্টা। এই কবিতাগুলো ভলতেয়ারের কাদিদ, গেটের ফাউস্ট, শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’।… এই কবিতাগুলো চিতায় দাহ করার আগে, গ্যাংরেপে হারিয়ে যাওয়ার আগে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের আগে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগে, প্রেম-প্রবঞ্চার আগে— স্বয়ং ধ্বনিত হয়ে উঠবে।

বিজ্ঞাপন

কবি এই কবিতায় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থান— ট্রাফিক পুলিশ-রিকসা-লাশ করবস্থ করার দৃশ্য— টুপি বিক্রেতার প্রসঙ্গ এনেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ঢংয়ে বলেছেন—
আজ শবে বরাত, পৃথিবীতে এসেছে মৃতদের আত্মা
শরীরের দাসত্ব তারা আজ পেতেছে টের…

যদিও পৃথিবীতে যারা শুধুমাত্র শরীরের দাসত্ব করেছে, অন্যকে অন্নদান করেনি, উত্তম কাজ করেনি— কবি তাদের প্রসঙ্গ টেনেছেন। তবে শিরক-হিংসা থেকে বেঁচে থাকার প্রসঙ্গ থাকলে কবিতাটি আরও আবেদনময় হতে পারতো, অন্তত কবিতাটির শিরোনামের প্রতি সুবিচার করা হতো। ‘আমার মার্কসবাদী বন্ধুরা’ কবিতাটিকে আমার সেরা মনে হয়েছে। কবিতাটি পাঠ করে বারবার আল মাহমুদকে মনে পড়েছে। আল মাহমুদের প্রবন্ধগ্রন্থ কবির আত্মবিশ্বাস-এর একটি প্রবন্ধ ‘মার্কসবাদীদের কাব্যবিচার’। এ প্রবন্ধে আল মাহমুদ মার্কসবাদীদের বর্তমান অবস্থা, বিশ্বরাজনীতি-দেশের বর্তমান অবস্থায় তাদের অবস্থান এবং সর্বোপরি সাহিত্যবিচারে তাদের মতবাদের অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। বর্তমান কবিতাটিতেও যেন একই বক্তব্য উঠে এসেছে।
কবি মজিদ মাহমুদ বলছেন যে তার দীর্ঘদিনের মার্কসবাদী বন্ধুদের অনেকেই এখন এন.জি.ও.-কর্মী; রাজনীতির মাঠে পল্টি খেয়ে ক্ষমতাসীন দলের নাম লিখিয়েছেন। বাড়িগাড়ি করেছেন অনেকেই, মোটা অঙ্কের বেতন পান। এঁদের উদ্দেশে কবি বলেন-

খুব ভালো, তাদের জীবনে সত্যিই মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
ভালো থাকার জন্যই তো সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।

বিজ্ঞাপন

কবিবন্ধুরা কবিকে মূর্খ ভাবতো— কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো না পড়ার জন্য। এই ‘লালবই’ না পড়ার কারণে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। লেখকের আজ লালবই পড়ার ইচ্ছা হয়েছে। তাই তিনি পড়তে বসেছেন। কিভাবে পেলেন সে বই— ফুটপাতে; মার্কসবাদী বন্ধুদের সেলফ থেকে ফুটপাতে জায়গা হয়েছে তার। কবির ভাষায়:

এখন গোপনে লালবই পড়ি। তবে সবই পুরনো
আমাদের বন্ধুদের শেলফ থেকে পরিত্যক্ত এসব বই
ফুটপাতে নিয়েছে আশ্রয়। সোভিয়েত ভেঙে গেছে
মাও সেতুংয়ের দেশে হয়েছে পুঁজির বিকাশ
রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা নেই, তাই বেওয়ারিশ সর্বহারা
বইগুলোও এখন ছিন্নভিন্ন প্রোলিতারিয়েত।

আল মাহমুদ তার প্রবন্ধে বলেছিলেন বর্তমানে লালপতাকা থেকে কাস্তে এবং হাতুড়িকে বিতাড়িত করা হয়েছে; মজিদ মাহমুদও একই বক্তব্য রেখেছেন। আল মাহমুদ মার্কসবাদে আস্থা রাখতে পারেননি; মজিদ মাহমুদের অনুভব ভিন্ন :

তবু মার্কসবাদ মানেই শ্রমিক অসন্তোষ
মালিকরা মন খুলে হাসতে পারে না
মার্কসবাদ মানে অলাভজনক পাটকলগুলো বন্ধ না হওয়া
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন খায়েশ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া
মার্কসবাদ মানেই মরার আগে অন্তত হাত উত্তোলন করা।

বিজ্ঞাপন

‘নববর্ষের দুঃখ’ কবিতায় কবি কোথা থেকে এসে নামলেন শ্যামলী বাসস্টপে— তার উল্লেখ নেই। ধরে নেয়া যায় নববর্ষের উৎসব পালন করে শাহবাগ / নীলক্ষেত থেকে ফিরলেন। পায়ে হেটে আদাবর যাওয়ার পথে শিশুমেলা, পঙ্গু হাসপাতালের ফুটপাতে এক পা হারানো পিতাকে কবি দেখেছেন; প্যাথড্রিন শিশুকেও দেখেছেন— অন্যরা হয়তো বলতেন ভিক্ষুক এবং টোকাই দেখলেন। আরও দেখলেন বেওয়ারিশ কুকুর, পথ-বালিকাকে। এদের দুঃখকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নববর্ষের দিনটিকে উদ্যাপন করেছেন কবি— নববর্ষের দিনে যেন দুঃখবিলাস করেছেন :

দুঃখদের বাবা-মা কোথায় থাকে কে দুঃখদের বাবা-মা
আমি নই কী, আমারই বুকের মধ্যে তারা ওঠে বেড়ে
তাদের নরম হাত, উত্তোলিত হবার ক্ষমতা

এই দুঃখী মানুষের কথা লিখতেই কবি রাইটিং প্যাড খুলে কবিতা কম্পোজ শুরু করেন আর তারা কবির কোলে আশ্রয় নেয়Ñ কবিও তাদের নামিয়ে দেন না সেই নববর্ষের সন্ধ্যায়।

মজিদ মাহমুদের কিছু কবিতায় রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বর্ণনা এসেছে। ২০০৬ এর ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয় নিয়ে লেখা ‘রবার্ট ফিস্কের প্রতিবেদন’ কবিতাটি। স্বল্প বয়ানে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হয়ে উঠেছে। বিশ্বমিডিয়া যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মর্জিমাফিক খবর তৈরি ও বিতরণ করা হয়। ফিলিস্তিনের হামাস কর্তৃক একজন ইসরাইলি সৈন্যকে আটক করা এবং ইসরাইলি সৈন্যকর্তৃক ফিলিস্তিনি ডাক্তার গ্রেফতার নিয়ে মিডিয়ার অন্যায্য আচরণ কবিকে মর্মাহত করেছে। ১৮০ জন ফিলিস্তিনির প্রাণসংহার সেখানে খবর হয়না; ব্রেকিং নিউজ হয় হামাসের রকেটে নিহত হয়েছে এক ইসরাইলির মূল্যবান জীবন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নানাভাবে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালায়, মানুষ হত্যা করে— এই কবিতা যেন তার কাব্যিক প্রতিবাদ—মৃদু হলেও। ‘আমেরিকা’ কবিতায় স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র শব্দগুলোকে অপবিত্র, দুষিত করার জন্য কবি আমেরিকাকে দায়ী করেছেন। বিশ্বরাজনীতির পাশাপাশি কবি তার সমাজের সাধারণ মানুষদের নিয়েও ভেবেছেন। ‘কানা রফিকুল আমার ভাই’ কবিতায় ‘এক’ ও ‘দুই’ অধ্যায়। ‘কানা রফিকুল আমার ভাই’-‘এক’ কবিতায় কবির নিজের বংশ পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছেন আর ‘দুই’ অংশে মায়ের দিকের আত্মীয় রফিকুলের অন্ধ হওয়ার বিবরণ দিয়েছেন। ‘আমাদের পাশের বাড়ির রফিকুল / স্রেফ মলম কিনতে না পেরে কানা হয়ে গেল / তার বড় ভাই রব্বেল জন্ডিসে মরেছে / একটা বোন আগুনে / বয়স এককুড়ির ভেতর’’— বিষয়ের অনুষঙ্গী শব্দচয়নে কবিতাটি পাঠে আরাম পাওয়া যাবে; রব্বেল যে রবিউলের আঞ্চলিক নাম আর চল্লিশ যে দুইকুড়ি— এতে কবিতাটি স্বাভাবিক হয়েছে। যদিও বিষয়টা মনখারাপ করার, তীব্র ঝাকুনি দেয়ার মতোই।

একা হাটা প্রসঙ্গ প্রায়ই কবি ব্যবহার করেন। বন্ধুকে বাসে তুলে দিয়ে একা বাসস্টপে বসে থাকা প্রসঙ্গ বেশ কয়েকটি কবিতায় আছে। ব্যস্ত, ভিড় কিন্তু নিঃসঙ্গ শহরে একটু একাকি হাটাতেও যেন স্বস্তি পাওয়া যায়। কর্মব্যস্ত দিন পার করে বৃহস্পতিবার মুক্তির সওগাত নিয়ে আসে। শুক্রবারের কথা, ছুটির কথা— ক্লান্ত শহরে এরকম ‘ব্রেক’ প্রয়োজন হয় সামনের ব্যস্ততাকে হজম করার টনিক হিসেবে। ‘দান’ কবিতায় কবি বৃহস্পতিবারে ভিক্ষুকের ভিক্ষাভা-, খুচরা পয়সা গণনার কথা বলেছেন; সেই সঙ্গে বাইতুল মোকাররমের জুম্মার নামাজের পর ‘বুশের সম্পাত’ করবে এমন প্রসঙ্গ এনেছেন। সম্ভবত কবি ইরাক যুদ্ধের প্রসঙ্গে কথাটি বলেছেন। নামাজিরা নামাজ শেষে যে মিছিল বের করে তার প্রসঙ্গ টেনেছেন। কবির মন মরে গেছে; সেই মৃত মনের জানাজা, দাফন হয়নি। কবির স্মৃতিরাও আর ধরা দিচ্ছে না। তাই কবি দান করতে চান দুটি পয়সা হারানো স্মৃতি আর মৃত মনের সদ্গতির উদ্দেশে। ‘নিরুদ্দেশ ডাক’ কবিতায় কবি সুন্নতে খৎনা অনুষ্ঠানের স্মৃতি উদযাপন করেছেন। আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা, খৎনার ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো আর বড়দের দ্বারা ধৃত হয়ে হাজামের সামনে আনয়ন, মায়ের মুখে হাসি দেখে কোমলমতি শিশুর মনের নানা প্রশ্ন— এমন সাধারণ প্রসঙ্গের পর কবি যখন লাল ঝুটি মোরগের মুরগিতে উপবেশনের স্মৃতিমগ্ন- উচ্চারণ করেন : “আমার জাতিস্মর জেগে আছে মোরগের ডাকের ভেতর।”— তখন কবিতাটি এক ভিন্ন মাত্রায় উপনীত হয়। ‘আমার কলম’ কবিতায় কলম, সাপ আর শিশ্ন একাকার হয়ে যায় কবির মগ্নতায়। বুকের উপর হামাগুড়ি দিয়ে নারী শরীরে ঢুকে পড়া, প্লাসেন্টায় প্রাণের স্পন্দন; তার বেড়ে ওঠা যৌবন, বার্ধক্য! সবই যেন কলমের খোঁচায় লিখে দিচ্ছেন কবি। কিন্তু সমকাল যেভাবে জ্বলছে তাতে জন্মদান ভয়ংকর ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তাই কবি বলছেন :

আজ জন্মদান পৃথিবীর সবচে খারাপ ঘটনা
তবু আমার কলম
মহাকালের দিকে অমরতার সন্ধানে ব্যাপৃত!

‘ঈশ্বর আমাকে বাঁচতে দেননি’ কবিতায় কবি হযরত ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক হযরত হাজেরা (রা.) এবং পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে নির্বাসন দেয়ার ঘটনা বর্ণনা করেন, যদিও তাদের নাম উল্লেখ করেননি। আল্লাহর অবাধ্যদের জন্য কবি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে কবিতাটি শেষ করেছেন :

আর যারা অবাধ্য, তোমাকে মানেনি, তারা অভিমানী
তারা চায় তোমার স্নেহের হাত স্পর্শ করুক তাদের শিরোদেশ
তুমি তাদের নাম ধরে ডাকো, চোখ থেকে মুছে দাও অশ্রু
আলিঙ্গনে ঘোচাও বিরহ
হাত ধরে কিছুটা সাথে নিয়ে চলো…

‘এখন দার্শনিক কবিতা লেখার সময়’ কবিতাটিকে যে কেউ আত্মমূল্যায়ন হিসেবে পড়ে নিতে পারবেন। পাঠককে সঙ্গী করে তিনি কবিতাবয়ানে মনোযোগী হন : “ধরুণ, আপনার বয়স ষাট, না হয় আরো ১০ যোগ করে দিন / সরাসরি বললে, আপনি মরণের পাড়ে চলে এসেছেন / চলুন, একটু রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকাই”। তেতাল্লিশের দাঙ্গা, উনপঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ, রায়ট, দেশভাগ, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধ, ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র, উনসত্তরের গণ অভ্যূত্থান, ১৯৭১-র মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে কবি পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেন স্বাধীন বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটেছে, তার কথা; তারা কেমন ছিলেন, আছেন। কবির ভাষায় :

হয়তো এটাকেই মানুষ ভালো থাকা বলে
মানুষের ইতিহাস একের পর এক রাজা বদল
বর্গী এসে সব লুট করে নেয়
রক্তের গঙ্গার মধ্যে ফুল বিকশিত হয়
ভক্তের ফুল শুকিয়ে যায়, দলিত হয় পায়ের নিচে, তাই
সবাই জানি, এখন দার্শনিক কবিতা লেখার সময়।

কবির এই আহ্বান কবিতা পাঠককে নাড়া দেয় তুমুলভাবে। ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় কবির স্বদেশপ্রেম বাঁধ ভেঙে উপচে পড়েছে। কবিতাটি গদ্যের মতো পড়া যায়। বক্তব্য একেবারে পরিষ্কার। অলঙ্কার ছাড়া সোজাসাপ্টা বয়ানে কবিতাটি এরকম : “বিদেশের অভিজ্ঞতা আমার বড় খারাপ। সারাক্ষণ মন ভারি হয়ে থাকে / তোমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। তারা জিজ্ঞেস করে আমি কোথা থেকে / এসেছি। আমি পরম মমতায় আমার দেশের নাম বলি। বলি বাংলাদেশ। তারা / বলে ও! ইন্ডিয়া? আমি দুঃখ পাই। কাতর অনুনয় ও বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে / নিই। মনে মনে কসে গাল দিই। বলি, গাধার বাচ্চা! কুপম-ুক। তোমাদের / পৃথিবী এত ছোট! পৃথিবীতে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল কারা। আমরা / স্বাধীন হয়েছি, তোমাদের অনেক রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি জীবনের বিনিময়ে / অথচ ৪শ বছর আগেও ফাঁসোয়া বার্নিয়ার জানতেন, পৃথিবীর সমৃদ্ধশালী দেশ হলো বাংলাদেশ।”

কবি মজিদ মাহমুদ এই সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের একজন চাক্ষুষ কবি। তার দেখায় স্বচ্ছতা আছে। শব্দ ব্যবহারে তিনি সচেতন। একটা দুর্বলতা অবশ্য আছে। সেটা অধিকাংশ কবি সাহিত্যিকদের মধ্যেই দেখতে পাই; ‘আল্লাহ’, ইসলামী নাম-প্রসঙ্গ এড়িয়ে বিকল্প নানা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা। কবি মাহমুদের কবিতাতেও দেখতে পাই ‘ঈশ্বর’, যিশু, অর্জুন, ক্রুশকাঠ, দ্রোণাচার্য প্রভৃতি নাম ব্যবহারে, উপমায় যেমন সাবলীল; ততটাই আড়ষ্ট ইসলামী নাম ব্যবহারে। আগেই বলেছি, এটা একা মজিদ মাহমুদের প্রবণতা নয়। অবশ্য মজিদ মাহমুদ কখনো কখনো ইসলামী প্রসঙ্গ বলিষ্ঠভাবেই প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশে তিনি সবচাইতে স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীল; যেখানে অনেকেই ভীরুতার আশ্রয় নেন। সামাজিক বক্তব্যও পাওয়া যায়। তবে কবিতা লেখা যেমন কবির কাজ, কবিতা আস্বাদন একান্তভাবেই পাঠকের রুচির ওপর নির্ভরশীল। পাঠকের আঁশ মেটানো কবির কাজ নয়, কবি আপন মর্জির অধিকারী। আর কবিতার সমালোচনা আসলে হতে পারে না; যেটা হয়. তা কবিতা পাঠের অনুভূতি প্রকাশ মাত্র।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন