বিজ্ঞাপন

সেলফির বিশ্ব জয়, কিভাবে?

April 20, 2018 | 12:33 pm

।।আড়চোখে ডেস্ক।।

বিজ্ঞাপন

আচ্ছা যদি এমন হয় মোনালিসার হাতে একটি সেলফোন, রহস্যময়ী হাসি দিয়ে তিনি মূলত সেলফি তুলছিলেন। কিংবা যদি হয় কিং ডেভিডের হাতে সেলফোনে সেলফি তোলার প্রয়াস… অথবা এমনওতো হতে পারে সেই ১৯০৩ এ অস্ট্রীয় চিত্রশিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা নেকলেস কন্যা অ্যাডেলে ব্লচ বোয়ারের হাতে একটি স্মার্টফোনও ছিলো, আর তিনি তা দিয়ে একটি সেলফিই তুলছিলেন। তাহলে কিন্তু বলতেই হবে… সেলফি কোনও হালের ট্রেন্ড নয়। অন্তত শত বছরের পুরোনো।

২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর প্যারিস হিলটন তার একটি টুইটে সঙ্গীত জগতের হার্টথ্রব ব্রিটনি স্পেয়ার্সের সাথে তার দুটি ছবি তুলে দিয়ে দাবি করেছিলেন, ২০০৬ সালে তার নিজের তোলা ওই ছবি দুটি ছিলো বিশ্বের প্রথম সেলফি। আসুন দেখা যাক তার সে দাবিটিও কতটা ধোপে টেকে!

তবে সবার আগে বলে নিতে চাই- সেলফি যে আশ বিশ্ব জয় করে নিয়েছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। একা একা ঘুরছেন প্রকৃতিকে ভালো লেগে গেলো… একটি সেলফি তুলে ফেললেন।

বন্ধু সাথে আছেন… কিংবা প্রিয় মানুষটির সাথে… সেলফি তুলে ফেললেন গোটা চারে ফটাফট।

বিজ্ঞাপন

বন্ধুদের আড্ডা চলছে… শেষ করে হয়ে যাক সেলফি একটা। সাইবার জগতে রয়েছেন আর একটি সেলফি নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়ার জো বুঝি আর বিশ্বে নেই।

তো সেলফি কিভাবে বিশ্ব জয় করলো? সে নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।

২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারির কথা। তখন এই আইফোনও ছিলো না, ছিলো না ইন্সটাগ্রামও। তখন একদিন মাইস্পেস.কম এ একটি লেখা এলো- হিয়ার আই অ্যাম টেকিং মাই ওন পিকচার শিরোনামে। পোস্টটি ছিলো মর্গান অ্যাডামস নামের এক কলেজ ছাত্রীর। নিউইয়র্ক টাইমস তখন ওই শিরোনাম দিয়েই একটি খবর দিলো। তাতে বললে- মরগান অ্যাডামস তার মাইস্পেস.কম’র হোমপেজে একটি ছবি তুলেছেন, যাতে তার মুখোমণ্ডলটি বেশ বড় হয়ে ধরা পড়েছে ক্যামেরার লেন্সে। আর ক্যাপশনে বলেছেন, নিজের ছবিটি তোলার জন্য তার কাছে নিজেকেই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। নিজ শয়নকক্ষে ২১ বছরের এই ছাত্রী মুখের নানা ভঙ্গিমায় ছবিগুলো তুলেছেন- আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তরুণরা ঠিক যেমনটি করে অভ্যস্ত। তবে মিজ অ্যাডামের সামনে ছিলো একটি ওয়েব ক্যাম। আর তার অঙ্গভঙ্গির পাঁচটি ছবি নিজে নিজে তুলে নেওয়া ডিজিটাল প্রোট্রেট হিসেবে মাইস্পেসে জায়গা পেলো। খুব দ্রুত সে ছবি মাইস্পেসের অন্তত ৫ কোটি ৬০ লাখ ব্যবহারকারীর সামনে চলে এলো।

সে ছবিগুলোকে যদি সেলফি বলা হয়, তাহলে ব্রিটনি স্পিয়ার্সের সঙ্গে প্যারিস হিলটনের ছবিগুলোকে কোনওভাবেই প্রথম সেলফি বলা যাবে না। আর তিনিই যে সেলফির আবিষ্কারক সে দাবিটিও মিথ্যা হয়ে যাবে। কারণ ব্রিটনি ও প্যারিস যেদিন ছবিটি তুলেছিলেন তার অন্তত ৯ মাস আগেই তোলা হয়েছিলো মরগান অ্যাডামসের ছবিটি। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের অ্যালেক্স উইলিয়ামের- হিয়ার আই অ্যাম টেকিং মাই ওন পিকচার শিরোনামের সেই লেখাটি যে নিজের ছবি নিজে তোলা নিয়ে প্রথম একটি জার্নালিস্টিক কাজ সে ব্যাপারে সন্দেহমাত্র নেই। সে লেখায় তিনি এধরনের ছবিকে সেলফি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। আর সে কারণে ট্রেন্ড রিপোর্টারদের জন্য সে বছরে হল অব ফেমও জিতেছিলেন এই সাংবাদিক।

বিজ্ঞাপন

তবে সেলফি শব্দটি ব্যবহারের ক্রেডিটটি কিন্তু অ্যালেক্স উইলিয়ামেরও নয়। সেটি পাবেন একজন অস্ট্রেলীয়। এবিসি সায়েন্স অনলাইন ফোরামে তিনিই প্রথম সেলফি শব্দটি ব্যবহার করেন ২০০২ সালে। মদ্যপ হয়ে ভূপতিত হওয়ার পর নিজের রক্তাক্ত ঠোঁটের একটি ছবি তুলে তা পোস্ট দেওয়ার পর ক্যাপশানে লিখেছিলেন, এখানে ফোকাস করার জন্য দুঃখিত, তবে এটি একটি সেলফি। তখন এই শব্দটি নিয়ে কোনও কথা তেমন হয়নি। আর তার চার বছর পর দ্বিতীয়বার যখন অ্যালেক্স উইলিয়াম শব্দটি লিখলেন তখনও যে সে শব্দে হুলুস্থুল পড়ে গেলো তেমনটা নয়। সেটা পেতে সময় কেটে গেলে আরও অর্ধযুগ। সেটি ২০১২ সাল। সেবছর টাইম ম্যাগাজিন জানালো বছরের দশটি বাজ ওয়ার্ড’র মধ্যে সেলফি ছিলো একটি।

ইন্সটাগ্রামের এই পাগলা যুগে এসে ওয়েব ক্যামের ছবিকে প্রাচীন বলে নাক সিঁটকানো হয়তো যাবে কিন্তু সহস্রাব্দের প্রথম দশকের মাঝামাঝিতে ডিজিটাল ফটোগ্রাফি যখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন তা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একটা বড় ঘটনা। ফিল্ম ফটোগ্রাফির শতবছরের দাপট তখন শেষ হয়ে যায়। সাথে সাথে সস্তা ডিজিটাল পয়েন্ট-অ্যান্ড-শট ক্যামেরার উত্থান ঘটে। চলে আসে ওয়েবক্যাম সম্বলিত ল্যাপটপ, আর ক্যামেরা ফোন যখন এলো তখনই এসে পড়লো ক্যামেরা উল্টে দিয়ে নিজের ছবি নেওয়ার সুযোগ। মানুষ যখন যেখানে যেমন ইচ্ছা ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে পড়তে পারছে। যেমন ইচ্ছা ছবি তুলতে পারছে। যেনো সব কিছুই মুফতে পাওয়া গেলো। সহস্রাব্দের এই প্রজন্ম প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে সুযোগ পেলো তাদের জীবনকে অনলাইনে জীবন্ত (লাইভ অর্থে) তুলে ধরার।

তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়। এটা কি নতুন কিছু? ফটোগ্রাফি নিয়ে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন, তারা বলছেন, না নতুন নয়, এমনটা আগেও ছিলো। তারা বলছেন, নতুন এই যে নিজের ডিজিটাল ছবি তোলা, যাকে আমরা সেলফি বলছি তা ফটোগ্রাফির একটি নতুন ধরন মাত্র। আমেরিকানস ইন কোডাক্রোম, ১৯৪৫-৬৫ এর লেখক গাই স্ট্রাইকার্জ এমনটাই লিখেছেন।
মধ্যশতকের আমেরিকান পরিবারগুলো থেকে লক্ষাধিক ছবি সংগ্রহ করে তার ওপর ১৭ বছর ধরে গবেষণা করেছেন এই ইতিহাসবিদ। তার মধ্যে অন্তত ১০০টি ছবি তিনি পেয়েছেন যেগুলো নিজেই তোলা নিজের ছবি। স্ট্রাইকার্জ বলেন, ২০০৬ সালের আগেই এমন ছবির অন্তত কয়েক ডজন মাইস্পেসের পাতায় চলে আসে।

মাইস্পেস.কম এর কথা একটু বলে নেয়া যাক। ফেসবুক আসার আগে পর্যন্ত এটিই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যোশাল মিডিয়া। মাইস্পেস মাইফেস স্লোগান নিয়ে টিনেজারদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় এই প্ল্যাটফর্মটি বেশ সেনসেশন তৈরি করেছিলো। তখন ধারনা করা হচ্ছিলো তারুণ্যকে অনেকটা গ্রাস করে নিচ্ছে এই স্যোশাল মিডিয়াটি। আর ২০০৫ সালের এপ্রিলে তো পেজ ভিউতে তা গুগলকেও ছাড়িয়ে যায়। তখন প্রতিটি টিনেজার কিংবা ২০ বছরের বেশি বয়সি ছেলেমেয়েরা মাইস্পেস ব্যবহার করতো। এখনকার ফেসবুকের মতো প্রত্যেকেই একটি প্রফাইল ছবিও ব্যবহার করতো। তখন এতে অনেক সেলফিও ব্যবহার হতে দেখা গেছে। সে সবই ঘটেছে ২০০৫ সালের আগে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেলফি এখন নতুন ট্রেন্ড হতে পারে, কিন্তু তরুণ-তরুণীর মধ্যে বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে নিজের চেহারা নিজের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা সবকালেই ছিলো। টিনেজাররাতো নিজেকে নানারূপে দেখতে চায়, কিংবা দেখাতে চায়, আর তার কল্পিত দর্শকও সে নিজেই।

বিজ্ঞাপন

জেফরি জেনসেন আরনেট নামে একজন মনোবিজ্ঞানীর কথাই শুনুন। তিনি বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েরা অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে তাদের নিজেদের বিষয়েই আগ্রহী থাকে বেশি। আর তাদের কল্পিত দর্শকটি কিংবা কল্পিত নিজেকে তারা খুঁজে পায় এই নিজের তোলা নিজের ছবিটিতে।

এখন আসুন সেলফি কিভাবে বিশ্ব জয় করে নিলো সে প্রসঙ্গে। স্মার্টফোন নামের অস্ত্রটি ততদিনে হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। তাতে স্ক্রিন টাচের মাধ্যমেই ক্যামেরাটি ঘুরিয়ে নিজের দিকে তার করার পাকাপাকি ব্যবস্থা রয়েছে। যেনো অন্যকে দেখতে নয়, নিজেকেই দেখতে চায় তারা। অন্যকে যদি দেখাতেই হয়, তা দেখতে হবে সামাজিক মাধ্যমে।

সে আপনি মক্কায় যান, আইফেল টাওয়ারে যান, কিংবা চীনের প্রাচীরেই যান, আপনার হাতে এখন একটা সেলফি স্টিক থাকছেই। মহাকাশ যাত্রীরাও সেখানে সেলফি তুলতে ভুলছেন না। সমুদ্র তলদেশেও তোলা হচ্ছে সেলফি। অস্কারে হাজির হয়ে সেলিব্রেটিরা সেলফি তুলছেন।

তাহলে কি সেলফি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাচ্ছে? কিংবা সাধারণের শিল্পের এক নতুন ধারা এই সেলফি?
সে কথাতো বলাই যায় যখন সেলফির জাদুঘর নামে একটি উদ্যোগ এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সেখানে ঢুকেই দেখুন না… সেলফিকে তারা নিয়ে গেছে প্রগৈতিহাসিক যুগ পর্যন্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার গ্লেনডেলে এই জাদুঘরের উদ্দেশ্যই হচ্ছে নিজের ছবি নিজেই তোলার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা যার মূল প্রোথিত রয়েছে ৪০ হাজার বছর আগে। সত্যিই ৪০,০০০ বছর!!

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন