বিজ্ঞাপন

স্নিগ্ধা বাউল-এর অনুগল্প

May 2, 2022 | 1:06 pm

শীতকাল

বিজ্ঞাপন

পুরো আট ঘণ্টা তারা এক ঘরে ছিল। সকাল থেকে বিকেল পেরিয়ে তখন সন্ধ্যা। পুষ্পিতা আজ পরেছে হালকা সবুজের কামিজ। সঙ্গে শীতের শেষ সময়ে এসে আড়ং থেকে কেনা পাতলা একটা চাদর। সারাদিনে একটুও সরে যায়নি চাদরটি। শেষ চা খাবার সময়ে ‘পুষ্প’ বলে আচমকা ডাকে সৌম্য। পুষ্পিতা অবাক হয়; এই নামে ওকে একমাত্র বাবাই ডাকতেন। কিন্তু সৌম্যকে কখনো তা বলা হয়নি তো!

আজ ওদের প্রথম দেখা। বলা যায় তিন বছর ফোনে যোগ ওদের, কখনো অযোগ হয়নি। হিন্দু শাস্ত্রের বাণপ্রস্থকাল নয়, বরং গার্হস্থ্যকালের টইটম্বুর সময়ে চাকরি আর কর্মজীবনের বাইরে ব্যস্ততাহীন দু’টো মানুষ। পুষ্পিতার এক রাতজাগা রাতে সৌম্যর তাকে খুঁজে পাওয়া।

– এখনো ঘুমাননি?

বিজ্ঞাপন

– না।

– কেমন আছেন? আমি সৌম্য চ্যাটার্জি। কলকাতা থেকে বলছি। কোনো বাহানা ছাড়া বলছি, ছবিতে বেশ সুন্দর লাগছে আপনাকে।

অনেক্ষণ পর আবার সৌম্য লিখল—
– কী হলো! আমি কি বিব্রত করলাম আপনাকে? সরি বলব না। তবে এটুকু বলতে চাই— প্রশংসা করেছি আপনার, অন্য কিছু নয়।

বিজ্ঞাপন

– আমি পুষ্পিতা। আর হ্যাংলামো আমার একদম পছন্দ না।

– আমি হ্যাংলা নই। স্বাস্থ্য বেশ ভালো। তবে অম্ল আছে। আর মাঝে মাঝে একটু দুর্বল লাগে। কিছুদিনের মধ্যেই দিল্লি যাব। আপনার কিছু লাগলে বলুন।

– হা হা হা। আমি লাড্ডু খাই না!

এরপর বছর তিনেক চলে এভাবেই। আজ তাদের প্রথম দেখা হলো। সৌম্যর অসাধারণ কণ্ঠ আর ছবি আঁকার মুগ্ধতা ছুঁয়ে গিয়েছিল পুষ্পিতাকে। কখনো খুঁটিয়ে জানা হয়নি এমন একটি মানুষ কেন সবাইকে ছেড়ে একা থাকে। সৌম্যও জানতে চায়নি পুষ্পিতা কেন নিজের গল্প করে না। তবু তিন বছর থকথকে পারদের মতো জমে ছিল তাদের প্রতি প্রহরের গল্প। কখনো গান, কখনো ছবি, কখনো নদী, কখনো দুই বাংলার রাজনীতি— কখনো রান্না পুড়ে ছাই হয়েছে, কখনো সৌম্য হঠাৎই ফোন রেখে দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

– আচ্ছা, তুমি পুষ্প বলে কেন ডাকলে সৌম্য? এই নামে তো বাবা আমাকে ডাকতেন।

– শোনো, আমার মনে হয় তোমার আমাকে ফোনেই বেশি আপন মনে হয়। এড়িয়ে গিয়ে সৌম্য বললো, আর তোমাকে এখন ফুলের মতোই সুন্দর লাগছে!

– বাহ। সকালের ফুল বিকেলে ঝরে পড়ার আগে তোমার মনে হলো! এজন্য বলি, তোমার কাছে মেয়েরা কেন ঘেঁষে না!

– হয়তো।

– সারাদিনে একবারও ফুল ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করল না!

কিছুটা তাকিয়ে সৌম্যর নির্মোহ অথচ অবাক চাহনি। বলে, চলো যাই। ট্রেন ধরতে হবে।

শরীর ঘেঁষা পুরুষের চোখ পুষ্পিতার চেনা। সৌম্য তাকে ভালোবাসে। আর পুষ্পিতা ভরসা করে সৌম্যকে। ততটা ভরসা, যতটা করলে নিজেকে অর্পণ করা যায়।

আবার কর্মব্যস্ত জীবন। কলকাতা থেকে চলে এসেছে আজ দেড় বছর। সৌম্য এর মধ্যে দিল্লি গেছে আরও তিন বার। পুষ্পিতাকে বলে, লাড্ডু আনতে যাই।

টানা চার দিন ওদিকে কোনো খবর নেই। না ফোন, না ভাইবার, না মেইল। কোনো কাজ করা হচ্ছে না। হঠাৎই দুপুর কাঁপিয়ে ডেকে যায় ঢাকার আকাশে একটা চিল। পাখির সৌন্দর্য উপভোগ যতটা হবার কথা আজ, আর হচ্ছে না পুষ্পর। এক চিলতে আকাশ জানালার কাছে ডেকে যায় মেঘদূতের বাহানায়, বহুদিন পর এমন লাগে যেন বৃষ্টি হবে সব কাঁপিয়ে।

সন্ধ্যার পর পর খবরটা আসে। দিল্লিতে ডেডবডি। লিভার ক্যানসার ছিল বহুদিন।

আগামী ডিসেম্বরে আবার যাবার কথা ছিল। চায়ের জল বসিয়ে পুষ্প ভাবে, এখনই শীত-শীত লাগছে। ডিসেম্বর কি তবে চলে এসেছে হঠাৎ!

মধু দা

আমাদের মধুকে কে না চিনত! বিশেষ করে এই বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাস ধরে তার রাত-দিন এত ব্যস্ততা! আম-জাম নামের যে গাছগুলোতে টসটস করত বাতাসের ফোড়ন, মধু সেখানে হাজির। কোনো বাড়ির টিনের আওতা বেড়া কীভাবে কখন টপকাতে হয়, মধু জানে। ঝিনুকের ধারালো আম কাটার বিশেষ ছুরিটা আমি মধুর কাছেই দেখি। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম ওর আম কাটার কাজটা। এক টুকরা দে না মধু দা, বললেই একটা আম দিয়ে দিত।

পুকুরপাড় ধরে যে লম্বা গাছটায় জাম পেঁকে টসটস করত, সকাল সকাল মধুকে ওখানেই পাওয়া যেত। সাদা বলতে ওর ভাঙা দাঁতগুলোতে তখন কিছুই ছিল না। বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে গান গাওয়ার সময় মধুর ভাঙা দাঁতগুলো থেকে ফুস ফুস করে যে বাতাস বের হতো, তা দেখতে দাঁড়িয়ে থাকত মধুর গরুগুলো। হ্যাঁ, মধুর সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব ওর গরুগুলোর সাথে। কেউ মধুরে গাছ থেকে নামিয়ে কান মলে দিয়েছে আর সে মধুর গরুর তাড়া খায়নি, এমন হয়নি।

নদীর পাশে গরুগুলোকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য যে সময়টা মধু পেত, সে সময়ে মাঠে শুয়ে আকাশে তাকিয়ে মধু স্বপ্ন দেখত সে নায়ক হবে। বাংলা সিনেমার নায়ক। মিঠুনের মতো নায়ক। একবার টাকা চুরি করে মধু এফডিসিতে ঘুরে গেছে। গরুর গায়ের সাথে যখন থাকত মিশে, মধু তখন ভাবত সে হেলিকপ্টার চড়ে বসে আছে। গরুগুলোও জানত যেন মধু তাদের নায়ক।

মধুকে নিয়ে সবাই হাসত, আমি হাসতাম না। আমার তাকে নায়ক মনে হতো। কেমন করে এক ঘুষিতে সে আম ভেঙে ফেলত, গান গাইতে গাইতে ডিঙচা ডিঙচা নাচত, আর কেউ বললেই মধু মাইকেল জ্যাকসনের মতো নেচে দেখাত। আমরা তখন খুব আনন্দ পেতাম। একবার বিদেশি এক ভদ্রলোক এলে মধু তার ব্যাগগুলো টেনে নিয়ে যেত। সে এবার বিদেশ যাবে। মধু এবার ইংরেজি শিখতে শুরু করে। তার ইংরেজি এমন ছিল— ভদ্রলোক জানতে চাইল তার দাঁত কেন ভেঙে গেছে, মধু ভাঙা দাঁতগুলো কেলিয়ে বলল— আই সাম রানিং, টিল্লুর দিয়া পৈরা টাক্কুর দিয়া ভাইঙা গেছে! মধুর স্বপ্নও ভেঙে যায়। তার আর বিদেশ যাওয়া হয় না!

মধুর গরুর বাছুর বিয়ানো হয়েছে। বাছুরও তিড়িং বিড়িং করে মধুর সাথে। এত আনন্দ লাগে মধুর। গোয়াল ঘরে বসে আমরাও আনন্দ নিয়ে খেলাম নতুন শাল দুধের পায়েস।

মধুর সব ভালো লাগে, কেউ মারলেও ভালো লাগে। কেবল ভালো লাগে না তার বৃদ্ধ বাবার সাথে ভিক্ষা করতে যেতে। সে যায় না, সে নায়ক হবে।

মধু একদিন সত্যি সত্যি নায়ক হয়ে গেল। পাড়ার সবচেয়ে লম্বা নারিকেল গাছটায় রাতের অন্ধকারে বন্ধুরা চুরি করতে গেল। সবাই নিচে দাঁড়িয়ে, আর নায়ক মধু গাছের মাথায়! বাড়িতে আলো জ্বলে উঠলে সবাই যখন পালায়, মধু মিঠুনের মতো লাফ দেয় সবচেয়ে উঁচু গাছ থেকে। এক লাফে ফেটে পড়ে মধুর শরীরের ভিতরের ফুসফুস, হাড়গোড়সহ সমস্ত মধু।

মধুর গরুগুলো মাঠ থেকে ফিরে সারারাত গোঙায়। দিন সাতেক পরে দু’টি গরুই ফিরে যায় মধুর কাছে।

নিরোধক

পাঁচবছর হলো টিবি রোগটা কোনোরকমে সেরে উঠেছে। সংসারে টানাটানির মধ্যেও একটা অসুস্থ মানুষকে বেশ টেনেটুনে সুস্থ করে তুলতে হয় মালতীকে। ডাক্তারের পরামর্শ একটাই— সিগারেট ছাড়তে হবে। তবেই সম্ভব এই পড়ন্ত বয়সে ভালোভাবে বেঁচে থাকা। মালতী জানে কতটা দুর্বোধ্য এই ক্ষয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের কাছে সিগারেট ছাড়ার মতো আভিজাত্য। চেয়েছে স্বামীর নতুন করে পান খাওয়ার অভ্যাস হোক। তরকারির ঝালটা আগের মতো বাড়িয়ে দিয়ে ভেবেছে— বুঁদ হয়ে থাকুক লালচে মরিচের কাছে। কোনোদিন বুঝতে পেরে নিজেই লুকিয়েছে পন্ডস পাউডার মাখা সেই গন্ধটা। ষাটের এ দম্পতি একসাথে টিভি দেখতে বসে সিরিয়ালের শেষ পর্যন্ত, তবুও যেন কোথাও টান একটা ধীরে ধীরে চুপিচুপি।

আজ একুশ দিন। লকডাউনে নিরোধক রোদ এসে পড়ে সিগারেটহীন মালতীর দাম্পত্যে।

হাইলি সাসপিশাস

সম্ভবত আজ ছয় মাস দশ দিন লকডাউন হলো। ফারদিনের চুলগুলো কানের কাছে নেমে এসেছে। গোঁফ আর দাঁড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে সে এক অদ্ভুত লুক দিয়ে তৈরি করেছে আরামদায়ক একটি দিক। বাবার পেনশনের টাকায় চলছে যেমন তেমন, তবে প্রাইভেট ফার্মে কাজ করা বড় ভাই আর বেতন পাবে বলে ভরসা নেই। দুই মাস ধরে বাড়িওয়ালা বেল চেপে মাস্ক মুখ থেকে সরিয়ে ঘটর ঘটর কিছু বলে যায় ফারদিনের মাকে। প্রথম প্রথম পরিচালিত নানা লোক দেখানো মানবিকতাও খসে পড়েছে এবং ওর মা ভদ্রমহিলা ওই মধ্যবিত্তদের জন্য চুপিসারে চাল চাওয়ার ফোন নম্বরে আজকাল ফোন করে কেবল বন্ধ পায়। ফেসবুক, টিভি কিংবা ইলেকট্রিসিটির সরবরাহ বন্ধ বললেই চলে। আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যার তুলনামূলক বিচার আর নেই, যে যেখানে যখন খুশি মরছে এবং তুলনায় প্রতিটি পরিবারই আক্রান্ত।

ফারদিন খেয়াল করল, সে গোসল করছে না প্রায় ২০ দিন এবং এ নিয়ে মা বা পরিবারের কারো কোনো দরবার নেই। এবং এ পরিবারের রান্না হচ্ছে কখন কতটুকু বা কে খাচ্ছে অথবা খাচ্ছে না, কেউ জানছে না। মা জায়নামাজ আর বৃদ্ধ বাবা তসবি নিয়ে বসে আছেন। ছোট বোনটি সারাদিন দরজা লাগিয়ে কী করে জানা যায় না। এবং ফারদিন নিজেও জানে না সে সারাদিন কী করে!

ফারদিন আজ বাইরে যাবে। তার মন বলছে— যেহেতু রোগীর সংখ্যা সুস্থ মানুষের চাইতে বেড়েই চলেছে এবং এত দিনে কেউ কেউ সুস্থ মানুষের গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে ভাইরাস বীজ, তারও আক্রান্ত হওয়া প্রয়োজন। হাঁটছে ফারদিন তখন করোনা রোগীদের ভিড়ে।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন