বিজ্ঞাপন

মাত্রাতিরিক্ত লবণে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ, বাড়াচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি

May 27, 2022 | 10:16 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর উত্তরায় বসবাস করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৬ বছর বয়সী রাজীব চৌধুরী। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে হঠাৎ করেই শারীরিক অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায় তার রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে অনেক বেশি। আর এজন্য তার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বিজ্ঞাপন

মহাখালীতে বাস করা মাহফুজ আলম ২০২২ সালে বুকে ব্যথা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া মাহফুজ আলমের রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে অনেক বেশি। আগে থেকেই উপসর্গ দেখা গেলেও রক্তচাপ পরীক্ষা না করানোর কারণে এ বিষয়ে কিছু জানতে পারেন নি তিনি।

চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উভয় ক্ষেত্রেই রোগীর খাদ্যাভাস বিষয়ে জানিয়েছে পারিবারিকভাবে ছোট বেলা থেকে ভাতের সঙ্গে অতিরিক্ত লবন খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে তাদের। এক্ষেত্রে তাদের উচ্চ রক্তচাপ থাকার একটা কারণ হতে পারে এটা। বর্তমানে দেশে যে ভাবে অসংক্রামক রোগের সংখ্যা বাড়ছে তাতে একটা অন্যতম কারণ দেখা যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ জানে না তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। আর এই উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে শরীরে ঢোকা মাত্রাতিরিক্ত লবণ। শুধুমাত্র ঘরের খাওয়াতেই নয়, বাইরের বিভিন্ন ধরণের খাবার থেকেও মানুষের শরীরে ঢুকছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কারণে মানুষের মাঝে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি। আর এই উচ্চ রক্তচাপের কারণে মানুষের মাঝে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকিও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত লবণ খাওয়া কমানোর পাশাপাশি খাদ্যাভাস ও জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন জরুরি। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এমন অবস্থায় দেশে গণসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের প্রাথমিক পর্যায়ে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উচ্চ রক্তচাপ কী?

বিজ্ঞাপন

রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায় তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপের পরিমাপ ১২০/৮০ মি.মি. পারদচাপ ধরা হয়ে থাকে। তবে রক্তচাপের এই মাত্রা দুইটি ভিন্ন দিনে ১৪০/৯০ মি.মি. পারদচাপ বা তার চাইতে বেশি হলে বুঝতে হবে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে।

তবে বয়স নির্বিশেষে রক্তচাপ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে ১৩০/৮০ মি.মি. পারদচাপ এর অধিক হলে তা উচ্চ রক্তচাপের পর্যায়ে পড়তে পারে।

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ সময় উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না। অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপে ভোগা অনেক রোগী জানেই না যে তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এ জন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপিন্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জন অনুভূতির মতো নানা রকমের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

অত্যাধিক উচ্চ রক্তচাপ ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, বুকে ব্যথা এবং পেশী কম্পনের কারণ হতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তের উপায় কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তের একমাত্র উপায় হলো চিকিৎসক বা পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা রক্তচাপ পরিমাপ করা। দ্রুত স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আসতে পারলে উচ্চ রক্তচাপের কারণে ঘটা নানা রকমের রোগের সংক্রমণ থেকে ব্যক্তি নিজেকে রক্ষা করতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে, এটি ধমনি এবং মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এমনকি ধমনি শক্ত হয়ে হৃৎপিন্ডে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। ফলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি বিকলও হয়ে যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

উচ্চ রক্তচাপ কেন দেখা দিতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়ার কারণে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। এছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে ৬৫ বছর বয়সের পরে উচ্চ রক্তচাপ বাড়তে পারে। একইসঙ্গে ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে যেমন, শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া। এছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (৬৫ বছরের পরে) এবং ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের বর্তমান পরিস্থিতি কী?

‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে, ৩৫ বছর ও এর বেশি বয়সী নাগরিকদের মাঝে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ সময়ে দেখা গেছে পুরুষদের মাঝে উচ্চরক্তচাপের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে নারীদের ক্ষেত্রে ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ বেড়েছে উচ্চ রক্তচাপের রোগী।

২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন নারীদের ৪৯ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে গবেষণায়। তবে এই সময়ে স্বাভাবিক ওজনের নারীদের ২৫ শতাংশের মাঝে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন পুরুষদের ৪২ শতাংশের মাঝে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক ওজনের পুরুষের মাঝে এই হার ২৪ শতাংশ।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের নারীদের অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ প্রায় ৫১ শতাংশ নারী জানেনই না যে তারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।

একইভাবে প্রায় ৬৭ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ জানেন না তাদের উচ্চ রক্তচাপে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য।

গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ৬৪ শতাংশ রোগী কোনো ওষুধ সেবন করে না।

‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০১৮’ অনুযায়ী ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের মাঝে ২১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এর মাঝে নারীদের মাঝে ২৪.১ শতাংশ, ১৭.৯ শতাংশ পুরুষ বর্তমানে উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন। এর মাঝে বর্তমানে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ গ্রহণ করছেন মাত্র ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদের প্রতি সাত জনের মাঝে একজন ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।

গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের অন্যতম একটি উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশে বছরে দুই লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায়। যার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ লাখের বেশি মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন, যার প্রায় অর্ধেক হৃদরোগজনিত।

লবণ কীভাবে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ানোর নিয়ামক?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন একজন মানুষের ৫ গ্রাম অর্থাৎ এক চা চামচ লবণ খাওয়া দরকার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে কয়েকগুণ বেশি খাওয়া হয়ে থাকে অনেকের। এক্ষেত্রে শুধু ভাত তরকারিতে নিজ নিজ বাড়িতে মাত্রাতিরিক্ত নয় বরং অনেকেই না জেনে বাইরের যে খাওয়া গ্রহণ করছে তার মাধ্যমেও শরীরে প্রবেশ করছেন মাত্রাতিরিক্ত লবণ।

আর এই মাত্রাতিরিক্ত লবণ খাওয়াকে উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধুমাত্র অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বন্ধ করতে পারলে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ কমবে বলে ধারণা তাদের। পাশাপাশি খাদ্যাভাস ও জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তনের উপর জোর দিচ্ছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা। উচ্চরক্তচাপ থাকা ৫০ শতাংশের বেশিই জানেন না তারা এই রোগে আক্রান্ত। শুধুমাত্র উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যায়, যা সকল সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ জনের মাঝে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। উচ্চ রক্তচাপের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। দেশে এ বিষয়ে গণসচেতনতা এবং চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বন্ধ করতে পারলে ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যেতো। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন অর্থাৎ এক চামচ। কিন্তু দেখা যায় তার বেশি খাচ্ছেন অনেকে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দেশে অধিকাংশ মানুষ ১০ থেকে ১৫ গ্রামের বেশি লবণ খাচ্ছে।

তিনি বলেন, অনেকে জেনে লবণ খাচ্ছেন আবার না জেনেও খাচ্ছেন। ঘরে যিনি খাচ্ছেন তিনি হয়তবা জেনেই সেটা গ্রহণ করছেন। কিন্তু ঘরের বাইরে যে খাবার খাচ্ছেন, তাতে কি পরিমাণ লবণ আছে, তা অনেকে না জেনেই খাচ্ছেন। যেমন অনেকেই জানেন না যে চিপসে চিপসে ১০ গ্রাম লবণ থাকে। ঘরের বাইরে সিঙ্গারা, সমুছা বা হোটেলের বিভিন্ন ধরণের খাওয়ার মাঝে কী পরিমাণ লবণ আছে তা অনেকেই না জেনে খাচ্ছেন। ফলে তাদের শরীরে ঢুকছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঁচ গ্রামের বেশি লবণ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের হাইপারটেনশন কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (জাতীয় কর্মসূচির) ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চের রিসার্চ ফেলো ডা. শামীম জুবায়ের।

লবণ খাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকার কথাও বলেন ডা. শামীম জুবায়ের।

তিনি বলেন, ‘লবণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান যেটা এককভাবে উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। একজন সুস্থ মানুষ কাঁচা লবণ বা রান্নায় ব্যবহৃত লবণসহ সারা দিনে ৫ গ্রাম লবণ খেতে পারবে। অথচ দেশের মানুষ দিনে প্রায় ৯-১০ গ্রাম লবণ খায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাপান, ফিনল্যান্ডসহ যেসব দেশে লবণের সমস্যা ছিল, সেসব দেশে লবণ খাওয়াকে দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে স্ট্রোক ১০ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।’

ডা. শামীম বলেন, ‘১৮ বছর বা এর বেশি বয়সী মানুষকে অবশ্যই রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে। যদি রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে তবে আবার ছয় মাস পরে মাপতে হবে। আর যদি রক্তচাপের রোগী হিসেবে চিহ্নিত হন, তাহলে অবশ্যই নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। ওষুধ নিয়মিত খেলে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হবে না।’

তিনি বলেন, ‘শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ যেহেতু শরীর হার্ট পাম্প করে, অতিরিক্ত ওজন হলে হার্ট সঠিকভাবে পাম্প করতে পারে না। এর ফলে রক্ত গোটা শরীরে প্রবাহিত হতে পারে না। তেল-চর্বি জাতীয় খাবার, অর্থাৎ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে বা যার সঙ্গে সরাসরি ফ্যাটি এসিডের সম্পর্ক, সে জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। কারণ এসব খাদ্যের কারণে রক্তনালি ব্লক হয়ে যেতে পারে।’

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের রোগী শনাক্তে প্রথমে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আর যাদের নেই, কী ধরনের জীবনাচার করলে এটি থেকে রেহাই মিলবে, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর কী বলছে?

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে নানা ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।

তিনি বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের অর্জন বেশ ভালো। দুই বছরের মাঝে আমরা লাখখানেকের বেশি রোগীর নিবন্ধন করাতে পেরেছি। আমাদের লক্ষ্য ৪২২টি উপজেলা। তবে এখন পর্যন্ত আমরা অর্ধেক উপজেলা কাভার দিতে পেরেছি। আগামী বছরের মাঝে যদি আমরা ২০০ উপজেলা কাভার দিতে পারি, তাহলে বলতে পারব সবখানে পৌঁছানো গেছে। আর তাই আমাদের লক্ষ্য ২০২৩ সাল। এছাড়া আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিসের কারণে ৩০-৭০ বছর বয়সী যে ২২ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সেই মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘সরকার উপজেলাগুলোতে এনসিডি কর্নারের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের তিনটি ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে, ডায়াগনসিস করার জন্য ও রক্তচাপ মাপার জন্য যন্ত্রপাতি দিচ্ছে। বর্তমানে ২০০ উপজেলায় এনসিডি ম্যানেজমেন্টসহ ওষুধ সরবরাহ করছি। এর মধ্যে ৮০ উপজেলায় ডিজিটালাইজেশনভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘৫৪ উপজেলা থেকে ইতোমধ্যে তথ্য পাচ্ছি। এসব উপজেলায় ৮৯ হাজার রোগীর রেজিস্ট্রেশন আছে। বাকি উপজেলাগুলোতে ধাপে ধাপে করে ফেলব। আগামী বছর অনুদান পেলে এনসিডি কর্নার করে সারা বাংলাদেশ কাভার দিতে পারব। আশা করছি এ বছর ২৫০ উপজেলা ডিজিটালাইজেশন করতে পারব।’

সারাবাংলা/এসবি/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন