বিজ্ঞাপন

মেডিটেশনে কেন কর দিতে হবে?

June 22, 2022 | 3:57 pm

জুয়েল সরকার

ছোটবেলায় পড়েছি স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। আর সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকার মনের সুস্থতা। এই সময়ে এসে মনের সুস্থতা ধরে রাখা যদিও অনেক কঠিন। চারপাশে ফেসবুক, স্মার্টফোন আছে। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি আমাদের আবহমান কালের পরিবারের সুখকে বিনষ্ট করছে। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজ সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতিকর দিকে আসক্ত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে অনিদ্রা, অমনোযোগিতা, হতাশা, অস্থিরতা, হীনমন্যতা, নেতিবাচক ভাবনা।

বিজ্ঞাপন

অথচ আমাদের ৭৫ ভাগ রোগই হলো মনোদৈহিক, যার উৎস মন; কিন্তু প্রকাশ শরীরে। মন থেকে সমস্ত নেতিবাচক আবেগ দূর করতে পারলে এই সমস্ত রোগ আপনা আপনিই চলে যায়। করোনাকালে ঘরবন্দী মানুষের মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের যে বিপর্যয় ঘটে তা কাটিয়ে উঠতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্বের শত শত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গবেষকরা ইয়োগা ও মেডিটেশন চর্চা করার পরামর্শ দেন। অনেক ডাক্তারও আজকাল মেডিটেশন প্রেসক্রাইব করছেন।

আমাদের শরীরকে কর্মক্ষম ও সুস্থ রাখার জন্য যেমন ব্যায়ামের প্রয়োজন, তেমনি মস্তিস্কের ব্যায়াম হলো মেডিটেশন বা ধ্যান। নিয়মিত মেডিটেশনে মস্তিস্ক ঠাণ্ডা থাকে। আর মন থাকে প্রশান্ত যা একজন মানুষকে সর্বাধিক কর্মদক্ষতা দিতে পারে। বাংলাদেশে মেডিটেশন করে উপকার পাচ্ছেন লাখো মানুষ। মানসিক এই সেবার মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা সুন্দরভাবে সমাধান করছেন তারা। হতাশা, ব্যর্থতা টেনশনকে ঝেড়ে ফেলে নিজেকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।

যেসব প্রতিষ্ঠান মেডিটেশনের দীক্ষা দেয় তাদের আনা হচ্ছে ভ্যাটের আওতায়। সরকার মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে রাজস্ব বাড়বে। অবশ্য অর্থের বিনিময়ে যেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মেডিটেশন সেবা দিয়ে থাকে তাদের ওপর আরোপ করা কর প্রকারান্তরে সেবাগ্রহীতাদের ঘাড়েই পড়বে। মেডিটেশন (ধ্যান) এমন এক অনুশীলন যার মধ্য দিয়ে মানুষ আত্মনিমগ্ন হয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়, চিন্তা বা কাজের প্রতি মনোনিবেশ করে। বাড়িয়ে তোলে আত্মবিশ্বাস। দূর করে মানসিক অস্থিরতা।

বিজ্ঞাপন

ধ্যান করাটা কোনো ব্যক্তির একান্তই ব্যক্তিগত চর্চা। শারীরিক ব্যায়ামেরই একটি মাধ্যম বলা যেতে পারে। এবার সেই ধ্যান করতে গেলেও দিতে হবে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সংকট উত্তরণের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন তাতে করারোপ করা হয়েছে মেডিটেশনেও। মেডিটেশন সেবার ওপর বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। এই খাতে আগে ৫ শতাংশ ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ এ প্রস্তাব কার্যকর হলে আবারও এই সেবা পেতে আগ্রহীদের ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এর আগের বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে মেডিটেশন সেবাকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী উল্লেখ করে মূসক অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে ব্যক্তিপর্যায়ে যারা মেডিটেশন করেন তাদের কোনো চিন্তা নেই। যেসব প্রতিষ্ঠান মেডিটেশনের দীক্ষা দেয় তাদের আনা হচ্ছে ভ্যাটের আওতায়। সরকার মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে রাজস্ব বাড়বে। অবশ্য অর্থের বিনিময়ে যেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মেডিটেশন সেবা দিয়ে থাকে তাদের ওপর আরোপ করা কর প্রকারান্তরে সেবাগ্রহীতাদের ঘাড়েই পড়বে।

ধ্যান বা মেডিটেশন হলো মনের ব্যায়াম। মেডিটেশনের আদি ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা দেখলে সাদা চোখে একটি গুণগত পার্থ্যক্য লক্ষ্যণীয়, শুরুর দিকে এশীয় অঞ্চলে যেখানে ধ্যানে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে; সেখানে বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বে ধ্যানের মাধ্যমে শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যগত উপকারিতা এবং বৈষয়িক সাফল্য পাওয়ার বিষয়টিই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মেডিটেশনের মূল চারণক্ষেত্র প্রায় ৫,০০০ বছর আগে থেকেই। যে দেশ মেডিটেশনের অন্যতম উৎসভূমি সেই দেশেই আজ ধ্যানের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু কেন? এ পর্যায়ে মেডিটেশনের ওপর সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো জনমানুষের জানা প্রয়োজন-মেডিটেশন আসলে কতটুকু উপকার করতে পারে?

উপমহাদেশে ধ্যান মূলত গুরুমুখী বিদ্যা। পাশ্চাত্যে যারা এখন ধ্যান শেখাচ্ছেন; তাদের প্রত্যেকের জীবনের শুরুর দিকে তাকান, কোনো না কোনোভাবে তারা এই প্রাচ্য থেকেই ধ্যান শিখেছেন। ড. ডিন অরনিশ, অ্যানোডা জুডিথ; যারা এখন ধ্যানের ব্যবহার নিয়ে সোচ্চার এবং সমানতালে শিখিয়ে যাচ্ছেন- তারা শিখেছেন কোথায়? এই প্রাচ্যে। মূল মেডিটেশন ঠিক রেখে তারা শুধু বিজ্ঞানের কিছু টার্মিনোলজি প্রয়োগ করেছেন এবং তাদের ক্ষেত্রে ‘গুরু’ শব্দ বাদ হয়ে তা হয়েছে ‘সাইকোএনালিস্ট’ বা মনোবিশ্লেষক। সফল উদ্যোক্তা জেফ ওয়েইনার (লিংকডইন এর সিইও) থেকে শুরু করে সেলিব্রিটি অপরাহ উইনফ্রেসহ মুখচেনা কর্মযোগী মানুষদের সিংহভাগই এখন কোনো না কোনো ধরনের ধ্যানের অনুশীলনের সাথে জড়িত। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মেডিটেশন মূল চিকিৎসার অংশ হিসেবে স্বীকৃত এবং তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়টা অন্তত শেষ।

বিজ্ঞাপন

২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন একটি গবেষণাপত্র নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। এর শিরোনামে বলা হয়, ধ্যান বা মেডিটেশন আপনার স্বাস্থ্যখরচ প্রতিবছর ২৫ হাজার ডলার কমিয়ে দেবে। বেনসন-হেনরি ইন্সটিটিউটের রিলাক্সেশন রেসপন্স রেজিলিয়েন্সি প্রোগ্রামের আওতায় এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ডার্টমাউথ হিচকক মেডিক্যাল সেন্টারের ইন্টারনাল মেডিসিনের চিফ ড. জেমস স্টাহ্ল। তার দল চার বছর ধরে ৪ হাজার ৪০০ মানুষের তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন মেডিক্যাল থেকে এবং তাদের ৮ সপ্তাহের একটি রিলাক্সেশন মেডিটেশন, ইয়োগা অনুশীলনের আওতায় আনা হয়। এর ফলে তাদের প্রত্যেকের মেডিক্যাল খরচ আগের বছরের তুলনায় ৪৩% কমে যায়।

ড. জেমস স্টাহ্ল দ্বিতীয় আরেকটি গবেষণা করেন, এই গ্রুপের ভেতর যাদের সরাসরি কোনো না কোনো রোগের জন্যে সারাবছর ক্লিনিক্যাল সেবা প্রয়োজন ছিল। তাদের এই ক্ষেত্রে খরচ কমে ২৫%। তিনি ডলারে এই বিষয়টি আরও ভেঙে বলেছেন। উন্নত বিশ্বে যেখানে মেডিটেশনের একটি কোর্সে ন্যূনতম খরচ হয় ৫০০ ডলার (বাংলাদেশি ৪৫,০০০ টাকা), সেখানে একবার মেডিক্যাল ইমারজেন্সির ন্যূনতম খরচ ৪,০০০ ডলার (বাংলাদেশি ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা)। ছোটখাটো রোগ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক রোগের হিসাব থেকে দেখা যায়, একেকজন রোগী বছরে ৬৪০ ডলার থেকে ২৫,৫০০ ডলার পর্যন্ত প্রতি বছর মেডিক্যাল খরচ কমাতে পারে শুধু মেডিটেশন প্র্যাকটিসের মাধ্যমে।

ড. ডিন অরনিশ কীভাবে বিল ক্লিনটনের বাইপাস সার্জারিকে বাইপাস করিয়েছেন তা গুগল করলেই বিস্তারিত পাওয়া যায়। তার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং ইয়োগা মেডিটেশনের মাধ্যমে জীবনযাপন চিত্রই পাল্টে দিয়েছিলেন ড. অরনিশ। হালে বারাক ওবামা এখন যাওয়া আসা শুরু করেছেন ডিনের কাছে।

ড. জন হ্যাজলিনের বিভিন্ন গবেষণা উল্লেখ আছে; যিনি একাধারে একজন কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট, মেডিটেশন প্র্যাকটিশনার এবং মেডিটেশন গবেষক। তিনি দলবদ্ধ ধ্যান কীভাবে সমাজের চিত্র বদলে দিতে পারে তার একটি পরিসংখ্যানগত গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনে সামগ্রিক অপরাধপ্রবণতা ২৬% কমে যায়, একই সময়ে লেবানন যুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার কমে যায়। হ্যাজলিন বলেন, গ্রুপ মেডিটেশনের মাধ্যমে সমাজে সুস্থ চিন্তার বিকাশের ফলেই সমষ্টিগত চেতনার এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত মেডিটেশন ইয়োগা মূল চিকিৎসার অংশ করে নিয়ে কর অব্যাহতি দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সংস্কার আনার প্রয়াসে দিল্লি সরকার রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়গুলোতে একটি ‘সুখী পাঠ্যক্রম’ চালু করেছে। পাঠ্যক্রমটিতে প্রতিটি শ্রেণির আগে ৪৫ মিনিট এবং পাঁচ মিনিটের ধ্যানের একটি সুখের সময় জড়িত। ৪০ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে, যার মধ্যে ধ্যান, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানসিক অনুশীলন রয়েছে। অপরাধীদের ধ্যান প্রশিক্ষণেও জোর দিয়েছে আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড। সম্প্রতি বৃটেনও পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে অপরাধীদের ধ্যান প্রশিক্ষণ। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্য প্রকাশিত উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার গাইডলাইনে যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি মেডিটেশন, যোগব্যায়াম চর্চার কথা বলেছে।

মেডিটেশন আমাদের মনের শুভ ও ইতিবাচক শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। বিশ্বাস, প্রত্যয় ও আশার সঞ্চার ঘটায়। আমরা হয়ে উঠি সাহসী ও প্রাণবন্ত । দেশ ভালো হবে-যখন দেশের মানুষগুলো ভালো হবে। আর মেডিটেশন ভালো মানুষ হতে সাহায্য করে। অথচ স্বাস্থ্যসেবায় খুব উপকারী মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আমাদের যে কোন রোগের চিকিৎসার পরামর্শ নিতে ভ্যাট দিতে হয় না, তাহলে একজন রোগীকে তার চিকিৎসার পরামর্শ বা প্রশিক্ষণ নিতে কেন ভ্যাট দিতে হবে? কোভিড প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মন যখন বিপর্যস্ত, সেখানে মেডিটেশনের আশ্রয় নিলে তাকে বেশি মূল্য দিতে হবে কেন?

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সক্ষমতা এই সময়ে প্রশ্নাতীত। প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আজ আমরা পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করতে পেরেছি। অর্থনৈতিকভাবে সফল একটি দেশকে তার অর্থের সুফল পেতে হলে নৈতিকভাবে একটি সুস্থির জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন। আর তাই মেডিটেশনের ওপর স্থায়ীভাবে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়াও প্রয়োজন। যাতে সুস্থ চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে আমরা যেন এক মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। ধ্যান নিয়ে বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় ভ্যাটের অজুহাতে বাংলাদেশও পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় আর।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন