বিজ্ঞাপন

ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি রূপালী গিটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু

August 16, 2022 | 2:27 pm

রশীদ এনাম

গিটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালে ১৬ আগষ্ট চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তার ডাক নাম ছিল রবিন। নানা নানীরা আদর করে ডাকত বাঁশী। আইয়ুব বাচ্চু বা এবি বলে পরিচিত। দাদা বাড়ি পটিয়া খরনা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড’র নুরজামান সওদাগর বাড়িতে। তার শৈশব কৈশোর বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম নগরীতে। আইয়ুব বাচ্চু প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করেন সেন্ট মেরীস স্কুল থেকে। পরবর্তীতে মুসলীম হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজে। লালখান বাজারের জ্যাকব ডায়াসের বাসায় গিটার প্র্যাকটিস করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত। ১৯৯১ সালে প্রেম করে বিয়ে করেন ফেরদৌস চন্দনাকে। মগজাবাজারে থাকতেন পরিবার নিয়ে। আইয়ুব-চন্দনা দম্পতির দুই সন্তান-ছেলে আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব ও মেয়ে ফাইরুজ। আইয়ুব বাচ্চু ব্যক্তিগত জীবনে ছিল বেশ সদালাপি ও মিষ্টভাষী ছিলেন। তার সৃষ্টিশীলতা ছিল আধুনিক। বিনয়ী আইয়ুব বাচ্চু সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত উপস্থাপনা ও গান গেয়ে গিটার বাজিয়ে মুগ্ধ করেন দর্শক শ্রোতাদের।

বিজ্ঞাপন

স্কুলবেলা থেকে গান করতেন। বিয়ে শাদী নানা অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। জীবনে গান গেয়ে প্রথম সম্মানি পেয়েছিলেন ৩০ টাকা। ছোটবেলা থেকে গিটার বাজাতে পছন্দ করতেন। স্পাইডার ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকব ডায়েসের হাতে তার গিটারের হাতে-খড়ি। এক সময় বন্ধুরা মিলে গোল্ডেন বয়েজ পরবর্তীতে আগলী বয়েজ নামে ব্যান্ড গঠন করেন। পরবর্তীতে স্পাইডার ব্যান্ডে গিটার বাজাতেন। ১৯৭৮ সালের ফিলিংস ব্যান্ডের মধ্যে দিয়ে যাত্রাশুরু। তার কন্ঠে ১ম গাওয়া গান ছিল শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা ‘হারানো বিকেলের গল্প’। ১৯৮০ সালের দিকে যোগ দেন ব্যান্ড সোলসে। তখন সোলসে ছিল সাজেদুল আলম, তপন চৌধুরী, নকিব খান, রনি বড়ুয়া, পিলু খান, শাহেদ, লুলু।

১৯৮৬ সালে আইয়ুব বাচ্চুর একক এ্যালবাম ছিল ‘রক্ত গোলাপ’ ১৯৮৮ সালে ‘ময়না’, ১৯৯৫ সালে ‘কষ্ট’, ১৯৯৮ সালে ‘সময়’, ১৯৯৯ সালে ‘একা’, ২০০২ সালে ‘প্রেম তুমি কি’, ‘দুটি মন’, ‘কাফেলা’ নামে এক সাথে তিনটি একক এ্যালবাম বের হয়। ২০০৩ সালে ‘প্রেম প্রেমের মতো’, ২০০৪ সালে ‘পথের গান’, ২০০৬ সালে ‘ভাটির টানে মাটির গানে’, ২০০৬ সালে ‘জীবন’, ২০০৭ সালে ‘সাইন্ড অব সাইলেন্স(ইন্সট্রুমেন্টাল)’, ২০০৮ সালে ‘রিমঝিম বৃ’ষ্টি, ২০০৯ সালে ‘বলিনি কখনও’, ‘জীবনের গল্প’ ২০১৫ সালে।

বাচ্চু ভাইয়ের সাথে সেদিন ছবিও তুলেছিলাম, আহা স্মৃতি ছবি যেন আজও গান গাই

বাচ্চু ভাইয়ের সাথে সেদিন ছবিও তুলেছিলাম, আহা স্মৃতি ছবি যেন আজও গান গাই

১৯৯০ সালের দিকে এলআরবি ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করলেন, এলআরবির পুরো নাম ছিল-লাভ রানস ব্লাইন্ড পরে হলো লিটল রিভার ব্যান্ড। ১৯৯২ সালে এলআরবি ব্যান্ড দলের ১ম গানের এ্যালবাম বের হয়। এলআরবি শ্রোতাদের মধ্যে সারা ফেলে দেয়। ঘুম ভাঙ্গা শহরে শেষ চিঠি কেন এমন চিঠি হয়, হকার এই গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৩ সালে সুখ ১৯৯৪ সালে তবুও ১৯৯৫ সালে ঘুমন্ত শহর ১৯৯৬ সালে ফেরারী মন ও স্বপ্ন। ১৯৯৮ সালে আমাদের বিস্ময়, ২০০০ সালে মন চাইলে মন পাবে। অচেনা জীবন ২০০৩ সালে, মনে আছে নাকি নাই ২০০৫ সালে, ২০০৮ সালে স্পর্শ, ২০১২ সালে বের হয় যুদ্ধ নামে এ্যালবাম ইত্যাদি এ্যালবাম বের হয়।

বিজ্ঞাপন

আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ নিজের লিখা ও সুরে গাওয়া। রূপালী গিটার ফেলে একদিন চলে যাব বহুদুরে। ফেরারী এই মন টা আমার মানে না। নব্বই দশকে তরুন তরুনীদের মাঝে গানগুলো সারা ফেলে দেয়। জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায় আইয়ুব বাচ্চু। এলআরবি বাচ্চু মানে হিট। বিশেষ করে প্রথম আলো মাদকবিরোধী কনাসার্টগুলোতে প্রায় সময় বাচ্চু গান করত। এলআরবি ব্যান্ডের কনসার্ট মানে তরুন তরুনীদের উপচে পড়া ভীর। জিমি হেন্ড্রিক্স ও জো সেট্রিয়ানী, স্টিভ মোর হয়ে উঠেন তার অনুপ্রেরণার উৎস। ওদের বাজানোকে ফলো করতেন বেশি।

বাবা-মা চাইতেন না ছেলে গান বাজনা করুক, গায়ক হোক। বাচ্চুর বাবা বলতেন, ‘বাড়িতে বাউয়ালদের কোন জায়গা নেই’। কোন এক সময় চাপা অভিমান করে বড় স্বপ্ন নিয়ে চলে যান ঢাকায়। মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলের মেঝেতে থাকতেন।

ঢাকায় এসে স্বপ্নবাজ বাচ্চু অনুশীলন, সাধনা, একাগ্রতায় একসময় জনপ্রিয় গায়ক ও গিটার জাদুকর হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার মধ্যে শিকড়ের টান ছিল। চাটগাঁইয়া কারও সাথে দেখা হলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। আইয়ুব বাচ্চু শিশুদের খুব পছন্দ করতেন। তার এক আত্মীয়ের শিশুর চিকিৎসার জন্য ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছিলেন। তার আর্থিক সহযোগিতায় শিশুটি বেচে যায়। মসজিদ মাজার এতিমখানায় দানও করতেন। বাচ্চু তার মাকে খুব ভক্তি করতেন। বাবা-মা’কে কখনও কষ্ট দেননি। এক অনুষ্ঠানে সবার প্রতি হাত জোর করে বলেছিলেন, প্লিজ বাবা-মা’কে কেউ কষ্ট দিবেন না। খবরদার বাবা-মা’কে কেউ বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবেন না।

বিজ্ঞাপন
আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে চট্টগ্রাম নগরীর প্রবর্তক মোড়ে রূপালি গিটারের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে

আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে চট্টগ্রাম নগরীর প্রবর্তক মোড়ে রূপালি গিটারের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে

বাচ্চু ভাইয়ের সাথে চট্টগ্রাম সমিতির মেজবান ও মিলন মেলায়, পরবর্তীতে প্রথম আলো মাদকবিরোধী কনসার্ট জিপি-৫ সংবর্ধনাসহ নানা কনসার্টে দেখা হতো। নিজ এলাকার হওয়াতে মাঝে মাঝে আড্ডাও দিতাম। প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতিটা আজও ভুলিনি। কোন এক কনসার্টে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করার সময় হাসি দিয়ে বাচ্চু ভাই বললেন, ‘বাড়ি হন্ডে? চাটগাঁ নে ওবা’, আমি বললাম ভাইয়া পটিয়া। বাচ্চু ভাই আমাকে হেসে বললেন ‘বদ্দা আইঁও পইট্ট্যা’, জড়িয়ে ধরলেন। তার একটা কমন ডাইলগ সবসময় বলতেন, ‘আঁরা চাটঁগাইয়া ফোয়া মেডিত ফরলেই লোয়া’। কালো টি শার্ট পরিধান অবস্থায় বাচ্চু ভাইয়ের সাথে সেদিন ছবিও তুলেছিলাম। আহা স্মৃতি ছবি যেন আজও গান গাই।

মা মাঠি ও মাতৃভুমির প্রতি তার যে টান এবং তরুন সমাজকে অন্ধকার জগত থেকে বিশেষ করে মাদক ও তামাক থেকে দুরে থাকার জন্য সবসময় উপদেশ দিতেন। কনসার্ট শেষ করতেন গিটারে করুন সুরে মধুর কন্ঠে হৃদয় উড়াড় করে গাইতেন, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসী সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, এতো সুন্দর করে গিটারের মূর্ছনা যে কারও হৃদয় স্পর্শ করত।

বাচ্চুর গান মানে আমার কাছে দুটি হৃদয়ের সবিনয় নিবেদন এবং ভাবের জগতে ভেসে বেড়ানো। ভালোবাসা রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। আজও তার গান আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়। এবির গানে যেমন ছিল আবেগ তেমন ছিল অভিমান কষ্ট চিরন্তন সত্য বাণী।

তার একটা ডাইলগ ছিল, ‘দেশকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে কেন না মা কষ্ট পেলে দেশ কষ্ট পাবে’। হৃদয় নিয়ে এবি বলেছেন ‘মানুষের হৃদয় অনেকটা কাঁচের মতো যেমন কাঁচ হাত থেকে পড়ে গেলে চুর্ন হয়ে যায়’।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে তিনি এবি লাউঞ্জ করতে চেয়েছিলেন নব্য ব্যান্ড শিল্পীদের জন্য। যেখানে নব্য গায়করা গিটার বাজাবে, গাইবে নতুন শিল্পী তৈরী করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল চট্টগ্রাম শহরে সুন্দর করে একটি বাংলো বাড়ি করার এবং সে বাড়িতে বাবাকে এনে রাখার কথা ছিল। পটিয়া গ্রামের বাড়িতে একটি হাসপাতাল করারও স্বপ্ন ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। সবকিছু আজ স্মৃতি!

১৬ অক্টোবর আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের শেষ কনসার্ট হয়েছিল রংপুর জিলা স্কুল মাঠে। শেখড়ের সন্ধানে নামে কনসার্ট শুরুতে সবাইকে বলেছিলেন, ‘কেমন আছেন সবাই-লাভ ইউ, শুরুতে স্মরন করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী ও রাজনীতির কবি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে’। গিটার জাদুকর ১৮ অক্টোবর ২০১৮ সালে রূপালী গিটার ফেলে চিরতরে উড়াল দিলেন আকাশে। তার স্মরণে চট্টগ্রাম নগরীর প্রবর্তক মোড়ে রূপালি গিটারের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। ৬০তম জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: লেখক ও প্রাবন্ধিক

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন