বিজ্ঞাপন

পীরের অলৌকিক শক্তিধর লাঠি

May 2, 2022 | 5:56 pm

বিভুরঞ্জন সরকার

দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কখনও কোনো সংবাদ ছাপানো জন্য কেউ টেলিফোনে হুমকি দিয়েছেন, গালাগাল করেছেন। আবার কখনও কোনো সন্ত্রাসী সামনে এসেও পিস্তল উঁচিয়ে হত্যা করতে চেয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থায় ডেকে নিয়েও হুমকিধামকি দেওয়া হয়েছে। দু’একজন সরকার প্রধানের চোখ রাঙানিও সহ্য করতে হয়েছে। আবার অনেক মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছি। সবমিলিয়ে খারাপ নয় অতীত স্মৃতি। টক-ঝাল-মিষ্টি। আজ তার মধ্যে থেকেই একটি ঘটনার কথা তুলে ধরছি।

বিজ্ঞাপন

১৯৮৯ সালের কথা। তখন লে জে হো মো এরশাদের জামানা। আমি কাজ করি সাপ্তাহিক ‘একতা’য়। সে বছর ২ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে জয়পুরহাট গেলেন একজন পীরের সঙ্গে দেখা করতে। পীরের নাম মজিবর রহমান চিশতি। তাকে নিয়ে, তার ‘অলৌকিক’ শক্তি বা ক্ষমতা নিয়ে নানা কাহিনী সে সময় চালু ছিল। বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদও ওই পীরের আস্তানায় হাজিরা দিয়েছেন।

আমার ইচ্ছা হলো জয়পুরহাট গিয়ে সরেজমিন একটি প্রতিবেদন করার। সম্পাদক মতিউর রহমান, সহকারী সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুরও আগ্রহ ছিল বিষয়টি নিয়ে। যাত্রা করলাম জয়পুরহাটের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারি আমার কাজটি সহজ নয়। পীরের মাজার শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক নিভৃত গ্রামে। চরবকর ইউনিয়নে। হেঁটে যাওয়া ছাড়া সেখানে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। বেনজীরের সফর উপলক্ষ্যে সেনাবাহিনী বিশেষ ব্যবস্থায় জয়পুরহাট শহর থেকে পীরের বাড়ি পর্যন্ত ইট বিছিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করলেও সে রাস্তায় সাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ। শুধু নিরাপত্তা কর্মী বা সেনাবাহিনীর গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাটি। আমি ওই গ্রামে যেতে চাই এবং পীর চিশতির মুখোমুখি হতে চাই -এটা শুনে স্থানীয় সাংবাদিকরা কেউ নিরূৎসাহিত করলেন। কেউ দেখালেন ভয়।

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা-
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ -কবিগুরুর এই লাইন দুটি আমি বলতে গেলে সারাক্ষণ মনে মনে আউড়াই। যেহেতু আমার জীবনে বিপদ এবং ভয়ের ভাগ বেশি। তাই এ দুটোকে তাড়ানোর মন্ত্র হিসেবে রবি ঠাকুরের আশ্রয় নেই। উপকারও পাই। একেবারে খাদের কিনারে দাঁড়িয়েও নিচে না পড়ে কী করে যেন রেহাই পেয়ে যাই। যাহোক, জয়পুরহাটে আমি যে মিশন নিয়ে গেলাম অর্থাৎ পীর মজিবর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া এবং বেনজীর ভুট্টোর মতো একজন আধুনিক শিক্ষিত নারী কেন তার সঙ্গে দেখা করতে উড়ে এলেন সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা – আমার এই উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার আশঙ্কায় মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। একটা জেদও চাপতে শুরু করল।

বিজ্ঞাপন

জয়পুরহাটে আমার পরিচিত দুএকজনকে খুঁজে বের করলাম। তারা জানালেন, পীর সম্পর্কে নানা রকম কথা চালু আছে। তার অনেক মুরিদ। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ যেমন বলতে পারেন, তেমনি বালা-মুসিবতও নাকি দূর করতে পারেন। কাজেই অনেকেই তার দরবারে হাজিরা দেন। আয় রোজগারও ভালো। গরিব মুরিদ তার নেই বললেই চলে। সব টাকাওয়ালা এবং উঠতি ধনিকেরা তার শিষ্য। তার গ্রামের লোকেরা তাকে খুব ভালো মানুষ মনে করেন না। পছন্দও করেন না। পীর মজিবর নাকি একটি লাঠি ব্যবহার করেন। ওই লাঠিও নাকি অলৌকিক ক্ষমতাধর। পীর ছাড়া আর কেউ নাকি ওই লাঠি হাতে তুলতে পারেন না। পীর ধরলে লাঠি হালকা হয়ে যায়, অন্য কেউ ধরলে নাকি ওজন এত বেড়ে যায় যে কারো পক্ষে তা উত্তোলন করা সম্ভব হয় না।

আমার খুব ইচ্ছা হলো, আহা একবার ওই লাঠিটা যদি ছুঁয়েও দেখতে পারতাম! পীরের দোয়ার বরকতে আমারও বদনসিব হয়তো দূর হয়ে যেত! কিন্তু আমি পীরের কাছে পৌঁছবো কীভাবে? তার পুরো গ্রাম কড়া নিরাপত্তা নজরদারিতে। একে তো এরশাদি শাসন, তার ওপর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর আগমন! দুয়ে মিলে ওই গ্রামে কোনো বহিরাগত মানুষের গমনাগমন অসম্ভব! একজন পরামর্শ দিলেন, বেনজির চলে যাওয়ার পর পীরের সঙ্গে দেখা করার একটি ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমার মন কিছুতেই পরাজয় মানতে চাচ্ছে না।

আমি বললাম, আমি রাতেই পীরের গ্রামে যেতে চাই। কেউ একজন আমার সঙ্গী হলেই চলবে। কিন্তু কেউ সঙ্গী হতে রাজি হয় না। একজন উল্টো ভয় দেখান, আপনি হিন্দু মানুষ। ধরা পড়লে ‘ভারতীয় চর’ হিসেবে মিলিটারি প্যাঁদানি ভাগ্যে জুটতে পারে। আমি দমে যাই। মারপিটে আমার খুব ভয়। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। এভাবে হার মানতে হবে! পথঘাট চেনা থাকলে একাই রওয়ানা দিতাম। কিন্তু রাতের বেলায় রাস্তায় হয়তো কাউকে পাবো না, তখন ‘পথ হারিয়ে কোন বনে যাই’ অবস্থায় না পড়ি! আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে একজনের মনে একটু বুঝি দয়া হলো! বললেন, চলেন বেরিয়ে পড়ি। পীরের গ্রামের পাশের গ্রামে তার এক আত্মীয় আছেন, সেখানেই আমরা গিয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম।

বিজ্ঞাপন

শহর থেকে গ্রামটি খুব দূরে নয়। আলপথ দিয়ে হেঁটে যেতে আমার সম্ভবত ঘণ্টাখানেক লেগেছিল। কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই গন্তব্য গিয়ে পৌঁছলাম। গৃহকর্তা প্রসন্ন হলেন, না বিষন্ন হলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে সব শুনে তিনি বললেন, এই ভণ্ডটার জন্য এতো কষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। ব্যাটা একটা পাকিস্তানি চর! আমাকে বিস্মিত হতে দেখে গৃহকর্তা বলেন, বোঝেন না, ওর কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এমনি এমনি এসেছেন? বুঝতে পারেন না, কানেকশনটা! উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় যুক্তিটি।

রাতের খাবার রেডি হতে একটু সময় লাগলো। ভদ্রলোক বললেন, খুব ভোরে তিনি আমাকে পীরের এক ভক্তের বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু ভোরে আর সেখানে যাওয়া সম্ভব হলো না। পুরো গ্রামজুড়ে কড়া পাহারা কিলবিল করছে মিলিটারি, পুলিস ইত্যাদিতে। বেনজির ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কারো বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। তবে সকালে বুঝলাম, আমি একেবারেই কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সামান্য দূরেই পীরের বাড়ি বা দরবার। প্রায় খালি জায়গায় অতি সুন্দর এক ভবন। চারদিকে ফসলের মাঠ। দরবার সংলগ্ন খালি মাঠেই নামবে বেনজিরকে বহন করা হেলিকপ্টার।

সকাল এগারোটায় বেনজিরের পৌঁছানোর কথা। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সরকারি প্রশাসন কিছু বাছাই করা লোক হাজির করবে। তবে সংখ্যায় খুবই কম। বেনজির সরাসরি পীরের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর আবার ঢাকা ফিরে যাবেন।

হেলিকপ্টার যথাসময় নামল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম বেনজিরের নেমে আসা। সালোয়ার-কামিজ পরা মাথায় ওড়না জড়ানো বেনজির দ্রুত পায়ে ঢুকে গেলেন পীরের আস্তানায়। গ্রামের লোকজন বেনজিরকে দেখার জন্য যতোটা না, তারচেয়ে বেশি নিশ্চয়ই হেলিকপ্টার দেখার জন্য ঘরের বের হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের সামাল দিচ্ছেন। সর্বোচ্চ আধাঘণ্টার মধ্যে ফের আকাশে উড়ল বেনজিরকে বহন করা হেলিকপ্টার, উদ্দেশ্য ঢাকা। আর আমি পীর দর্শনের উপায় ও উছিলা খুঁজতে থাকি।

বেনজির ভুট্টো চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিরাপত্তার কড়াকড়ি কমতে শুরু করল। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, গ্রামের লোকজনের পীরের দরবারে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। যে যার মতো নিজ নিজ বাড়িঘরের দিকেই ফিরে যাচ্ছে। আমি এখন কি করি? গুটি গুটি পায়ে পীর সাহেবের আস্তানার দিকে এগুতে থাকি। তখন আর কেউ বাধা দেওয়ার নেই।

আমি পীর সাহেবের একেবারে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কয়েকজন মাত্র লোক ঘোরাঘুরি করছেন। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ওই লোকগুলো পীরের মুরিদ কিংবা নিজস্ব বাহিনীর সদস্য বা তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাদের মধ্য থেকে একজন আমার কাছে এগিয়ে এলেন। নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন। কাউকে খুঁজছি কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করলেন। আমি নামটা ঠিক না বলে অন্যসব তথ্য দিলাম। নাম বললাম আব্দুর রহমান। এই নামে বহু মানুষ আছেন। অতি কমন একটি নাম। কেন আমি নাম গোপন করলাম? বুঝেশুনেই এটা করলাম। একজন ‘হিন্দু’র জন্য পীরের সাক্ষাৎ পাওয়া সহজ না-ও হতে পারে।

নাম ভাড়িয়েও কোনো লাভ হলো না। আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হলো যে ‘হুজুর’ সেদিন এবং পরের আরো দুইদিন কাউকে সাক্ষাৎ দেবেন না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত কষ্ট করে এবং কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কিছু না জেনেই চলে যাবো!

আমি পাহারায় নিয়োজিত লোকটির কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করলাম কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। বারবার একই অনুরোধ করতে থাকায় লোকটি বললেন, কি জানতে চান আপনি?
আমি বলি: পীর সাহেবের দোয়া চাই আর চাই একটি ছোট সাক্ষাৎকার।
তিনি বললেন: দোয়া-সাক্ষাৎকার কোনোটাই পাবেন না।

আলাপ আরও আগে বাড়াতে চাই। ওই লোককেই ধরি, তাহলে পীর সাহেবের আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার গল্প শোনান দুচারটা…। আমার কথা শেষ না হতেই লোকটি কিছুটা যেন স্বগোক্তির মতো করে বললেন, ‘আরে এই পীর হলো পাকিস্তানের দালাল। তার কাছ থেকে আর কি জানবেন? আপনাকে গোপনে একটি কথা বলি, এই পীরের ভূয়ামি শিগগিরই বন্ধ হবে। দেখবেন পীর সাহেবকে তার শিষ্যদেরই কেউ হয়তো খুন করে ফেলবে। পীরের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।’ ব্যস, আমি নিউজ পেয়ে গেলাম। দরকার নেই আর কিছু জানার। বেনজির ভুট্টো কেন পীর মজিবরের সঙ্গে দেখা করতে এলেন সেটার চেয়ে আমার কাছে ‘হট’ খবর হলো সহসাই খুন হবেন পীর সাহেব!

ঢাকা ফিরে আমি একটি সরেজমিন প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ‘একতা’য় ছাপাও হয়েছিলো। অনেকেই প্রতিবেদনটির প্রশংসা করেছিলেন।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ওই ঘটনার কয়েক বছরের মধ্যেই ২০০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাড়িতে দৃর্বৃত্তদের হাতে খুন হন পীর মজিবর রহমান চিশতি। কোথায় গেলো তার অলৌকিক শক্তিধর লাঠি?

নিজের ভাগ্যের পরিণতি যার জানা ছিল না, তার কাছেই কিনা বিখ্যাত সব মানুষ ছুটতো ভাগ্যবদলের ‘দাওয়াই-তাবিজ’ নিতে! সত্যি সেলুকাস, কি আজব এই দেশ!

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন