বিজ্ঞাপন

কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই!

April 21, 2022 | 4:48 pm

রফিকুল ইসলাম

‘অ্যারিওপ্যাজিটিকা’– এ যাবৎকালে সব চাইতে শক্তিশালী প্রবন্ধ হিসেবে স্বীকৃত। ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন মিল্টন লিখেছিলেন সাড়া জাগানিয়া এ প্রবন্ধটি। অখন্ড সত্য কীভাবে খন্ডিত হলো, তারই উদাহরণ দিতে কবি আশ্রয় নিয়েছেন প্রাচীন মিসরীয় উপকথার।

বিজ্ঞাপন

স্টাইফন ছিলেন মিসরের রাজা। কুমারী ‘সত্য’ প্রথমে ছিল অসিরিসের অধীনে। সত্য বলে তাতে আঁতে সয়নি রাজার। এ সংকীর্ণতায় একদিন রাজশক্তি প্রয়োগে ‘সত্য’কে ছিনিয়ে নিয়ে টুকরোটুকরা করে ফেললেন। সাথে অসিরিসকেও। সেই থেকে খন্ডিত হয়ে পড়ে ‘সত্য’।

এদিকে অসিরিসের স্ত্রী আইসিস স্বামীর শরীরের সব টুকরো কুঁড়িয়ে পেতে সন্ধানে ব্যাকুল। তদ্রুপ মানব সমাজ আজো ব্যস্ত নিরঙ্কুশ সত্যের সন্ধানে, ওই অসিরিসের মতো।

এই উদ্দীপকটি পাঠকপ্রিয় জাতীয় মূলধারার অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘সারাবাংলা ডটনেট’ পত্রিকায় গত ৭ এপ্রিল প্রকাশিত ‘বছরের পর বছর অনুপস্থিত থাকলেও নিয়মিত বেতন তোলেন মাদরাসা শিক্ষক’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনেরই প্রতিরূপ।

বিজ্ঞাপন

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার সহকারী কৃষিশিক্ষক হাসান মো. ফরহাদ বছরের পর বছর ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে এবং শিক্ষার্থীদের পাঠদান না করেই নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন। এই অনিয়ম ও জাতিয়াতির মদতদাতা শিক্ষক ফরহাদের নিকটাত্মীয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, যিনি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক সরকারি কলেজের সহকারী লাইব্রেরিয়ান। আর যোগসাজশে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট মাদরাসার সুপারিন্টেন্ডেন্ট মো. আমিনুল হক।

হাসান মো. ফরহাদ ২০০৫ সালের মার্চ মাসে সহকারী কৃষিশিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর ২০১০ সালে সরকারি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর থেকেই কর্মস্থলে অনিয়মিত উপস্থিতি এলাকাবাসীর দৃষ্টি কাড়ে। শিক্ষার্থীদের শ্রেণি পাঠদানের পরিবর্তে মিঠামইন বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও পারিবারিক নানারকম কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বিশেষ করে ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিলে শুধুমাত্র ম্যানিস্ট্রি অডিটের সময় মাদরাসায় উপস্থিত থাকলেও লিখিত অভিযোগ করা পর্যন্ত মাদরাসায় শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রমে অনুপস্থিত রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ ৫৪৪ দিন পর গত ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও শিক্ষক ফরহাদ ‘মামার জোরে’ মাদরাসা কামাই অব্যাহত রাখেন। আবার করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধের পর ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও ২৫ মার্চ পর্যন্ত গরহাজির থাকেন তিনি।

অনুপস্থিতির বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলে সুপারিন্টেন্ডেন্ট তড়িঘড়ি করে শিক্ষক ফরহাদকে খবর দিয়ে এনে বিগত প্রায় চার বছরের স্বাক্ষর একদিনে করিয়ে নেন শিক্ষক হাজিরা খাতায়।

এসব চরম স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর পক্ষে সুশীল সমাজের একজন সচেতন নাগরিক লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার বর্তমান ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আছিয়া আলমের দফতরে।

বিজ্ঞাপন

এই অভিযোগের সূত্র ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে উপজেলাজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এতে মাদরাসার সুপারিন্টেন্ডেন্ট হাদিসে মোহাদ্দিস মাওলানা মো. আমিনুল হক ওরফে কাজী মিয়া গত ১০ এপ্রিল স্টাফ মিটিং ডেকে অভিযোগকারী বা আবেদনকারীর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে রেজুলেশন করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন। এতে শ্যামপুর মাদরাসার সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমিনুল হক ও শিক্ষক ফরহাদ ‘টক অব দ্যা কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়েছেন।

সুপারিন্টেন্ডেন্টের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্টাফ মিটিংয়ে করা রেজুলেশনে বিশেষ এই সংবাদটিকে মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া ও কাল্পনা প্রসূত দাবি করে সহকারী কৃষিশিক্ষক হাসান মো. ফরহাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলা হয়, ‘তিনি একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্তব্য পরায়ণ শিক্ষক’।

প্রাপ্ত প্রমাণাদিতে দেখা যায়, যে সকল শিক্ষক রেজুলেশনে স্বাক্ষর করেছেন এর মধ্যে কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন যারা রেজুলেশনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, উচ্চতর বেতন স্কেল লাগানোর কথা বলে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। তারা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা তথা শিক্ষক ফরহাদের অনুপস্থিতির অভিযোগটি স্বীকারও করে নেন। সংবাদের সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতার পক্ষে পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণ থাকায় নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, সত্য কখনো নিজেই প্রমাণিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষায়, ‘তুমি জান ক্ষুদ্র যাহা ক্ষুদ্র তাহা নয়, / সত্য যেথা কিছু আছে বিশ্ব সেথায় রয়’।

‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই!’- বিখ্যাত এই প্রবাদটি বিশেষ করে শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রমে বেহাল পরিস্থিতি, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, সনদ বাণিজ্য ও নয়-ছয় হিসেব-নিকেশের সঙ্গে অনেকটাই মানানসই। বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটির ভাবার্থ হচ্ছে – বাস্তব হিসাবে গড়মিল।

সত্যি বলতে কি, বিগত কয়েক বছর ধরে হাওরের বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হচ্ছে আসুরিক শক্তির উত্তাপ। শিক্ষা এক- তা হলো মনুষ্যতের শিক্ষা। আর মনুষ্যত্বের পরিচায়ক হলো চরিত্র। চেতনা এক নয়- এক চেতনার জন্য লায় পায়, আরেক চেতনার জন্য যান যায়। মুজিববর্ষে দিন বদলের দৃপ্ত শপথ হওয়া উচিত স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়—‘ওঠো, জাগো, নিজে জেগে অপরকে জাগাও’।

এক্ষেত্রে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ.পি.কে. আব্দুল কালামের উক্তিটিও প্রণিধানযোগ্য—‘যে অন্যদের জানে, সে শিক্ষিত। কিন্তু জ্ঞানী হলো সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে জানে। জ্ঞান ছাড়া শিক্ষা কোনো কাজে আসে না’।

যে মানুষ নিজের আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে এবং অন্যের আত্মার মাঝে নিজের আত্মাকে জানে, সে-ই জানে সত্যকে।

আসলে মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই সত্য ও মিথ্যার পথচলা শুরু। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে লড়াই হয়েছে প্রতিনিয়ত। দ্বন্দ্ব হয়েছে সত্য ও মিথ্যার, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে। সত্যের জয় হয়েছে লড়াই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই। আমরা জানি, সত্য ও মিথ্যা – এই দুই বিপরীত শক্তির মধ্যে দিয়ে পথ চলতে হয় মানুষকে। সত্যের শক্তি মানুষকে সৎ, নির্লোভ ও ত্যাগী জীবনের দিকে চালিত করে। মিথ্যার শক্তি মানুষকে নিয়ে যায় লালসা, পরিভোগ ও স্বার্থপরতার পথে। মিথ্যাশ্রয়ীরা নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। যেমন- ফেরাউন, হিটলার, মুসোলিনী প্রমুখ।

বছরের পর বছর অনুপস্থিত থাকলেও নিয়মিত বেতন তোলেন মাদরাসা শিক্ষক

সত্যং শিবং সুন্দরতম। অর্থাৎ সত্যই বিধাতা এবং সত্যই সুন্দর। সত্যের আঁকড়ে বাঁধা এ পৃথিবী। অসত্য আছে বলেই সত্য অমৃত ও চূড়ান্ত। সত্যকে ধারণ করতে হয়। সত্যের পথ বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ। সত্যের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন যিশুখ্রিস্ট। সত্যাশ্রয়ী জোয়ান অব আর্ককে ‘ডাইনি’ বলে মিথ্যা অভিযুক্ত করে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। দেশপ্রেমিক দার্শনিক সক্রেটিসকে সত্যকে সমুন্নত করতে হেমলক বিষ পান করে জীবন দিতে হয়েছে। এরাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিরঞ্জীব।

কখনো অসততার জয় হলেও চূড়ান্ত বিচারে সততার জয় হবেই, অবশ্যম্ভাবী। সততাই মানুষকে মুক্তি ও কল্যাণের পথ দেখায়। এক আকাশ মেঘ চূড়ান্ত লড়াইয়ে একটা সূর্যের সামনে হেরে যায়। মিথ্যার সাজানো ধমক নিমিষেই পরাস্ত হয় এক চিলতে সত্যের আগমনে।

দুই.

‘আমার একার আলো সে যে অন্ধকার, / যদি না সবারে অংশ দিতে পারি তার’… তেমনি মানবসত্তার এক মহীপাল ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। তিনি অঙ্কুরেই বুঝে গিয়েছিলেন যেকোন সমাজের উন্নতির মূলে যেসব বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ তম্মধ্যে- শিক্ষা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, সময়োপযোগী চেতনা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ অন্যতম।

দেশ ও জাতির বড় সম্পদ হচ্ছে তার জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদে সুশিক্ষাই উন্নয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ পথ, যা নিশ্চিত করা গেলেই কেবল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠন করা যাবে। জাতির জনকের বহুমুখী সেই উদ্যোগের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেয়ে সাবেক সংসদীয় আসন কিশোরগঞ্জ-৪ অর্থাৎ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলার হাওরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানপ্রধান করে আমাকে দিয়েও গড়িয়েছিলেন একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিগত ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর অষ্টগ্রাম উপজেলার খেলার মাঠে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশেও বলেছিলেন, ‘ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলায় আমি শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছি; কিন্তু তেমন বাড়ছে না শিক্ষার মান। হাওরের শিক্ষার মান নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই।’

কীভাবে বাড়বে শিক্ষার হার ও মান? শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার মতো প্রতিষ্ঠাপ্রধান এবং হাসান মো. ফরহাদের মতো শিক্ষক থাকলে!

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলা ৯ লাখ ৯০ হাজার ৩৯৬ হেক্টর আয়তনের এই বিশাল এলাকার জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার বাংলাদেশের অন্যসব এলাকা থেকে এখনো বেশ পিছিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ হলেও ইটনায় ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ, মিঠামইনে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ, অষ্টগ্রামে ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ ও নিকলীতে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ মাত্র।

শিক্ষার হার এতো কম হওয়ার কারণ বহুবিধ। শিক্ষাক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেহালদশা, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হওয়ায় বর্ষাকালে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পারা, শুকনায় বোরো মৌসুমে ফসল রোপণ ও কাটার কাজে জোগালি দেওয়া। তদুপরি রাজনীতি যুক্ত করে ফেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেড়েছে অযাচিত হস্তক্ষেপ। ফলে অনেকাংশে শিক্ষকরা গণ্য হচ্ছেন ভৃত্যে। এতে শিক্ষকরা হারাচ্ছে নিজস্ব স্বকীয়তা। অস্তিত্ব টিকাতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিও।

তাছাড়া সময়ের বিবর্তনে পাল্টে যাচ্ছে সভ্যতার রূপ,পারিপার্শ্বিক জীবনব্যবস্থাও। একদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা মিলে উদ্বিগ্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে সমাজসেবার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি আধিপত্যবাদ। নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি-কর্তৃত্ব বাড়াতে তথা নিজের স্বার্থ হাসিলে অরাজকতা বেছে নিচ্ছে এবং এসবের জেরে এ কলঙ্ক-স্বাক্ষর থেকে মুক্ত হতে পারছে না কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে সুবিধাবঞ্চিত হাওরাঞ্চল জাতীয় মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তিতে উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে হাঁটছে আবার সামগ্রিকভাবে একটি নৈতিক-মানসিক-সামাজিক অধঃপতন এবং অবক্ষয়ের মধ্য দিয়েও যাচ্ছে। অবক্ষয়ের এ চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠছে জীবনব্যবস্থায়ও, যা প্রভাবিত করছে নতুন প্রজন্মকে এবং দোলা দিচ্ছে তাদের মনোজগতকে। অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করছে সর্বত্রই অমনুষ্যত্বের বাগাড়ম্বরে উত্তম শিক্ষাব্যবস্থাতে দীনতার চিত্র।

অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের হলেও তাতে অনাচার প্রবেশ করায় সবকিছু মিলে হিসাব করতে গেলে খুব সহজেই আমাদের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে অসামঞ্জস্যতা প্রকটভাবে চোখে পড়ে। অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে সম্প্রতি মূলধারার সংবাদমাধ্যমে রাষ্ট্র হওয়া কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নে অবস্থিত শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসা প্রসঙ্গে আসা গেলে কী দেখা যায়? যেখান থেকে যাত্রা শুরু করা হয়েছিল সেখান থেকে কতটা এগোল? নাকি আরও এগিয়ে যাবার কথা ছিল?

‘কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর এলাকার নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন’ প্রকল্পে শ্যামপুর মাদরাসাটি স্থান না পাওয়া এবং জেলা পরিষদের প্রায় এক কোটি টাকা বরাদ্দ ফেরত যাওয়ার বিড়ম্বিত ভাগ্যবিপর্যয়ের অনুষঙ্গ হলো হঠকারীতাই দীর্ঘ একদশক ধরে মাদরাসাটি স্থানান্তরিতে অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ। মাদরাসাসাটি ২০০৫ সালে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে ২০১০ সালে এমপিওভুক্তির পর পরই ভর করে আসুরিক শক্তি, যে শক্তি মাদরাসার নামটিও পরিবর্তনের চেষ্টা চালায়।

স্বেচ্ছাচারীতা, অনিয়ম-কদাচার ও আয়-ব্যয়ের হিসেব-নিকেশ নিয়ে মাদরাসার জমিদাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো: জজ মিয়ার (বর্তমানে মরহুম) সঙ্গে সৃষ্ট বিরোধকে জুজু বানিয়ে পূর্বপ্রস্তুতিতে ২০১১ সালে জানুয়ারি মাসে রাতারাতি মাদরাসাটি শ্যামপুর থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় সুপার ‘কাজী মৌলভী’ বাড়ির পাশে ব্যক্তি মালিকানাধীন ধলাই-বগাদিয়া বাজারে। এরপর থেকেই মাদরাসাটি অস্তিত্ব এবং পাঠদান সংকটে অচল হয়ে পড়লেও কী জানি লায় পাওয়াতে কাজী মৌলভী সমর্থ হয় সবকিছুতে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকতে।

শেষতক ন্যায্যতার প্রশ্নে পিতার কাছ থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত সফল নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠা জননন্দিত নেতা কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের টানা তিনবারের নির্বাচিত এমপি রাষ্ট্রপতিপুত্র প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ন্যায়পালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে গত ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে মাদরাসাটি নিজভূমে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদ তৌফিক উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করে দেওয়া হলেও তা এক বছরেও নিজভূমে না ফেরায় এলাকাবাসীর মনে নানান প্রশ্ন ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে।

‘আমের চাইতে বড়া বড়’ হয়ে মাদরাসাটি কব্জায় রাখতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মিথ তৈরি করে এমপির সিদ্ধান্তের বিপরীতে বরাবরের মতো আলাদা এক অনৈতিক চেতনা জাগ্রত হচ্ছে। যা কি না নেতৃত্বের ভেতর নেতৃত্ব সক্রিয়তায় শক্তিমত্তারই প্রতিফলন।

এসব বাজে দৃষ্টান্ত সমাজে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে, যা বৃহত্তর হাওরের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব পাচ্ছে। ফলে খন্ডিত সত্যের সৃষ্ট পরিবেশ থেকে শিক্ষার্থীরাও নিজের স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতা ছাড়া ভালো কিছু শিখছে না। শিখছে না আত্মত্যাগ ও অপরকে সম্মান করতে। হারিয়ে ফেলছে মূল্যবোধ নৈতিকতা আর সুকুমার বৃত্তিগুলো। আগামী কর্ণধাররা ক্ষীণচেতা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বেড়ে উঠছে নিপাট অন্যায়ের মধ্যে বসবাস করে।

সুশিক্ষিত জাতি ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে ক্রিমিনাল কার্যক্রমকে ক্রিমিনাল কার্যক্রম হিসেবেই ট্রিট করা উচিত, রাজনীতি হিসেবে নয়। এপিজমেন্টের রাজনীতি বন্ধ করে আইডিওলজি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে অন্যায়কে। একে অস্বীকার করে এলিয়েনেশনের পথে গিয়ে শিক্ষিত উনিফাইড সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। কেননা, চার্লস ডিকেন্সের ‘গ্রেট এক্সপেকশন্স’ উপন্যাসে পিপ নামের বালকটি বলেছিল – ‘বাচ্চাদের ছোট দুনিয়াতে যেটা সবচেয়ে ভালোভাবে টের পাওয়া যায় সেটা হলো অন্যায়’।

পিপের সেই কথা ভয়ঙ্করভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে শ্যামপুর দারুল উলুম মাদরাসাটির ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান ক্রমেই হয়ে উঠছেন গল্পের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ‘কর্তা’। ইত্যকার কর্তাদের কর্তৃত্বে রাষ্ট্রপতির স্বপ্নের হাওরে নেমে এসেছে অদ্ভুত আঁধার এক, যে হাওরকে আজ বিশ্বও চিনে নিয়েছে তারই ত্যাগের মহিমায়।

পরিশেষে ‘মনেরে আজ কহ যে, / ভাল-মন্দ যাচাই আসুক সত্যরে লও সহজে’।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন