বিজ্ঞাপন

‘বিদেশে ধর-পাকড়ের সময় পাচার করা অর্থ ফেরাতে বাজেটে সুবিধা’

June 19, 2022 | 11:40 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার জন্য যে সুযোগ দেওয়া হয়েছ তার কড়া সমালোচনা করে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেছেন, এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেই ঠিকই, কিন্তু যুক্ত হয়েছে তার চেয়েও ভয়ংকর বিষয়। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বৈধ করা এবং দেশে ফেরত আনার নামে ১৫ শতাংশ হারে কর ধার্য করে প্রশ্নাতীতভাবে সেগুলো প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে টাকা ফেরত আসার কোনো কারণ নাই। কারণ, যারা টাকা বিদেশে পাচার করে তারা ফেরত আনার জন্য করে না। এটি করা হয়েছে যাতে কখনও কোনো দেশ যদি এমন টাকা পাচারকারীদের ধর-পাকড় শুরু করে তখন যেন তারা নিরাপদে টাকা দেশে আনতে পারে।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৯ জুন) রাতে একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

রুমিন ফারহানা বলেন, ‘টাকা ফেরত আনার জন্য নয় পাচারকারীদের নিশ্চয়তার জন্যই এই পদক্ষেপ। নিশ্চতভাবেই এই পদক্ষেপ আরও অনেককে টাকা পাচারে উৎসাহিত করবে।’

বাংলাদেশ খুব সতর্ক না হলে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হতে পারে উল্লেখ করে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার হাম্বল টোটায় সমুদ্রবন্দর প্রকল্প শুরু করার আগে নানা বিদেশি সংস্থা এবং দেশটির হাতে গোনা কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছিল, কলম্বো থেকে মাত্র ১৬৬ কিলোমিটার দূরত্বের এই বন্দরের কোনো অর্থনৈতিক ভবিষৎ নাই। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বন্দরটি এই এলাকার শিপিং হাবে পরিণত হয়ে দেশটির অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলবে। শ্রীলঙ্কার সেই সময়ের পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের কিছু অর্থনীতিবিদ তাদের স্বার্থের চিন্তায় বা ভয়ে বলছেন, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা-ই নাই। তবে কিছু অর্থনীতিবিদ আমাদের স্পষ্ট জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশ যদি খুব সতর্ক না হয় তাহলে দ্রুতই শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হতে পারে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী ছয়টি চ্যালেঞ্জের প্রথমটিতেই বলেছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। এই খাতে যেটা চিন্তা করেছেন তাতে অর্থমন্ত্রীর অর্থনীতি বোঝাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি ডিমান্ড ফুল না। চাহিদা বৃদ্ধিজনিত কারণে হয়নি যে, এর প্রবৃদ্ধি কমানো যাবে। করোনায় মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের প্রত্যেক মানুষের আয় কমেছে। আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। তাহলে চাহিদা বাড়ে কিভাবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে কিছু পণ্যের মূল্য বাড়ারর কথা। এই দেশে যা হয়, সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীর কারণে দাম যত না বাড়ার কথা, বেড়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ। তবে এসব নিয়ন্ত্রণের কথা বাজেটে নাই। যখন মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের কিছু বেশি তখন অর্থনীতির বোদ্ধারা বলছেন এই মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণেরও বেশি।’

রুমিন বলেন, ‘বাজেটোত্তোর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, গরিব ছিলাম তাই গরিব হওয়ার কষ্ট বুঝি। অর্থমন্ত্রী আগে গরিব থাকলেও এখন অতি ধনী হয়েছেন তাও না। হয়েছেন আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী। সুতরাং গরিবের কষ্ট বোঝার তার কোনো কারণ নাই। গরিব মানুষের নাভিশ্বাস তৈরি করার বাজেটে অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা তুলে দেওয়া হবে সরকারের হাতে। এবারের বাজেটে ভর্তুকি রাখা হয়েছে ৮৩ হাজার কোটি টাকা যার প্রধান অংশ যাবে বিদ্যুৎ খাতে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কিংবা কম সক্ষমতায় চালিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের হাতে ক্যাপাসিটি চার্জ এবং বিদ্যুৎ কেনার নামে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘গত ১০ বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ তুলে নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানি গ্রুপের তৈরি গোন্ডা কোল্ড পাওয়ার প্লান্ট থেকে ২৫ বছরের চুক্তিতে বিদ্যুৎ কিনে কিংবা না কিনে বাংলাদেশ এক লাখ কোটি টাকা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দেবে, যেটা দিয়ে তিনটা পদ্মা সেতু নয়টি কর্ণফুলী টানেল বা চারটি মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্প করা সম্ভব। এমনকি আগস্টে বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পন্ন হবার পর সঞ্চালন লাইনের অভাবে দেশে বিদ্যুৎ না এলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিলেও দেশের বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা মেটানোর মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের আছে। সামনে আসছে আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ থেকে বড় অংকের টাকা আমদানির নামে ওভার ইনভয়েচিংয়ের মাধ্যমে পাচার হয়েছে। নির্বাচন এলেই এদেশে টাকা পাচার বাড়ে। এটি গ্লোবাল ফাইনান্স ইনটিগরিটির রিপোর্ট। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে টাকা পাচার ডাবল হয়ে যায়। ওই বছর এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছিল। ২০১৫ সাল থেকে সরকার জাতিসংঘে আমদানি রফতানির তথ্য দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। পাচারের এই তথ্য লুকানোর চেষ্টা প্রমাণ করে সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ লোকজন এই পাচারের সঙ্গে জড়িত। অনেকেই এই টাকার হিস্যা পায়।’

রুমিন বলেন, ‘জিডিপির অনুপাতে ঋণ ৪৫ শতাংশ পার হয়ে গেছে। জিডিপির সঠিক হিসাব হলে দেখা যেত এটা ৭০ শতাংশ পার হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিপৎসীমা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। এবারের বাজেটে জনগণের করের টাকার এক পঞ্চাংশ চলে যাবে ঋণের সুধ পরিশোধের পেছনে। আজ যে শিশু জন্ম নিচ্ছে তার মাথায় ৯৬ হাজার টাকার ঋণ। মানুষের পকেটের টাকা বের করে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার।’

তিনি বলেন, ‘গত বাজেটের মতো এবারও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঘনবসিতপূর্ণ দেশে কোনোভাবেই এই প্রকল্প যৌক্তিক ছিল না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্পটিতে দেশের মূলধন ব্যায় হবে ৫০ লাখ ডলার। এই প্রকল্প ভয়ংকর ঝুকি তৈরি করছে। এরকম আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে পদ্মায় রেল প্রকল্প। এর জন্য এখন পর্যন্ত ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। যেটা বাড়বে আরও।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘পায়রাবন্দর করার প্রয়োজন ছিল না। রামু থেকে কক্সবাজার রেল দরকার ছিল না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ার পরও একের পর এক ক্ষমতায় থাকার পর বাংলাদেশে চরম কর্তৃত্ববাদী দল আওয়ামী লীগ গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম হয়েছে। নিজেদের আখেড় গুছিয়ে অনাগত বহু প্রজন্মের জন্য নিশ্চিত রাজকীয় জীবন-যাপন নিশ্চিতের পর দেশ শ্রীলঙ্কা হলে তাতে কি বা আসে যায় ক্ষমতাসীনদের।’

সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন