বিজ্ঞাপন

লীলা স্যামসন: রূপান্তরের কারিগর

May 6, 2022 | 11:23 am

আনিসুল ইসলাম হিরু

ভরতনাট্যম- প্রাচীনতম ভারতীয় নৃত্যকলার অন্যতম এই ধারা এখন শুধু ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবীতে খ্যাতি অর্জন করেছে তার অপরূপ ভাষা এবং সেই ভাষার মধ্য দিয়ে নৃত্যের অপরিসীম সৌন্দর্যের জন্য। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এই নৃত্যকলাকে সারা বিশ্বব্যাপী প্রসার ও প্রচারে যে ক’জন নৃত্যশিল্পী নিরলস কাজ করে চলেছেন, তাদেরই একজন ভারতের ‘পদ্মশ্রী লীলা স্যামসন’। তিনি শুধুমাত্র একজন নৃত্যগুরুই নন, একাধারে দায়িত্ব পালন করেছেন ‘কলাক্ষেত্র’র পরিচালক হিসেবেও। পরবর্তীকালে ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমি’র চেয়ারপারসন এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ডের চেয়ারপারসন হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

আজ (৬ মে) এই মহীয়সী শিল্পীর জন্মদিন। বিশেষ এই দিনে সারাবাংলার পাঠকদের জন্য তাকে নিয়ে লিখলেন তারই ১ম বাংলাদেশী শিষ্য গুণী নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যগুরু আনিসুল ইসলাম হিরু…

সবাই আমাকে ভরতনাট্যম শিল্পী হিসাবে চিনলেও আমি ছিলাম মনিপুরী নৃত্যশিল্পী। এই উপমহাদেশের একজন মনিপুরী নৃত্যগুরু ছিলেন শান্তিবালা সিনহা। উনি ছিলেন গুরু বিপিন সিংহের শিষ্যা এবং মনিপুরী নৃত্যের আরেক কিংবদন্তি গুরু কলাবতী দেবীর বোন। আমি তার কাছে দেড় বছর মনিপুরী নৃত্যে তালিম নিই। উনি কানাডায় চলে গেলেন। আমার আর মনিপুরী নৃত্যে এগুনো হলো না। এভাবেই কেটে গেল আরও বেশ কয়েকটা দিন।

বিজ্ঞাপন

একদিন আমার হাতে পড়ল ভারতের ‘দেশ পত্রিকা’র একটি সংখ্যা। যে সংখ্যাটা ছিল পুরোটাই নাচ নিয়ে। বিভিন্ন নাচের ইতিহাস এবং সেইসাথে ভারতের বিখ্যাত সব নাচের গুরুদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। সেখানেই আমার চোখে পরে ভরতনাট্যমের নৃত্যগুরু শ্রীমতি লীলা স্যামসন সম্পর্কে আর্টিক্যাল আর তার নাচের বিভিন্ন মুদ্রার ছবি। যা পড়ে এবং দেখে আমার ভীষণ ভালো লেগে যায়। বলা যায় আমার অবচেতন মনে তীব্র ইচ্ছা জাগে, ওনার কাছে যদি ভরতনাট্যম শিখতে পারতাম। যেমন দেবীর মতো দেখতে, তেমনি অসাধারণ তার নাচের ভঙ্গিমা। যদি তার সান্নিধ্য পেতাম!

মনে বাসনা ছিল, কিন্তু তখন সেটা নিয়ে সেভাবে আর আগানো হয়নি। অর্থনীতিতে অনার্স শেষ করার পর আমার এমন একটা সময় গিয়েছিল, যখন আমি মানসিকভাবে ভীষণ টানাপোড়েনের মধ্যে ছিলাম। সেই সময়টাতে আমি চাচ্ছিলাম দেশ ছেড়ে চলে যেতে। আর তখনই আমি ভারতে একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম, আমি সেটা একদম ছোঁ মেরেই নিয়ে নিলাম। ইন্ডিয়াতে গিয়ে প্রথমে আমি বরোদা ইউনিভার্সিটিতে গুরু সিভি চন্দ্রশেখরের কাছে নাচ শেখা শুরু করলাম। কিন্তু ওখানকার আবহাওয়ায় নিজেকে সেট করতে পারছিলাম না। পাশাপাশি আবার ইউনিভার্সিটিতে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করতে মন চাচ্ছিল না। দেশে ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ছয় বছর পার করে অনার্স শেষ করেছিলাম। আবার আরেকটা ডিগ্রির জন্য নতুন করে পড়ালেখা শুরু করার মতো ধৈর্য আমার ছিল না।

বিজ্ঞাপন

বরোদাতে পড়ছি ঠিকই, কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। কোনভাবেই মনোযোগী হতে পারছিলাম না। কারণ আমার মন পরে আছে, কখন আমি দিল্লি যাবো- গুরু শ্রীমতী লীলা স্যামসনের দেখা পাবো। এরমধ্যে আমারই এক সহপাঠী অনুপ কুমার দাশ (যিনি সম্প্রতি প্রয়াত একজন গুণী কত্থক নৃত্যশিল্পী) আমাকে জানালো যে, ভারতীয় কলা কেন্দ্রে গেলে আমি শ্রীমতি লীলা স্যামসন-এর দেখা পাবো। আমি নিজেই যোগাযোগ করে সেখানে গেলাম। তার দেখা পেলাম, পরিচিত হলাম। আমি বিনীত ভাবে তার কাছে নাচ শেখার আগ্রহ জানালাম। উনি আমার কাছে অনেককিছু জানতে চাইলেন। একপর্যায়ে তিনি রাজি হলেন। আমাকে একটা চিঠি লিখে দিলেন, যেটা নিয়ে আমি ইন্সটিটিউটে যোগাযোগ করে ভর্তি হতে পারি। একইসাথে মন্ত্রণালয় বরাবরেও একটা চিঠি লিখে দিলেন। আমি চিঠিটা নিয়ে সোজা চলে গেলাম ইন্সটিটিউটে। ভর্তি হলাম। বরোদা থেকে চলে এলাম দিল্লিতে। আসার পর আমার মনে হল, আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি ঘটলো। বলা যায়, তখনই আমার স্বপ্ন, আমার ভবিষ্যৎ যেন নতুন এক পথে যাত্রা শুরু করলো।

তাকে গুরু হিসেবে পাওয়াটা ছিল আমার জন্য অতি সৌভাগ্যের। ওনার কাছে শুধু নাচই শিখিনি, আজ পর্যন্ত জীবনে যা কিছু করতে পেরেছি তার সবটুকুই উনার কাছ থেকে শেখা। জীবনকে যাপন কিভাবে করতে হয়, আমাকে তিনি হাতে ধরেই শিখিয়েছেন। আগেই বলেছি নাচ হচ্ছে পুরোপুরি গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু হিসাবে উনি কোথাও কার্পণ্য করেননি। আমার পথ চলার দরজাটা খুলে দিয়েছেন উনিই। আমি আমার গুরুকে কখনো গুরু বলতাম না। বলতাম ‘আক্কা’। এটি সাউথ ইন্ডিয়ান একটি শব্দ। বাংলায় যার অর্থ ‘দিদি’ বা ‘বোন’। এখনো তাকে তাই বলেই ডাকি।

বিজ্ঞাপন

আমার গুরু ‘শ্রীমতী লীলা স্যামসন’-এর জন্ম ভারতের তামিলনাড়ুতে ১৯৫১ সালের ৬ মে। আক্কা (আমার গুরুকে আমি এই নামেই ডাকি)-এর বাবা ভারতীয় নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল বেঞ্জামিন আব্রাহাম স্যামসন এবং মা লায়লা স্যামসন। পড়াশোনা কলাক্ষেত্রে। স্কুলে পড়ার পাশাপাশি নাচটাও শিখেছেন সমানতালে। আক্কার পড়াশোনা চলাকালীন বিশেষ একটি ট্রেনিং নিতে তার বাবা-মাকে ছ’মাসের জন্য লন্ডনে যেতে হয়। আর সেসময়টাতে তাদের মেয়েকে নিয়ে যাওয়াটা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তারা আক্কাকে কলাক্ষেত্রে আবাসিক ছাত্রী হিসেবে ভর্তি করে দিয়ে যান। প্ল্যান ছিল লন্ডন থেকে ফিরে এসেই আবার তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। শুনেছি, সেসময় আমার গুরু নাকি তার বাবা-মাকে ছেড়ে থাকতে হবে জেনে খুব কেঁদেছিলেন। মজার ঘটনাটা ঘটল ছ’মাস পরে। আক্কার বাবা-মা লন্ডন থেকে ফিরে কলাক্ষেত্রে এলেন তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। কিন্তু না! আক্কা ফিরিয়ে দিলেন তার বাবা-মাকে। কারণ মাত্র ছ’মাসেই কলাক্ষেত্র তার প্রিয় জায়গা হয়ে উঠল। বাবা-মা’র আপত্তি টিকল না। পরে তারা মেয়ের ইচ্ছাটাকেই মেনে নিলেন। এরপর একটা সময় যখন আক্কার পড়াশুনা শেষ হলো, বাবা-মা তাকে মেডিকেলে ভর্তি করাতে চাইলেন। বাবা-মা’র ইচ্ছানুযায়ী তিনি মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। ততদিনে একজন গুণী নৃত্যশিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিত হয়ে উঠলেন আক্কা। এদিকে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আক্কার বাবা-মা’কে বললেন, এমন একজন প্রতিভাবান শিল্পীকে ডাক্তারির গণ্ডিতে না বেঁধে, নাচ নিয়েই থাকতে দেওয়া উচিৎ। এক্ষেত্রেও অধ্যক্ষের অভিমত মেনে নিলেন বাবা-মা। আক্কা ভর্তি হলেন সাধারণ শিক্ষায়। ধীরে ধীরে শাস্ত্রীয় নৃত্য ভরতনাট্যমে মহীয়সী হয়ে উঠলেন আমার গুরু, আমার আক্কা ‘শ্রীমতী লীলা স্যামসন’।

নাচ শিখতে গিয়ে দেখেছি, ‘আক্কা’কে সবাই ভীষণ ভালোবাসতেন। তার নাচের অনুরাগী ছিলেন অনেকেই। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান- সব বিখ্যাত ক্ষেত্রগুলোতেই তার নাচের পরিবেশনা থাকত নিয়মিতই। ১৯৯০ সালে তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন।

গুরুর সাথে আমার অনেক গভীর একটা যোগসূত্র রয়েছে। উনি আমাকে ‘বাবা’ বলে ডাকেন। সবসময় বলেন আমি তার বাংলাদেশি বাবা। আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করেন। তার কাছ থেকে আমার এত বেশি প্রাপ্তি, যার বিন্দুমাত্র প্রতিদান দেওয়া আমার পক্ষে এই জীবনে অসম্ভব। তার চেষ্টা আমি করবও না। আমার মধ্যে তার যে স্থানটা আছে, আমি চাই সবসময় তাকে সেভাবেই রাখতে।

আজ এই মহীয়সীর জন্মদিনে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যগুরু

সারাবাংলা/এএসজি

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন