বিজ্ঞাপন

সংবাদ প্রকাশে দায়িত্বশীল না হলে বাড়তে পারে আত্মহত্যার ঝুঁকি

July 4, 2022 | 12:56 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: আত্মহত্যা বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পরিবেশন করা না হলে এ ধরনের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মনোবিদরা। তারা বলছেন, কেবল আত্মহত্যার সংবাদই নয়, স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা ও সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়েও বাড়তি সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ স্বজনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে সেই পরিবারের সদস্যদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভুল সংবাদ প্রকাশে তাদের মাঝেও বাড়ে আত্মহত্যার ইচ্ছা।

বিজ্ঞাপন

রোববার (৩ জুলাই) রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজিত ‘রেসপন্সিবল রিপোর্টিং অন সুইসাইড’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

কর্মশালায় বক্তারা আরও বলেন, সংবাদে সচেতনতামূলক তথা, আত্মহত্যার ঝুকিঁপূর্ণ ব্যক্তিরা কোথায় সাহায্য পেতে পারেন সে বিষয়ে তথ্য থাকতে পারে। এক্ষেত্রে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি ও প্রচার মিডিয়াকর্মীদের কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সেলিব্রেটিদের আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশেও বাড়তি সতকর্তা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

কর্মশালায় ‘আত্মহত্যার সংবাদ: কেমন হওয়া উচিত’ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, কোনো স্থান যেন ‘সুইসাইড স্পট’ হয়ে না ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আত্মহত্যার স্থান নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে স্থানটিকে যেন বেশি বিখ্যাত বা রঙ-চঙ না দেওয়া হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন— কোনো বিশেষ উঁচু স্থান, বিশেষ পুকুর ইত্যাদিতে প্রায়ই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বলে প্রচার মাধ্যমে সাধারণের জন্য সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

উদাহরণ দিয়ে ডা. হেলাল বলেন, বিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাতে আত্মহত্যার বিভিন্ন খবর প্রকাশের পর স্থানটি যেন সুইসাইড স্পটে পরিণত হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৮৫৬ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত নায়াগ্রা জলপ্রপাতে দুই হাজার ৭৮০ জন আত্মহত্যা করেন।

তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যার পরে মরদেহের ছবি বা ভিডিও ফুটেজ কোনোভাবেই প্রকাশ করা উচিত নয়। সেলিব্রেটি বা বিখ্যাত বা জনপ্রিয় কেউ আত্মহত্যা করে ফেললে বিষয়টিকে দ্বিগুণ সতর্কতার সঙ্গে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। তাছাড়া প্রায় সময়ই সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়— ‘পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যা’। এ ধরনের শিরোনাম পরের বছরে পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রটিকেই মূলত আত্মহত্যার উপায় বাতলে দেয়। সংবাদটিতে আত্মহত্যার ঘটনায় সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে আত্মহত্যাকারীকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ‘নায়কোচিত’ ভূমিকায় রূপান্তর করা হয়। এর ফল হয় ভয়াবহ।

আত্মহত্যা করলে ‘মৃত আমি’ অনেক সহমর্মিতা পায়, যা অনেকটা সামাজিক ন্যায়বিচারের বিকল্প হবে— এই বোধ আরও নতুন আত্মহত্যা ঘটতে পারে বলে মনে করেন ডা. হেলাল। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমকে অনেক ভূমিকা রাখতে হবে। ২০০৮ সালে হংকংয়ের মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফু কে ডব্লিউ তার এক গবেষণাপত্রে উপস্থাপন করেন, হংকংয়ের চীনা ও ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রগুলোতে আত্মহত্যার সংবাদগুলো প্রকাশ না করা বা প্রকাশ করলেও অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করায় সে দেশে আত্মহত্যার হার ও প্রবণতা কার্যকরভাবে কমে গেছে।

বিজ্ঞাপন

এমন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার সংবাদ কেমন হতে পারে?— এ তথ্য জানিয়ে ডা. হেলাল বলেন, আত্মহত্যার সংবাদটি প্রথম পৃষ্ঠায় বা অন্য পাতায় খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রকাশ করা যাবে না। শিরোনামে এমন কোনো শব্দ বা বাক্য রীতি ব্যবহার করা উচিত নয়, যা পাঠক বা দর্শককে উদ্দীপনার খোরাক দেয়। আবার এমনভাবেও প্রকাশ করা যাবে না যে আত্মহত্যা একটি মামুলি স্বাভাবিক মৃত্যুমাত্র। যেমন— ‘অপমান সইতে না পেরে রেললাইনে মাথা পেতে দিলো অমুক’ বা ‘অভিমান করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অমুক’ ইত্যাদি আলংকারিক বাক্য রীতির চাইতে কেবল সংক্ষিপ্ত শিরোনাম দেওয়া উচিত ‘অমুকের আত্মহত্যা’। পত্রিকার শিরোনামে যেন এমন কোনো বার্তা না থাকে যাতে মনে হয় আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান। যেমন, ঋণ থেকে চির মুক্তি পেল অমুক বা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তরুণের বিষপান ইত্যাদি শিরোনাম যেন না হয়। কীভাবে একজন আত্মহত্যা করেছে বা করার চেষ্টা করে কেন ব্যর্থ হয়েছে, সে বিষয়গুলো যেন বিস্তারিত বিবরণ আত্মহত্যার সংবাদে না থাকে। এ ধরনের বিবরণ ভবিষ্যতে আরও একজনকে একটি ‘সফল’ আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

আত্মহত্যার পরে মৃতদেহের ছবি বা ভিডিও ফুটেজ কোনোভাবেই প্রকাশ করা উচিত নয় জানিয়ে ডা. হেলাল বলেন, একটি পরিবারের একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে সে পরিবারের বাকি সদস্যরা মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত থাকে। এ অবস্থায় তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা বা সাক্ষাৎকার নেওয়া খুবই অসংবেদনশীল কাজ। আত্মহত্যাকারীর পরিবারের নিকটজনদের শোকের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এমন কোনো শব্দ বা তথ্য দেওয়া যাবে না যাতে নিকটজনদের শোক আরও ঘনীভূত হয় এবং তাদের মধ্যেও আবার আত্মহত্যার ইচ্ছা জেগে ওঠে।

বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করার তাগিদ দেন এই চিকিৎসক। সেলিব্রেটিদের আত্মহত্যার খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। আত্মহত্যার সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবশেনকারী সংবাদকর্মী নিজেও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে প্রয়োজনে তাকেও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে হতে পারে বলে মত দেন ডা. হেলাল।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এনসিডি শাখার প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহীদুল ইসলাম বলেন, সারাবিশ্বেই আত্মহত্যা বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তবে আত্মহত্যা প্রতিরোধে মিডিয়াগুলো বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আত্মহত্যার খবর প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পলিসি হলো শিরোনামে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি পরিহার করা। এটি হয়তো আমাদের গণমাধ্যমে হঠাৎ করেই সম্ভব না। তবে, ধীরে ধীরে সেটি কমিয়ে আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যের বরাত দিয়ে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অধিকাংশ আত্মহত্যার শিকার নারীরা। ২০১৭ সালে সারাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১০ হাজার ২৫৬টি। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার। ২০১৯ সালেও দেশে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর ২০২০ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৩৬টিতে। এদিকে, সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি তথ্য বলছে, ২০২১ সালে শিক্ষার্থী ১০১ জন আত্মহত্যা করেছেন।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন