বিজ্ঞাপন

আবার কেন ফিরে এলো লোডশেডিং?

July 9, 2022 | 3:38 pm

বিভুরঞ্জন সরকার

দেশে নতুন করে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। ঢাকার বাইরে লোডশেডিং বেশি হলেও ঢাকা শহরেও গত কয়দিন ধরে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। কোনো এলাকায় প্রতিবার ৪০-৪৫ মিনিট করেও বিদ্যুৎ থাকছে না। এ নিয়ে মানুষ নানা রকম রসালো মন্তব্যও করছেন। কেউ প্রশ্ন তুলছেন, দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার কথা কি তাহলে গল্পকথা ছিল? সরকারকে তুলোধুনো করার একটি মোক্ষম হাতিয়ার পেয়ে বিরোধী দল মহাখুশি। মানুষ একটি বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে, সেখানে ব্যতিক্রম কিছু হলে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয়। লোডশেডিং দেশে প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বেশ ঘটা করে প্রচার করা হয়েছিল যে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। এখন আবার লোডশেডিং শুরু হওয়ায় মানুষ তাই ক্ষুব্ধ, হতাশ। আসলে দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ দেওয়ার বিষয়টি সরকার বললেও বাস্তবে তা সঠিক ছিল না। বিদ্যুতের ঘাটতি দেশ থেকে একেবারে দূর করা যায়নি। ঢাকায় পরিস্থিতি যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকলেও ঢাকার বাইরের অবস্থা কখনো স্বাভাবিক ছিল না।

বিজ্ঞাপন

গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় বিদ্যুতের উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা চলছে । দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৭০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ হতো ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ ছিল ২২০–২৩০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার এলএনজি ও তেল আমদানি কমিয়ে দেয়। বিপিসি তথ্য মতে, দিনে তেল আমদানিতে ১০০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বেসরকারি উদ্যোগে অনেক রেন্টাল ও কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সেটি ছিল আপৎকালীন ব্যবস্থা। এক যুগ পরও সেই রেন্টাল ও কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। গত ১০ বছরে বিদ্যুৎ খাতের যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটাকে অপরিকল্পিত বলেও কেউ কেই মনে করেন। বিদ্যুৎ খাতের অপচয় ও অদক্ষতার সমালোচনাও হচ্ছে। কেউ কেউ এমন অভিযোগও করছেন যে গত ১০ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে।

আমাদের অনেক পরিকল্পনায়ই দূরদর্শিতার অভাব থাকে। আমদানিনির্ভরতার বিপদ সম্পর্কেও আমরা সময় থাকতে সচেতন হওয়ার গরজ বোধ করি না। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল, তখন সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করেছে। সেই লাভের টাকা আপৎকালের জন্য আমরা বরাদ্দ রাখার কথা ভাবিনি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ার অজুহাতে আমদানি কমিয়ে দেওয়া হলে বা বন্ধ করা হলে নানামুখী সমস্যা তৈরি হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ কমলে মানুষের জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি শিল্প কারখানায় উৎপাদনও কমবে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি করেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ অবস্থায় ঘন ঘন লোডশেডিং হলে উৎপাদন যেমন ব্যাহত হবে, রপ্তানি আয়ও কমে যাবে। তাই যেকোনো মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। প্রয়োজনে সরকারকে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে স্থল ও সমুদ্রভাগে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও উত্তোলনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এটাই জ্বালানি খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর উপায়।

বাংলাদেশের প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস আছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে। জ্বালানি খাতে এই বিপর্যয় হলো কেন, তা এক বিরাট প্রশ্ন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, পরনির্ভর জ্বালানিনীতি দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।

২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধের মীমাংসা হয়। এরপর গত আট বছরেও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে সরকার কেন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, সে প্রশ্ন করা কি অন্যায় হবে? অথচ ২০১৬ সালে ঘোষিত সরকারের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানে জ্বালানি আমদানির ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর করার পেছনের রহস্য কি?

বিজ্ঞাপন

প্রচণ্ড গরমে দিন-রাত দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে জনজীবন জেরবার হওয়ার অবস্থায় বিদ্যুৎ খাতের চলমান সংকট উত্তরণে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সভা হয়েছে গত ৭ জুলাই। সভা শেষে তরলীকৃত গ্যাস ও তেলের দাম বিশ্ববাজারে বাড়তে থাকার উল্লেখ করে জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী সাংবাদিকদের বলেন, ‘জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি যে এখানেই শেষ, তা বলা যাবে না। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভবিষ্যৎ শুধু বলবে। বিদ্যুৎ-সংকটের বর্তমান অবস্থা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে। তাই সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে।’

তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, অফিস সময় সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা করা যায় কিনা বা ঘরে বসে কাজ করা যায় কিনা, এগুলোসহ বিভিন্ন বিকল্প সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চিন্তা করা হচ্ছে। যার যার ঘরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহার কমাতে হবে। শীতাতপ যন্ত্রের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির নিচে নামানো যাবে না। আলোকসজ্জা হবে না। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে। বাজার, মসজিদ ও শপিংমলে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে।

তৌফিক-ই-ইলাহী জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এটা কত কমানো যাবে তার ওপর লোডশেডিং নির্ভর করবে। বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে মোট চাহিদা দুই হাজার মেগাওয়াট কমানো গেলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কোথাও কম-বেশি না করে দেশের সব এলাকায় লোডশেডিং বণ্টন করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, লোডশেডিং কখন হবে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানানো সম্ভব নয়। সরকার একটি অ্যাপ তৈরি করছে। গ্রাহক সেখান থেকে জানতে পারবেন তাঁর এলাকায় কখন লোডশেডিং হবে।

সরকার আমদানি নির্ভরতার কারণে দেশে গ্যাস উৎপাদনে নজর দিচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, এক দশক আগে ১৮০০ এমএমসিএফ গ্যাস উৎপাদন হতো। এটা ২৭০০ এমএমসিএফ পর্যন্ত বেড়েছে। চাহিদা বাড়ায় সংকট হচ্ছে। তবে গ্যাসের সম্ভাবনা রয়েছে এমন স্থানে অনুসন্ধান চলছে। বর্তমান গ্যাস ক্ষেত্রগুলোয় আরও গভীরে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে কিনা তাও দেখা হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরের পর বিদ্যুৎ সংকট কমে যাবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে আদানি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও রামপালের কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুতের এই পরিস্থিতির মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক অডিওবার্তায় তিনি এ ইঙ্গিত দেন। দেশের ৬৪ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসে চলে জানিয়ে তিনি বলেন, নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ দিন দিন কমছে দ্রুতগতিতে। ধীরে ধীরে গ্যাসের মজুত কমতির দিকে যাবে।

সরকার গ্যাস কিনতে হিমশিম খাচ্ছে এবং ভর্তুকি দিয়েও চড়া দামে গ্যাস ও তেল কেনার অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এবং খোলা বাজার থেকে গ্যাস কেনে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ গ্যাস নেয় রাশিয়া থেকে। ইউক্রেন পরিস্থিতিতে রাশিয়া গ্যাস বন্ধ করতে শুরু করায় খোলা বাজারে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে প্রচণ্ডভাবে। এসব দেশও এখন খোলা বাজারের ওপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এ কারণে চার ডলারের গ্যাস ৩০ ডলার হয়ে গেছে।

ছয়-সাত মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ইউনিট গ্যাগের দাম ৪১ ডলারেট কাছাকাছি। কোভিডের আগে দাম ছিল ৪ ডলার। ৭১ ডলারের তেল এখন ১৭১ ডলার হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন যে উচ্চমূল্য জ্বালানি আমদানির অবস্থায় সরকার নেই। ভর্তুকি অব্যাহত রাখলেও একসময় দামের সমন্বয় করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, শপিংমল, দোকানপাট, অফিস ও বাসাবাড়িতে আলোকসজ্জার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, কমপক্ষে আড়াই মাস বিদ্যুৎ সংকটে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো বেশি বিপদে পড়বে। এসব শিল্পে অনেকেরই জেনারেটর নেই। করোনা-কালের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই এই সংকট বড় ধাক্কা হয়ে আসবে শিল্পে। এর পরিণামে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় প্রভাব পড়বে। উৎপাদন কমবে। এর ফলে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং বেকারত্ব বাড়ার ঝুঁকি আছে। এতে অনেকের আয় কমবে। তিনি বলেন, শিল্পে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত অব্যাহত রাখতে হবে। শিল্প-কারখানা আছে, এমন এলাকায় লোডশেডিং করতে হলে রাতে করা যেতে পারে।

চলমান সমস্যাকে অস্বাভাবিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত করা যাবে না। আর দাম যদি বাড়াতেই হয়, তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ সব খাতে অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

এখন বড় প্রশ্ন এটাই যে, আমরা কি অপচয়, পাচার ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবো? গোষ্ঠী বিশেষের সম্পদের পাহাড় গড়ার উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রেখে সাধারণ মানুষকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানো নিষ্ঠুর রসিকতার মতো মনে হয় না কি?

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন