বিজ্ঞাপন

লকডাউনেও ‘অস্বাস্থ্যকর’ ঢাকার বায়ু, গবেষণা

May 29, 2022 | 9:28 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: এক বছরের বায়ুর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সূচক অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার ১০টি পয়েন্টের বায়ুমান অবস্থা ‘অস্বাস্থ্যকর’ পেয়েছে ওয়াটারকিপার্স কনসোর্টিয়াম। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে মার্চ ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৭৭ দিন লকডাউন চলছিল দেশে। লকডাউনের সেই দিনগুলোতেও এসব পয়েন্টের বায়ুমান ‘অস্বাস্থ্যকর’ পাওয়া গেছে এই কনসোর্টিয়ামের সমীক্ষায়।

বিজ্ঞাপন

ঢাকার যে ১০টি পয়েন্টে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে সেগুলো হলো— আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, শাহবাগ, ধানমন্ডি ৩২, সংসদ ভবন এলাকা, তেঁজগাও, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২।

গবেষণার তথ্য বলছে, সমীক্ষা চলাকালে ওই ১০টি পয়েন্টে বাতাসে বস্তুকণা ২.৫-এর গড় বার্ষিক উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ৭৭ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে, যা বার্ষিক আদর্শমান ১৫ মাইক্রোগ্রামের তুলনায় গড়ে প্রায় ৫ দশমিক ১ গুণ বেশি। এছাড়া একই সময়ে পয়েন্টগুলোতে বস্তুকণা ১০-এর গড় বার্ষিক উপস্থিতি পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ১০৫ মাইক্রোগ্রাম, যা বার্ষিক আদর্শমান ৫০ মাইক্রোগ্রামের দ্বিগুণেরও বেশি।

রোববার (২৯ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরার পাশাপাশি ঢাকা শহরে বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত প্রশমন ব্যবস্থা ও আইনের কার্যকর প্রয়োগের দাবি তুলে ধরা হয়।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ শাহবাগে, শব্দদূষণে শীর্ষে গুলশান-২

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা পদ্ধতি তুলে ধরে বলা হয়, সমীক্ষার সময় রাজধানীর এই ১০টি পয়েন্টে বসানো হয় বিশেষ যন্ত্র, যেগুলো বাতাসের দূষণের পাশাপাশি শব্দদূষণ পরিমাপে সক্ষম। প্রতিটি যন্ত্র আশপাশের ১৫ থেকে ২০ গজ বা ৪০ থেকে ৫০ ফুট এলাকার বায়ু ও শব্দের মান পরিমাপ করতে সক্ষম। প্রতিটি পয়েন্টের মাঝামাঝি অবস্থানে যন্ত্রগুলো বসিয়ে সংগ্রহ করা উপাত্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ওই ১০টি স্থানের মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ পাওয়া গেছে শাহবাগে। সেখানে বস্তুকণা ২.৫-এর গড় বার্ষিক উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটার ৮৫ মাইক্রোগ্রাম, যা আদর্শমান ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে ৫ দশমিক ৬ গুণ বেশি। আর সর্বনিম্ন বায়ুদূষণ পাওয়া গেছে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায়। সেখানে বস্তুকণা ২.৫-এর গড় বার্ষিক উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটার ৭০ মাইক্রোগ্রাম, এটিও আদর্শমান থেকে ৪ দশমিক ৬ গুণ বেশি।

বিজ্ঞাপন

প্রাপ্ত তথ্যের ঋতুভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বস্তুকণা ২.৫ ও বস্তুকণা ১০— উভয় ক্ষেত্রেই শীতকালে দূষণের মাত্রা বেশি। এই মৌসুমে বস্তুকণা ২.৫-এর পরিমাণ পাওয়া গেছে গড়ে ১২৭ মাইক্রোগ্রাম (আদর্শমানের চেয়ে ৮ দশমিক ৪ গুণ বেশি) এবং বস্তুকণা ১০-এর পরিমাণ পাওয়া গেছে গড়ে ১৬২ মাইক্রোগ্রাম (আদর্শমানের চেয়ে ৩ দশমিক ২ গুণ বেশি)। বায়ু দূষণের তীব্রতায় এর পরের অবস্থানে ছিল যথাক্রমে প্রাক-বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়। আর বায়ুমান সবচেয়ে ভালো পাওয়া গেছে বর্ষা মৌসুমে। এই ঋতুতে দূষণ তুলনামূলকভাবে কম হলেও বস্তুকণা ২.৫-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে আদর্শমানের চেয়ে ২ দশমিক ৬ গুণ বেশি (৩৯ মাইক্রোগ্রাম) এবং বস্তুকণা ১০-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে আদর্শমানের চেয়ে ১ দশমিক ২ গুণ বেশি (৬২ মাইক্রোগ্রাম)।

এদিকে, শব্দদূষণ গবেষণার ফল বলছে— ঢাকা শহরের ১০টি জরিপ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩২ ডেসিবল শব্দ রেকর্ড হয়েছিল গুলশান-২ পয়েন্টে এবং সর্বনিম্ন ৩১ দশমিক ৭ ডেসিবেল শব্দ রেকর্ড হয়েছে জাতীয় সংসদ পয়েন্টে। শব্দদূষণে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল আব্দুল্লাহপুর। এখানে শব্দের পরিমাপ ৯৫ দশমিক ৪৩ ডেসিবল, যা মিশ্র এলাকার আদর্শমানের চেয়ে ১ দশমিক ৬ গুণ বেশি। অন্যদিকে তেজগাঁও এলাকায় সর্বনিম্ন Leq মান ছিল ৮৯ ডেসিবল, এটিও শিল্প এলাকার জন্য দিনের বেলায় জাতীয় আদর্শমানের (৭৫ ডেসিবেল) থেকে ১ দশমিক ১ গুণ বেশি।

গবেষণার তথ্য বলছে, সব এলাকায় উপাত্ত সংগ্রহের মোট সময়ের ১০ শতাংশ সময় গড়ে ৮৩ দশমিক ৬২ ডেসিবলের চেয়ে বেশি শব্দ পাওয়া গেছে, যেখানে অর্ধেক সময়েই শব্দের মাত্রা ছিল ৭০ দশমিক ২ ডেসিবলের চেয়ে বেশি। আর ৯০ শতাংশ সময় শব্দের মাত্রা গড়ে ৫৬ দশমিক ২৩ ডেসিবলের বেশি পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

১০টি স্থানের প্রাপ্ত উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নীরব এলাকায় ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ সময় শব্দের মাত্রা আদর্শমান (৫০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, আবাসিক এলাকায় ৯১ দশমিক ২ শতাংশ সময় আদর্শমান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, মিশ্র এলাকায় ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ সময় আদর্শমান (৬০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬১ শতাংশ সময় আদর্শমান (৭০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় ১৮ দশমিক ২ শতাংশ সময় আদর্শমান (৭৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে। গোট ঢাকা শহরেকে মিশ্র এলাকার সঙ্গে তুলনা করলে ১০টি স্থানেই ৮২ শতাংশ সময় ৬০ ডেসিবলের ওপরে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে।

সংবাদ সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ঢাকা শহরের শাহবাগ এলাকায় বায়ু সবচেয়ে বেশি দূষিত। সেখানে বস্তুকণা২.৫-এর গড় বার্ষিক পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৫ মাইক্রোগ্রাম, যা আদর্শমান থেকে ৫ দশমিক ৬ গুণ বেশি। আর শব্দমান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গুলশান-২ পয়েন্টে শব্দের মান সর্বোচ্চ, যেখানে Leq বা ধারাবাহিকভাবে যে মাত্রায় (সমতুল্য) শব্দ মান ছিল ৯৫ দশমিক ৪৪ ডেসিবল, যা আবাসিক এলাকার জন্য দিনের বেলার আদর্শমান (৫৫ ডেসিবল) থেকে ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি।

ইউএসএআইডির অর্থায়নে এবং কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সহায়তা দূষণবিরোধী অ্যাডভোকেসি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রকে (ক্যাপস) সঙ্গে নিয়ে ‘ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম’ গঠন করেছে। এই দূষণবিরোধী অ্যাডভোকেসি কর্মসূচি ঢাকা শহরের বায়ু এবং শব্দ দূষণ পরিমাপসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি দূষণের অবস্থাও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করছে।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিলের সভাপতিত্বে এই আয়োজনে স্বাগত বক্তব্য দেন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. কামরুজ্জামান। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম, ইউএসএআইডি’র সিভিল সোসাইটি অ্যাডভাইজার সুমনা মাসুদ, কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি মাইনুদ্দিন আহমেদ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আলী নকী, বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাসমী, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের এক্সিকিউটিভ কোঅর্ডিনেটর সোহানুর রহমানসহ অন্যরা। এছাড়াও বুড়িগঙ্গা, বালু ও তুরাগ নদী তীরবর্তী এলাকার কমিউনিটি নেতারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলন থেকে বায়ু ও শব্দদূষণ প্রতিরোধে সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো—

১. গবেষণায় প্রাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ চলমান নির্মাণ প্রকল্প। তাই সব নির্মাণ প্রকল্পে নির্মাণবিধি মেনে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করতে হবে;

২. বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্ট দফায় দফায় নির্দেশনা দিলেও বাস্তবে হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা হয় না। হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তুবায়ন নিশ্চিত করে নির্দেশনা অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। খসড়া নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ আরও সুস্পষ্ট করে চূড়ান্ত করে তা যত দ্রুতসম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে;

৩. শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত অঞ্চলগুলোতে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইন পোস্ট উপস্থাপন করে জনসাধরণকে সচেতন করতে হবে এবং এগুলো অনুসরণের বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে;

৪. শব্দের উপাত্ত বিশ্লেষণে গাড়ির তীব্র হর্নের অনেকগুলো পিক (উচ্চ শব্দ) লক্ষণীয় ছিল। তাই সাধারণ জনগণের কাছে দাবি, তারা যেন প্রয়োজন ছাড়া হর্ন না বাজান। বিশেষ করে নীরব এলাকায় অযথা হর্ন বাজানো যাবে না। সন্ধ্যার পর উচ্চস্বরে গান বাজানো, নির্মাণ কাজ, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে;

৫. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে এবং নিয়মিত শব্দমান পর্যবেক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতায় আনতে হবে। এছাড়াও বায়ুদূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে এবং পরিবেশ বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ দিতে হবে;

৬. জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, আইনপ্রণেতা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সংবাদকর্মী ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অবিলম্বে সমন্বিত, অংশীদারিত্বমূলক, বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে; এবং

৭. প্রয়োজনে নীরব এলাকা চিহ্নিত করার জন্য রাস্তায় বিভিন্ন রঙের পিচ ঢালাই দেওয়া যেতে পারে, যেন সেটি দেখেই চালকরা বুঝতে পারেন যে এখানে হর্ন বাজানো যাবে না।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন