২৫ রমজান থেকে ইদের দিন পর্যন্ত ‘অচল’ হতে পারে ঢাকা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের হার কম হওয়ার কারণে এবার ইদে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ গ্রামের বাড়ি যাবেন। এমন অবস্থায় আসন্ন ইদযাত্রায় অসহনীয় যানজট, পথে পথে যাত্রী হয়রানি, ভাড়া নৈরাজ্য ও সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। আর তাই যানজট নিয়ন্ত্রণে রাস্তার মোড় পরিষ্কার রাখা ও ছোট যানবাহন বিশেষ করে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তা না হলে আগামী ২৫ রমজান থেকে ইদের দিন পর্যন্ত দুপুরের পর থেকে গভীর রাত অবধি রাজধানী অচল হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনে সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ইদযাত্রায় নারকীয় পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন মো. মোজাম্মেল হক।

রোববার (১৭ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ঈদযাত্রায় অসহনীয় যানজট, পথে পথে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্য পাঠ করে মো. মোজাম্মেল হক বলেন, করোনা কম হওয়ার কারণে এবারের ইদে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ গ্রামের বাড়ি যাবেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে, এবারের ইদে ঢাকা থেকে ১ কোটির বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবে। এছাড়াও এক জেলা থেকে অপর জেলায় আরও প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ যাতায়াত করতে পারে।

তিনি বলেন, আগামী ২০ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত ইদবাজার, গ্রামের বাড়ি যাতায়াতসহ নানা কারণে দেশের বিভিন্ন শ্রেণির পরিববহনে বাড়তি প্রায় ৬০ কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন বাড়তি নিরাপত্তা, সর্বোচ্চ সতর্কতা, সকল পথের প্রতিটি যানবাহনের সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করা। কিন্তু যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনে সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ইদযাত্রায় নারকীয় পরিস্থিতি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এবারের ইদযাত্রায় রাজধানীবাসী যানজটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়বে। তাই এই মূহুর্ত থেকে রাজধানীর সকল পথের ফুটপাত, রাস্তা হকার ও অবৈধ পার্কিং মুক্ত করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানাই।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের প্রবেশদ্বারগুলো বিশেষ করে যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ, বাবুবাজার ব্রিজ, পোস্তগোলা, টঙ্গী রেলস্টেশন, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু, মীরের বাজার, উলুখোলা, কাঞ্চন ব্রিজ, গাবতলী মাজার রোড, মীরের ধৌর, আশুলিয়া, ইপিজেড, চন্দ্রা, রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু, জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ, হাতিরঝিল, মহাখালী, রামপুরা, শেখের জায়গা, আমুলিয়া, ডেমরা, সুলতানা কামাল ব্রিজ, চিটাগাং রোড, কাচঁপুর, মদনপুর, মেঘনা টোল, ভুলতা, গাউছিয়া, বরফা অন্যদিকে বিআরটি নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যাতায়াতে মানুষজনকে অসহনীয় যানজটে পড়তে হবে।

মো. মোজাম্মেল হক বলেন, এসব যানজট নিয়ন্ত্রণে রাস্তার মোড় পরিস্কার রাখা ও ছোট যানবাহন বিশেষ করে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান। তা না হলে আগামী ২৫ রমজান থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত দুপুরের পর থেকে গভীর রাত অবধি রাজধানী অচল হয়ে যেতে পারে।

লিখিত বক্তব্যে কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও পরিবহন নেতাদের চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন টোল পয়েন্টের কারণে জাতীয় মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট হয় উল্লেখ করে ইদযাত্রায় সড়কে চাঁদাবাজি ও যানজটমুক্ত করার দাবি জানান মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ ও পরিবহন সংকট, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চালাতে কিছু কিছু পরিবহন মালিক-চালকেরা মড়িয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই ভাড়া নৈরাজ্যকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কাগুজে বাঘের মতো হুশিয়ারী উচ্চারণ করলেও দৃষ্টান্তমূলক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনে ব্যর্থতার কারণে এবারের সকল পথে দ্বিগুণ-তিনগুণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য হবে। তাই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অতিরিক্ত যাত্রী ও বেশি ভাড়া আদায়ের লোভে প্রতিবছর সড়ক ও নৌ পথে ফিটনেসবিহীন যানবাহনে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, নৌ পথে পর্যাপ্ত বয়া-বাতি ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না থাকা, একজন চালককে বিশ্রামহীনভাবে ১০/১২ ঘণ্টা বিরামহীনভাবে যানবাহন চালাতে বাধ্য করার কারনে এবং অদক্ষ চালক দিয়ে আনফিট যানবাহন চালানোর কারনে সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ঈদে কয়েকশ যাত্রীর প্রাণহানী ঘটে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে ২০২১ সালে ইদুল ফিতরে ৩১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত ৬২২ জন আহত হয়েছে। এবারও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ দ্বিগুণ থাকায় সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনার সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, সম্প্রতি রেল ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে রেলওয়ে ব্যাপক শিডিউল বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এটি কাটিয়ে উঠা না গেলে ইদযাত্রায় ভোগান্তি বাড়াবে। অনলাইনে রেলের টিকিট প্রদানের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় যাত্রীর টিকিট কাউন্টার থেকে কালোবাজারীদের হাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে কালোবাজারীদের কাছ থেকে এসব টিকিট যাত্রীদের চড়া দামে কিনতে হবে।

মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটের আসন্ন ইদে আগে ও পরে ১০ দিনের বাংলাদেশ বিমানসহ বেসরকারি এয়ার লাইন্সগুলোর টিকিট বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সীগুলো দখল করে নেওয়ায় এবারের ঈদে যাত্রী সাধারণকে এসব ফ্লাইটে টিকিট কয়েকগুণ বাড়তি দামে কিনতে হবে।

নৌ পথে ভাড়া নৈরাজ্যের পাশাপাশি বিআইডাব্লিউটিএ ও জেলা পরিষদের মালিকানাধীন সারাদেশে ৪০০ নৌ ও ফেরিঘাটে নিয়োজিত ইজারাদারেরা ঈদে যাত্রী পারাপারে বাড়তি টোল আদায়ের নৈরাজ্য চালায়। এবারও তারা তৎপর হয়ে উঠেছে। যাত্রী সাধারণ এসব পথে যাতে হয়রানি না হয় তার বিহিত ব্যবস্থা নিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

লিখিত বক্তব্যে মো. মোজাম্মেল হক আরও বলেন, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়াসহ বিভিন্ন ফেরিঘাটে যানবাহন চলাচল প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়লেও ফেরির সংখ্যা কমেছে। ফলে এই ইদে এখানে শত শত যানবাহন উভয় পাড়ে আটকা পড়বে। এসব ফেরিঘাটে ফেরির সংখ্যা বাড়ানো, বিদ্যমান ফেরিগুলো যথাযত ব্যবহার সুনিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এবারের ইদে কালবৈশাখীর শঙ্কা থাকায় নৌপথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই আনফিট নৌযান বন্ধসহ ফিটনেসধারী নৌযানে যাতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করতে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানাই।

মহাসড়কে ডাকাতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে মো. মোজাম্মেল হক বলেন, করোনা সংকটসহ নানা কারণে এবারের ইদ যাত্রায় যাত্রী সাধারণ ব্যাপকভাবে অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, টানাপার্টিসহ টার্মিনালে নানা প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুয়ে ইদ আনন্দ মাটি হতে পারে। তাই প্রতিটি বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে সিভিল পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান।

তিনি বলেন, আগামী ২৫ রমজান থেকে ১৬ লাখ যাত্রীর গণপরিবহন সংকট দেখা দিবে। ছুটি বাড়িয়ে এটি সামাল দেওয়া যায়। তিনি পরিবারের সদস্যদের আগে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, ইদের আগে ইদ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি না নিয়ে বছরব্যাপী ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।

এ সময় ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে ঢাকা থেকে জনগণের চাপ কমানোর দাবি জানান আবু সাঈদ খান।

সারাবাংলা/এসবি/এসএসএ