বিজ্ঞাপন

বিতর্কে দিনশেষে সাকিবই জিতে যান

August 13, 2022 | 9:58 pm

শামিম হোসেন শিশির, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট

যা হওয়ার কথা ছিল জলঘোলা শেষে তাই হলো। আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাংলাদেশের নতুন টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে সাকিব আল হাসানকে। চূড়ান্ত ঘোষণার আগে অবশ্য উত্তেজনা কম ছড়ালো না। বেটিং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পক্ষ থেকে ‘প্রয়োজনে সাকিবের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন’ এমন বার্তাও দেওয়া হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত জিতেছেন সাকিবই।

বিজ্ঞাপন

বেটিং প্রতিষ্ঠান বেটউইনারের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের পণ্য দূত হিসেবে মোটা অংকের চুক্তি করেছিলেন সাকিব, শর্ত মতে বিসিবির অনুমতিও নেননি। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার আগে চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের বিসিবির অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। বেটিং বাংলাদেশের আইনে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ক্রিকেট বোর্ডের নীতিরও পরিপন্থি। সে হিসেবে বেটিং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্কও বিসিবির নীতির পরিপন্থি। ফলে বিসিবির পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গ করতে বলা হয়েছিল সাকিবকে।

কিন্তু শুরুতে এতে একদমই রাজি হননি তিনি। মোটা অংকের সেই চুক্তি যেন ভঙ্গ না করতে হয়, সেজন্য বিভিন্ন তদবির করার কথাও শোনা যায়। তবে বিসিবি প্রথম থেকেই বিষয়টি নিয়ে কঠোর ছিল বলে সাকিবের চেষ্টা কাজে লাগেনি। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সরাসরি বলেছিলেন, বেটিং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ না করলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকবে না সাকিবের। বোর্ডের এমন অবস্থানের পর চুক্তি ভঙ্গের অঙ্গীকার করেন সাকিব।

তবে তাকে টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক বানানোর যে ভাবনা ছিল তা দ্বিতীয়বার ভাবতে শুরু করে বিসিবি। বোর্ডের ভাবনার বিষয় ছিল, সাকিবের মতো বুদ্ধিমান একজন নিশ্চয় জেনেবুঝেই চুক্তিটি করেছেন। জেনে বুঝে কিভাবে দেশের আইনপরিপন্থি একটি চুক্তি তিনি করলেন? অধিনায়কত্ব পেলে ভবিষ্যতে আবারও দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মতো কিছু করে বসবেন না তো? অতীতেও যে বহু বিতর্কেই জড়িয়েছেন তিনি। প্রশ্ন উঠেছে সাকিবের দায়বদ্ধতা নিয়েও। তবে এসবকে পাশ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত সাকিবই হলেন অধিনায়ক। দিন শেষে জিতেছেন সাকিবই। এবারই প্রথম নয়, আগেও বহু বিতর্কে জড়িয়ে দিন শেষে জয় হয়েছে সাকিবেরই।

বিজ্ঞাপন

২০১৪ সাল, টিভি ক্যামেরায় অশালীন ভঙ্গি

মিরপুরে এশিয়া কাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে ৬১ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ম্যাচে ছক্কা মারতে গিয়ে লং-অফে ক্যাচ আউট হন সাকিব। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী তার সেই শট ছিল একদমই বেমানান। সাকিব প্যাভিলিয়নে বসে থাকার সময় ধারাভাষ্যকাররা আলোচনা করছিলেন বিষয়টি। টিভি ক্যামেরা ঘুরে যায় সাকিবের দিকে। সেই সরাসরি সম্প্রচারে প্রকাশ অযোগ্য অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করেন সাকিব। সমালোচনার ঝড় উঠে চারিদিকে।

শোনা যাচ্ছিল, এমন কাণ্ডে বড় শাস্তিই পেতে যাচ্ছেন সাকিব। লম্বা সময়ের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ও তিন লাখ টাকা জড়িমানাতেই সেবার পার পেয়ে যান।

বিজ্ঞাপন

২০১৪ সাল, দর্শককে মারধর

ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটা গ্যালারিতে বসে দেখছিলেন সাকিবপত্নী উম্মে আহমেদ শিশির। দর্শকসারি থেকে একজন উত্ত্যক্ত করেন শিশিরকে। পরে সাকিব গিয়ে পিটিয়েছিলেন সেই দর্শককে। বিষয়টি পরে থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। ওই ঘটনায় সমালোচিত হন সাকিব। ম্যাচ চলাকালে ড্রেসিংরুম থেকে কিভাবে একজন ক্রিকেটার গ্যালারি পর্যন্ত যেতে পারেন তা নিয়ে তখন বড় প্রশ্ন উঠেছিল। শোনা যাচ্ছিল, ওই কাণ্ডে শাস্তি পেতে হবে সাকিবকে। তবে শেষ পর্যন্ত শাস্তি পেতে হয়নি তাকে।

২০১৫ সাল, আম্পায়ারকে শাসিয়ে নিষিদ্ধ

২০১৫ সালের বিপিএলে সিলেট সুপার স্টার্স-রংপুর রাইডার্স ম্যাচে আম্পায়ার তানভীর আহমেদের একটি সিদ্ধান্ত পছন্দ হয় না সাকিবের। মাঠেই সরাসরি সম্প্রচারে আম্পায়ারকে শাসান সাকিব। বিতর্কের ঝড় উঠে বিষয়টি নিয়ে। বড় শাস্তির কথা শোনা যাচ্ছিল সাকিবের। তবে শেষ পর্যন্ত ১ ম্যাচ নিষিদ্ধ ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যান তিনি।

২০১৭ সাল, ছয় মাসের ছুটি চাওয়া

মানসিক অবসাদের কথা জানিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগে হঠাৎ-ই ছয় মাসের ছুটি চেয়ে বসেন সাকিব। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগ খেলে চলেছেন বলে তার ছুটি চাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। তৎকালীন হেড কোচ চন্ডিকা হাধুরুসিংহে কিছুতেই সাকিবকে ছুটি দিতে চাইছিলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কঠিন কন্ডিশনে সিরিজের আগে দলের সেরা ক্রিকেটারের ছুটি মানতে পারেননি অনেকেই। তবে বোর্ডের অনিচ্ছা স্বত্বেও শেষ পর্যন্ত তিন মাসের ছুটি পান সাকিব।

বিজ্ঞাপন

২০১৮ সাল, ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা

বিসিবির অনাপত্তিপত্র নেওয়ার ব্যাপারটিকে তোয়াক্কা না করেই ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব। সিপিএল খেলতে যাওয়া নিয়ে তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাধুরুসিংহের সঙ্গে বাজে আচরণও করেন সাকিব। সামনেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ ছিল বলে সাকিবকে ফিরিয়ে আসতে বলে বোর্ড। জবাবে অবসর নেওয়ার হুঁমকি দেন সাকিব! সেবার কঠোর হয়েছিল বোর্ড।

সাকিবকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। বাতিল করে দেওয়া হয় সব অনাপত্তিপত্র। পাশাপাশি হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে শৃঙ্খলাভঙ্গের মতো কাজ করলে নিষিদ্ধ করা হবে আজীবন। কিন্তু সেই হুঁশিয়ারিতে কাজ হয়নি।

২০১৯ সাল, দলীয় ফটোসেশন বাদ দিয়ে বিজ্ঞাপনের শুটিং

২০১৯ বিশ্বকাপের দলীয় ফটোসেশনে উপস্থিত ছিলেন না সাকিব। ফটোসেশনের ঘণ্টাখানেক আগেও মিরপুর স্টেডিয়ামে ছিলেন তিনি। পরে ফটোসেশন না করেই বেরিয়ে যান। পরে জানা যায়, একটি বিজ্ঞাপনের শুটিং করতে বেরিয়ে যান তিনি। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিসিবি সভাপতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে এর জন্য কোনো শাস্তি পেতে হয়নি সাকিবকে।

২০১৯ সাল, ১ বছরের জন্য নিষিদ্ধ:

আইপিএল খেলার সময় জুয়াড়িদের কাছ থেকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে তা গোপন করেছিলেন সাকিব। তাতে আইসিসি কর্তৃক দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন, যার এক বছর ছিল স্থগিত নিষেধাজ্ঞা। তবে বিষয়টিকে ‘বড় অপরাধ’ বলে সাকিবের ১ বছরের শাস্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। কয়েকজন বিদেশি সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক সরাসরি বলেছিলেন, সাকিবের আরও বড় শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।

২০২১ সাল, শ্রীলংকা সফরে না গিয়ে আইপিএলে:

শ্রীলংকা সফরে না গিয়ে আইপিএল খেলার ছুটি চেয়েছিলেন সাকিব। একই সময় শ্রীলংকার বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট সিরিজ বলে সাকিবের ছুটি চাওয়ার বিষয়টিতে অবাক হন অনেকে। গুরুত্বপূর্ণ সেই সিরিজে সাকিবকে খুব করেই দরকার ছিল বাংলাদেশের। তবে সেখানে শেষ পর্যন্ত সাকিবেরই জয় হয়। দেশের হয়ে টেস্ট খেলা বাদ দিয়ে আইপিএল খেলতে ছুটি পান তিনি। বিসিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, খেলতে না চাইলে কাউকে জোর করে খেলানোর কোনো মানে হয় না।

২০২১ সাল, জৈব সুরক্ষা বলয় ভঙ্গ:

কোভিড পরিস্থিতিতে ক্রিকেট হচ্ছিল কড়াকড়ি নিয়মে। সাকিব সেই নিয়ম ভঙ্গ করেন। সুরক্ষা বলয়ে না থাকা এক বোলারকে নিয়ে অনুশীলন করেন। সাকিবের অনুশীলনে সাদা শার্ট পরা এক ব্যক্তিকেও দেখা যায়। তিনিও সুরক্ষা বলয়ে ছিলেন না। এতে সাকিবের দল মোহামেডান শুধু নয়,  ডিপিএল খেলা সব ক্রিকেটারই কোভিড ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। কিন্তু ক্ষমা চেয়েই ওই যাত্রায় বেঁচে যান সাকিব।

২০২১ সাল, মেজাজ হারিয়ে স্টাম্পে লাথি:

ডিপিএলে আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্ত পছন্দ হয় না মোহামেডানের সাকিব আল হাসানের। মেজাজ হারিয়ে স্ট্যাম্পে লাথি মেরে দেন সাকিব। বৃষ্টি বিরতির পর খেলা শুরু হলে ফের চটে যান তিনি। দুই হাতে এক প্রান্তের তিন স্ট্যাম্প তুলে আছাড় দেন। এমন আচরণ হতভম্ব করে অনেককে। শোনা যাচ্ছিল, বড় শাস্তিই পেতে যাচ্ছেন সাকিব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ আর পাঁচ লাখ টাকা জরিমানায় পার পান।

সাকিব আল হাসানের বিতর্কিত অধ্যায়ের সর্বশেষ সংযোজন বেটিং ওয়েবসাইটের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি। প্রায় প্রতিবারের মতো এবারও পার পেয়ে গেলেন সাকিব।

সারাবাংলা/এসএইচএস

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন