বিজ্ঞাপন

কোটা সংস্কার আন্দোলন: কিছু অনুধাবণ

April 18, 2018 | 10:55 am

একটা করে বড় ঘটনা, বড় আন্দোলন, বড় পরিবর্তন বা বড় দুর্ঘটনা ঘটে, আর আমরা একটু একটু করে নিজেকে চিনি, নতুন করে বুঝতে পারি। এরকম বড় পরিস্থিতি সামাল দেয়া আমাদের জন্য কঠিন হলেও প্রায়ই আমরা সামাল দিয়ে ফেলি। কিন্তু এই সামলাতে গিয়ে কত কী যে চোখের সামনে পরিস্কার হয়ে যায়, তা সত্যিই অকল্পনীয়।

বিজ্ঞাপন

যেমন সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা দেখলাম তুমুল ছাত্র আন্দোলনের ফাঁক গলে ঢুকে গেছে নানা প্রতিক্রিয়াশীল ও ধান্ধাবাজ চক্র। তাদের চোখ ছিল তুমুল ছাত্র আন্দোলনের ঘাড়ে পা রেখে নিজেদের নোংরা স্বার্থ চরিতার্থ করা। যেসব বিষয়ের প্রতি সেইসব চক্রের রোষ ছিল, তারা সেইসব ইস্যুকেই বেছে নিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঠিক না ভুল, উচিৎ কি উচিৎ না, আমি সে প্রসঙ্গে এখানে কথা বলতে চাইনা। কারণ ইতোমধ্যে এই বিষয়ে বহু আলোচনা হয়ে গেছে।

আন্দোলন ছিল অস্বাভাবিক হারে, অর্থাৎ ৫৬ ভাগ, কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে। আর এই কোটার একটা বড় অংশ পেয়ে আসছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার। তাদের ছেলেমেয়ে থেকে নাতি-নাতনি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অতীতে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে সত্যিই কি মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার এই সুযোগ পাচ্ছেন? নাকি কেউ কেউ মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এই সুযোগ গ্রহণ করছে? মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪৮ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য এতটা কোটার বিধান রাখাটা ঠিক হচ্ছে কিনা? এই দিকটি নিয়ে বহুবার কথা হলেও সরকার একবারও কর্ণপাত করেনি। আর করেনি বলেই আজকে আমরা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি।

এই আন্দোলনকালে আমরা দেখলাম এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ যাঁরা, অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যক্ষ বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছেন। যা নয়, তাই বলে তাঁদের বিরোধিতা করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবাই যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ শক্তি বা তাদের ভালবাসে, তা কিন্তু নয়। আর সেটাই প্রমাণিত হল মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী বিভিন্ন শ্লোগান ও মতামতের মাধ্যমে। কেন এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য এত কোটা থাকবে, তা আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই অনেক আজেবাজে মন্তব্য করেছেন।

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযোদ্ধাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ পেয়েছেন তারা। সরকার চাইলে অনেক আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য কোটা ব্যবস্থাটি যুক্তিযুক্ত করতে পারতো। এমনকী মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অনেকেই এই কোটা চায়নি এবং এর বিরোধিতা করেছে। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও অনেকে এই অনুপাত কমানোর পক্ষে ছিলেন।

আন্দোলনকারীদের এই দাবিকে আরো উস্কে দিলেন বা বলা যায়, আগুনে ঘি ঢাললেন সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী। তিনি বলে বসলেন, এই আন্দোলনকরীরা সবাই রাজাকারের বাচ্চা। ব্যস অমনি ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। শুধু ক্ষোভ নয়, এই বাংলার মাটিতে চরমভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত হওয়ার পথ খুলে দিলেন তিনি। ছেলেমেয়েরা অবলীলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে সাহস পেলোÑ ”হ্যা আমরা সবাই রাজাকার”।

ফেসবুক থেকে পাওয়া ছবি

বিজ্ঞাপন

লজ্জায়, ঘৃণায় নত হয়ে গেলাম। অনেকে নিজের শরীরে পোস্টার সাঁটিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানোর মত কাজটাও করল। ফেসবুকে যার যা খুশি মন্তব্য করতে থাকলো মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।

যেখানে শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অধিকতর আগ্রহী করে তুলতে চাইছি, ঠিক এরকম একটি সময়ে নীতিনির্ধারকদের ভুল সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনায় আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের এনে ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলাম। শুধু সরকারি চাকুরি পাওয়ার জন্য আমাদের তরুণ সমাজ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তিকে পদদলিত করতেও পিছপা হলনা। কোটা সংস্কারের আন্দোলন করতে গিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করালো। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে একদিকে সরকারের একগুঁয়েমি, অন্যদিকে সরকারি চাকুরি প্রার্থীদের ঔ্চিত্যবোধের অভাব মুক্তিযুদ্ধকেই অপমানিত করেছে।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, সরকারি চাকুরি প্রার্থী এইসব ’মেধাবি তরুণ-তরুণীদের’ কেউ কেউ নারী, প্রতিবন্ধী মানুষ ও আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নিয়েও ফাজলামো করতে ছাড়েনি। দেখেছি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র একটি পোস্টার হাতে নিয়ে দাঁড়ানো, তাতে লেখা, “মুক্তিযোদ্ধার নাতী বিয়ে করলো একজন উপজাতি’। অতঃপর তাদের সন্তান হলো ’প্রতিবন্ধী’। একটি কোটা-সমৃদ্ধ সুখী পরিবার”।

এরকম নোংরা অর্থসহ একটি পোস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হাতে নিতে পারে, তা ভাবতেও পারছি না।

বিজ্ঞাপন

এই কি আমাদের শিক্ষার মান? আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এই মানসিকতার একজনও যদি ’মেধাবী’ হিসেবে নিজেকে মনে করে এবং চাকুরি পেয়ে সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়, তাহলে বুঝতে হবে জাতির কপালে দুঃখ আছে ।

আমাদের জানা মতে, প্রতিবন্ধীদের জন্য শতকরা ১ ভাগ কোটা বরাদ্দ থাকার পরও প্রতিবন্ধী অনেকেই এই সুযোগ পান না। প্রতিবন্ধী ছাড়াও দলিত, হরিজন, আদিবাসী এবং অন্যকোন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য।

এইসব মানুষতো সমাজের প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত এগুতেই পারেনা। এরা সমাজের প্রান্তিক মানুষ। সাধারণ স্কুল-কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করাটাও তাদের জন্য কঠিন। আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবেশ, আমাদের রাষ্ট্র এবং আমরা কেউ তাদের প্রান্তিকতাকে অনুধাবণও করতে পারবোনা। বুঝিও না, বুঝতে চাইও না বিসিএস এর কোটার দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে তাদের কতটা চড়াই উৎরাই পার হতে হয়। সেখানে তাদের জন্য বরাদ্দ নির্ধারিত কোটা নিয়ে যখন ’মেধাবি ছেলেমেয়েরা’ আন্দোলন করে, নোংরা কথা বলে তখন সত্যিই বিচলিত না হয়ে পারিনা। আমরা বুঝলাম আজকের ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ আন্দোলন করতে নেমে নূন্যতম সৌজন্যর ধারও ধারেন না ।

এই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন আন্দোলন চলাকালে উপাচার্যের বাসা এভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছে। দেশের ইতিহাসেও এরকম ন্যক্কারজনক হামলা প্রথম। ভিসি কোন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। যেকোন আন্দোলনেই আমরা দেখেছি ছাত্রছাত্রীরা ভিসি’র ভবন বা কার্য্যালয় ঘেরাও করে, মিছিল করে, শ্লোগান দেয়, স্মারকলিপি পেশ করে। কিন্তু এভাবে মুখে কাপড় বেঁধে ভিসি’র বাড়ি তছনছ করা এই প্রথম। শুধু তছনছ বললেও কম বলা হবে, রীতিমত গুন্ডামি করেছে। কারা এই জঘন্য কাজ করেছে তা এখনও জানা যায়নি। তবে আন্দোলনকারী ছাত্ররা এরকম একটি সন্ত্রাসী কাজ করবেনা, আমরা এটাই বিশ্বাস করতে চাই।

তাহলে কারা এই কাজ করলো, কেন করলো, তা কি জানা যাবে কোনদিন? এর দায় হয়তো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উপর চাপিয়ে দেবে। নতুবা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের উপর। কিন্তু আমরা অবাক হলাম এত কাছে পুলিশ বাহিনী থাকা সত্ত্বেও কেন ভিসির বাড়ি রক্ষা করতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। এতগুলো ষ-াপা-া যদি ভিসির বাসভবনে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে ছাত্রী হলে ঢোকাটাইবা কী এমন কঠিন হবে, তাদের জন্য। ভবিষ্যতে এধরণের অনাকাংখিত ঘটনা ঘটার আশংকা থেকেই যায়।

ঘটনার পরদিন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছিল ভিসি’র তছনছকৃত বাসভবন। সাধারণত অকুস্থলকে প্রটেকটেড রাখা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে উল্টো। দিনভর মানুষজন গেছে, ছবি তুলেছে, ভিডিও করেছে, সেলফি তুলেছে। কিন্তু কেন? কী দেখানোর জন্য সবকিছু উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছিল? এ প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।

আমরা সাধারণ মানুষ সবসময়ই খুব বিস্ময়ের সাথে একটি ঘটনা লক্ষ্য করি এবং নিজের মত করে হিসাব দাঁড় করাই। এই সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই করেছি। যেকোন ঘটনা, দুর্ঘটনা, আন্দোলন, অর্জন, ব্যর্থতা, জন্ম বা মৃত্যু সবকিছু নিয়ে আমরা জাতিগতভাবে ২/৩ দলে ভাগ হয়ে যাই। যে যার মত যুক্তি সাজাই। এমনকী আমাদের গণমাধ্যমগুলো পর্যন্ত এক থাকেনা। তারা তাদের নিজেদের মত করে সংবাদ প্রচার করে, মতামত দেয়, আলোচনা উপস্থাপন করে। গণমাধ্যম একদিকে জনমত তৈরি করে, আবার অন্যদিকে মতামত প্রকাশও করে। কাজেই কোন কোন গণমাধ্যম যখন নিজেদের মত করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে, তখন পাঠক, দর্শক-শ্রোতা হিসেবে আমরা বিপদে পড়ে যাই। আর এরসাথে আছে বিভিন্ন পরিচয়হীন অনলাইন প্রচারমাধ্যম, একপাতার পত্রিকা এবং ফেসবুক। মিথ্যা ও অর্ধসত্য তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করাতে এদের জুড়ি মেলা ভার।

শেষ পর্যায়ে এসে সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা আমাদের থমকে দিয়েছে, ভয় পাইয়ে দিয়েছে। ঐ রাতে যেভাবে হলটিকে ঘিরে হৈ চৈ শুরু হয়েছিল, তাতে যেকোন ধরণের বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশংকা ছিল। প্রশ্নটা ছিল হলে অবস্থানরত সাধারণ ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে। আমার পরিচিত একটি পরিবারের মেয়ে ঐ হলের আবাসিক ছাত্রী। ওর বাবা মা যখন ময়মনসিংহ থেকে টিভিতে ঐ অস্থিরতার ছবি দেখল ও খবর শুনলো, তাদের হার্ট এ্যাটাক হওয়ার অবস্থা হয়েছিল, মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে। হলের একজন হাউস টিউটরও বললেন, তার হাত পা সব অবশ হয়ে যাচ্ছিল, মেয়েদের কথা ভেবে। যদি গেট ভেঙে মুখ বাঁধা লোকজন ঢুকে পড়ে, তখন কীভাবে তারা সামাল দেবেন পরিস্থিতি?

এখানে ছাত্রলীগ নেত্রী এশার গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনাও ঘটেছিল একটি ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে। এই ঘটনাও আমাদের জন্য অনভিপ্রেত। যেকোন অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি বরাদ্দ করা আছে। জুতার মালা পরিয়ে এশার অতীত আচরণের প্রতি তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে সেই হলে থাকা ছাত্রীদের একটি অংশ। কিন্ত এরপরও কথা থেকে যায় আন্দোলন, ক্ষোভ, আনন্দ-উল্লাস পালনকালে সীমা থাকাটা জরুরি। তা না হলে ভয়াবহরকমের সব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে পারে এবং ঘটে।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: কোঅর্ডিনেটর, মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন