বিজ্ঞাপন

রিজভীর রিজার্ভ ইতিহাস এবং আমাদের মগজদাবা জ্ঞান

July 14, 2022 | 6:53 pm

আসাদ জামান

পলিটিক্সে সব জায়েজ! সকালের প্রার্থনা শেষে গায়ে শ্বেত-শুভ্র পোশাক জড়িয়ে, পায়ে চকচকে মোকাসিন পরে হাটে-মাঠে-ঘাটে, সভা-সমাবেশে অথবা মিডিয়াতে এসে দেদারসে মিথ্যা বলা জায়েজ! মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা জায়েজ! প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অথবা নিজ দলের সমর্থকদের হাততালি, দলীয় প্রধানের কাছ থেকে পিঠ চাপড়ানী পাওয়ার জন্য উদ্ভট বক্তব্য দেওয়া জায়েজ!

বিজ্ঞাপন

এ রকম আরও অনেক জায়েজ আছে। এ ধরনের ‘জায়েজ’ কাজের চর্চা এ দেশের রাজনীতিতে হরহামেশা হয়। আজও হয়েছে। সে জন্যই এ লেখাটার অবতারণা।

বিএনপির সবচেয়ে সক্রিয় নেতা রুহুল কবির রিজভী নিজ দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘দেশে ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে, তথাকথিত উন্নয়নের মাধ্যমে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে, দেশ থেকে লাখ-লাখ কোটি টাকা পাচার করে অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ তলানীতে ঠেকেছে- যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।’

ইদের ছুটির আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১৯৯ কোটি ডলারের আমদানি দায় পরিশোধের পর মঙ্গলবার (১২ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন- রিজার্ভের এমন নিম্নমুখী যাত্রায় রিজভীর এই বক্তব্য।

বিজ্ঞাপন

আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ‘রাজপথের প্রধান বিরোধী দলের’ একজন মুখপাত্র হিসেবে রুহুল কবির রিজভীর এই বক্তব্যে কোনো ত্রুটি নেই। হ্যাঁ, স্রেফ ‘পলিটিক্যাল’ বক্তব্য হিসেবে নিলে আসলেই কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু এটা তো শুধু বক্তব্য নয়, বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে তিনি তো একটা তথ্যও উপস্থাপন করেছেন। পরিস্কার করে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ তলানীতে ঠেকেছে- যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।’’

অর্থাৎ রুহুল কবির রিজভীর দেওয়া তথ্যমতে, দেশর ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কোনো দিনও নামেনি! সব সময় এর উপরেই থেকেছে। তাদের শাসন আমলেও ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপরে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ!

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ জমতে শুরু করে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার।

বিজ্ঞাপন

এর পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

১৯৯৪-৯৫ অর্থ বছর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে উঠানামা করে।

রিজার্ভে বাংলাদেশ ব্যাংক সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায় ২০০০-০১ অর্থবছরে। সেবার রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল। এরপর অবশ্য কখনই রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসেনি। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার দাঁড়ায়।

জামায়াত-বিএনপির শামসন আমলের শেষ দিকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অত্রিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

বিজ্ঞাপন

এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশকে। শুধু বেড়েই চলেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

২০২০ সালের অগাস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। এর এক বছর পর ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের এক দশক পর ১৯৮১-৮২ অর্থ বছরে ১২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে রিজার্ভ মজুদ শুরু হয়েছিল, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে সেটা ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চূড়া স্পর্শ করে। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের এই ‘রিজার্ভ’ ইতিহাস বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী জানেন না, তা নয়। তারপরও তিনি অকপটে বলে দিলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে- যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।’

এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের ‘বালখিল্য’ বক্তব্য কেন দেন তারা? এর উত্তরটা খুব সহজ- আমরা যখন কোনো দলকে সমর্থন করি, তখন সেই দলের নেতা-নেত্রীদের সব বক্তব্য বেদবাক্য হিসেবেই নিই। বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যের ওপর আমাদের বিশ্বাস একেবারে অন্ধের মতো। তারা যে ‘ভুল-ভাল’ তথ্য আমাদের দেন, সেটা যাচাই-বাছাই ছাড়াই গ্রহণ করি। শুধু গ্রহণ করি না, ওই ‘ভুল-ভাল’ তথ্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাশি রাশি ‘ভুল’ তথ্য মগজদাবা করে কুতর্কে লিপ্ত হই।

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন