বিজ্ঞাপন

অনিরাপদ রেলক্রসিংয়ের দায় কি রেল কর্তৃপক্ষের নয়?

August 5, 2022 | 7:08 pm

রাজন ভট্টাচার্য

কিছুদিন আগেই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে নিয়ে যায় চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেন। এতে মাইক্রোবাসে থাকা ১১ জন নিহত হন। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার পর ঘটনার সময়ে অনুপস্থিত থাকা গেটম্যানকে পরবর্তীতে গ্রেফতার করা হয়। যথারীতি ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমেও প্রতিক্রিয়া-পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ফলোআপ ইত্যাদি চলছে। সঙ্গে আবারও নিরাপদ লেবেল ক্রসিং নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনাও শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা এসব দুর্ঘটনা দায় রেল কর্তৃপক্ষ না নেওয়ার দাবি নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

কেউ বলছেন ট্রেন লাইনে ১৪৪ ধারা বজায় থাকলেও রেলেওয়ের দুর্বলতার কারণে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। উন্নত অনেক দেশেও রেল ও সড়কপথের মধ্যে সংযোগ রয়েছে। তবে নিরাপত্তা অনেক বেশি। ফলে মীরসরাইয়ের মতো এমন দুর্ঘটনা ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম।

রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন বিভিন্ন বিভাগের সড়ক রেলপথের উপর দিয়ে গেছে। ফলে তারা এককভাবে দুর্ঘটনার দায় নিতে নারাজ। এজন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

তাহলে কী দায়িত্ব নেওয়া আর না নেওয়ার মধ্যেই বিষয়টি পড়ে থাকবে? এর কোনো সমাধান নেই? মোট কথা হলো দায়িত্ব এড়ানোর সংস্কৃতি দেশে নতুন নয়। এই ধারাবাহিকতা থেকেই এমন কথা হয়ত বলা হচ্ছে। যখন কাজের কাজটুকু করা প্রয়োজন তখন দায়িত্ব নিয়ে আইনের যুক্তি মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন হলো এখন পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষ সমন্বিত পদক্ষেপের জন্য কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে? কয়টি প্রতিষ্ঠানকে রেল বিভাগের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মীরসরাইয়ে রেল দুর্ঘটনাই কী দেশে প্রথম ঘটলো? নাকি আগেও ঘটেছে! রেল দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে? যদি আগে ঘটে থাকে তাহলে এতদিন পর রেল বিভাগের কানে পানি গেল? এতেই প্রমাণিত হয় রেল জেগে ঘুমায়! কেউ জেগে ঘুমানোর ভান করলে তাকে তো ওঠানো কষ্টকর।
তাছাড়া রেল গেইটে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ বলে না সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার সড়কে ঘটেছে। সবাই বলে ট্রেন দুর্ঘটনা। লেবেল ক্রসিং বৈধ না অবৈধ? দায়িত্বরত গেটম্যান ছিল কী ছিল না? এসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তারমানে সবার অভিযোগের তীর থাকে রেল বিভাগের দিকে।

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের সাত মাসে রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৫২টি। এসব দুর্ঘটনা প্রাণ গেছে ১৭৮জন মানুষের। আহতের সংখ্যাও অনেক। এদিকে রেল বিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, দেশে ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৮৫৬টি রেলক্রসিং আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। ৯৬১টি রেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অনিরাপদ। রেল দুর্ঘটনার ৮৩ শতাংশরই প্রাণ যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এসব ক্রসিংয়ে।

মোট কথা হলো ৮২ ভাগ অনিরাপদ রেল ক্রসিং রেখে নিরাপদ রেল যোগাযোগ নিশ্চিত করা আসলে কতোটুকু সম্ভব? এই পরিসংখ্যান বলছে লেবেল ক্রসিংগুলো নিরাপদ করা এখন সময়ের দাবি। যে কোন মূল্যে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সব লেবেল ক্রসিংয়ের উপর দিয়ে বয়ে চলা সড়ক কোন না কোন বিভাগের। এই হিসাব করলে তো প্রায় সবই রেলওয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়বে না। তাহলে কী দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে?

রেলের লেবেল ক্রসিংগুলোতে প্রকল্পভিত্তিক জনবল কাঠামোর মেয়াদ শেষে কর্মচারীরা বেতন না পাওয়ায় অনেকেই কাজ ছেড়ে চলে গেছেন। ফলে দিন দিন গেটম্যানের সংখ্যা কমছে। অনেক এলাকায় পালাক্রমে ডিউটি করেন গেটম্যানরা। এসব দুর্বলতা কী কাটিয়ে ওঠা যায় না? এসব লেবেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা হলে রেল কর্তৃপক্ষ কেন দায় নেবে না। প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনার দায় রেল বিভাগ কিভাবে এড়াবে?

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার অরক্ষিত ক্রসিংয়ের কারণেই রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। তাই কারো উপর দায় না চাপিয়ে সারাদেশের ক্রসিংগুলো সুরক্ষিত করার চিন্তা ও মানসিকতা জরুরী। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, লাইনে ত্রুটি থেকে শুরু করে উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু প্রয়োজন।

রেল আর সড়কের এই সংযোগস্থলকেই লেভেল ক্রসিং বলা হয়। এগুলোকে বৈধ, অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড) এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে রেল কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞাপন

যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। পাহারাদার ট্রেন আসার সংকেত পেয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে পাহারাদার ভুল না করলে যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকা রেলক্রসিংয়ে তাই দুর্ঘটনাও খুব কম। পাহারাদার নেই এমন ক্রসিং অরক্ষিত।

অনুমোদনহীন রেলক্রসিং কার দায়িত্বে থাকবে এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে চলছে টানাহেঁচড়া অনেক দিন ধরেই। মানুষের চাহিদার প্রয়োজনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থা সড়ক নির্মাণ করেছে।

তাই রেলমন্ত্রী এককভাবে রেল দুর্ঘটনার দায় নিতে নারাজ। তবে কারো গাফিলতিতে দুর্ঘটনা হলে তার বিচারের প্রশ্নে তিনি আপোস করতে নারাজ। প্রশ্ন হলো সবই তো মানুষের প্রয়োজনে। তাহলে সব বিভাগ থেকে অর্থ নিয়ে সকল রেল ক্রসিং নিরাপদ করতে প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সব বিভাগকে চিঠি দিয়া যেতে পারে।
পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সিগনাল ও সাইরেন দু’টাই সচল করতে হবে। যাতে ট্রেন আসার সময় এই দু’টি সচলভাবে কাজ করে। তাহলেই গাড়ি চালকরা সতর্ক হতে পারবেন। রেলপথে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, এর বেশিরভাগ মারা যান রেলক্রসিংয়ে। মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি, এক ট্রেনকে অন্য ট্রেনের ধাক্কা, রেলক্রসিংয়ে গাড়িকে ট্রেনের চাপা এসবকে দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে রেল বিভাগ। এসব ঘটনাও তো কম হচ্ছে না। এর সবকিছুই তো স্থানীয় সরকার বিভাগের রাস্তার জন্য নয়? তাহলে এর দায় কাকে দিবেন?

দুর্ঘটনা এড়াতে অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ট্রেন এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘণ্টা বাজার ব্যবস্থা চালু করতে চায় রেল বিভাগ। রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কে উড়ালপথ নির্মাণ করা ও ট্রেন আসার সময় যানবাহন আটকে দেওয়ার জন্য পথরোধক বসানো এবং ট্রেন এলে তা সময়মতো নামিয়ে যানবাহনের চলাচল বন্ধ রাখার জন্য পাহারাদার নিয়োগ দিয়েও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়।

এর আগে তাৎক্ষণিকভাবে সব ক্রসিংয়ের দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি গতিরোধক বসাতে হবে। প্রতিটি ক্রসিংয়ে ফ্লাশিং লাইট বসাতে হবে, যাতে ট্রেন এলে জ্বলে ওঠে। ক্রসিংয়ে ঘণ্টা বসাতে হবে, যা ১০০ ডেসিবেল শব্দ সৃষ্টি করে।

মোট কথা হলো ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত সব দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রেলের যেখানে ক্রসিং থাকে, সেখানে সুরক্ষিত ব্যবস্থা রয়েছে।

গেটম্যানকে সক্রিয় রাখা ও ট্রেন আসার সময় পারাপারের ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড দেওয়ার দায়িত্ব রেলের, অন্য কারও নয়। তবে দুর্ঘটনা কমাতে লেভেলক্রসিং পারাপারে আরও সচেতনতা বাড়ানো দরকার। দেশের বেশিরভাগ মানুষ জানে না ট্রেন লাইনে ১৪৪ ধারা জারি ও ট্রেন লাইন যথেচ্ছ ব্যবহার নিষিদ্ধ।

তবুও পাবলিক প্লেস দিয়ে রেললাইন থাকলে লোকজন যাতায়াত করবে। এটা বিশ্বের সর্বত্র দেখা যায়। তবে অন্যান্য দেশে লেভেলক্রসিং অত্যন্ত সুরক্ষিত। অনেক ক্রসিং বা স্টেশনে দুর্ঘটনা এড়াতে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের মতো অরক্ষিত লেভেলক্রসিং বিশ্বে খুবই কম। তাই দায় না এড়িয়ে মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সমন্বিতভাবে সমস্যা সমাধানের পথে হাঁটতে পারে রেল মন্ত্রণালয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন