বিজ্ঞাপন

চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বাঘিনীদের অভিনন্দন

September 20, 2022 | 1:40 pm

তাপস হালদার

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তৈরি হলো নতুন ইতিহাস। নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নয়া রেকর্ড গড়লো বাংলাদেশের বাঘিনীরা। নতুন চ্যাম্পিয়ন পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ খ্যাত সাফ টুর্নামেন্ট। এর আগে পাঁচটি টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন ছিল ভারত। সেই ভারতকেই গ্রুপ পর্বে ৩-০ গোলে পরাজিত করে সেমিফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। শিরোপার যোগ্য দাবিদারই ছিলো বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনাল পর্যন্ত ২৩ টি গোল দিয়েছে বাংলাদেশ, বিপরীতে ফাইনালের একটি মাত্র গোলই তাদের হজম করতে হয়েছে। এমন অপ্রতিরোধ্য দলকে আর থামাবে কে?

বিজ্ঞাপন

এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে নারীদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে বাংলাদেশ। সেসময়ও পুরো টুর্নামেন্টে দাপট দেখিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পুরুষ দল সর্বশেষ সাফ গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দীর্ঘ ১৯ বছর পর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হল বাংলাদেশ নারী দল। বয়স ভিত্তিক দলের সাফল্য থাকলেও জাতীয় নারী দলের প্রাপ্তি শূন্যই ছিল। ২০১৬ সালে ফাইনালে ভারতের কাছে রানার্সআপ হওয়াটাই ছিল সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।

একসময় বাংলাদেশে ফুটবলই ছিল জনপ্রিয় খেলা। গ্রাম গঞ্জের প্রতিটি জায়গায় ফুটবল খেলা হতো। ঢাকার ক্লাব গুলোর খেলায় ছিল বাড়তি উন্মাদনা। আবাহনী ও মোহামেডানের খেলা হলে তো কথাই নাই, দর্শকদের ভিড়ে ঠাসা থাকতো গোটা স্টেডিয়াম। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ সহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে দাপট দেখিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল। তার সবই ছিল পুরুষদের ফুটবলকে ঘিরে। সেই বাংলাদেশের ফুটবলের বর্তমান পারফরম্যান্স খুবেই হতাশাজনক। কিন্তু নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। শুধুমাত্র জাতীয় দল নয়, অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮ ও অনূর্ধ্ব-১৯ বয়স ভিত্তিক দলগুলো ধারাবাহিক ভাবে সাফল্য দেখিয়ে আসছে। যার ফলে তারা গত আট বছরে বয়স ভিত্তিক টুর্নামেন্টে আটটি শিরোপা জিতেছে।

বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলের বয়স মাত্র দুই দশক। ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ মহিলা ফুটবল দলের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মৌলবাদীদের হুমকির কারণে মেয়েদের ফুটবল সেভাবে আর আগাতে পারেনি। মুলত ২০১১ সাল থেকে যখন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের জাগরণ শুরু হয়। আজকের নারী দলের তারকা মারিয়া মান্ডা, তহুরা, মনিকা, সানজিদা, মারজিয়া, মৌসুমী, শামসুন্নাহার, মাকসুদাসহ অধিকাংশরাই বঙ্গমাতা ফুটবল খেলেই উঠে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

আজ দেশে-বিদেশে নজরকাড়া সাফল্য পাওয়াতে বাংলাদেশের সকল মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। এত দিন পারিবারিক ও সামাজিক বাধা, অর্থের নিশ্চয়তার অভাবে মেয়েদের ফুটবল এগোতে পারেনি। কিন্তু আস্তে আস্তে সকল বাধা কাটিয়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে।

ক্রীড়ামোদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার নারী ফুটবল তারকাদের গণভবনে ডেকে সংবর্ধনা, আর্থিক প্রণোদনাসহ বিভিন্ন পুরস্কার দিয়েছেন। এতে করে নতুন প্রজন্মের মেয়েরা ফুটবল খেলতে আরো উৎসাহিত হচ্ছে। নারী ফুটবলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই উঠে এসেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। কলসুন্দরের মারিয়া মান্ডা যেমনটি বলেছিলেন, ‘আমরা আনন্দ করার জন্য ফুটবল খেলতাম। প্রধানমন্ত্রী যদি তার মায়ের নামে প্রাইমারি স্কুল ফুটবল শুরু না করতেন তাহলে আমরা এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।’ নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনও মেয়েদের বদলে যাওয়ার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর অবদানকেই বড় করে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে মেয়েদের খেলা শুরু করেই প্রতিভা বাছাইয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন। এরপর আবার যখন সাফল্য এসেছে তখনই মেয়েদের ডেকে পুরস্কার দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আবার চ্যাম্পিয়ন হওযার পর প্রধানমন্ত্রী ফোন করে খোঁজ খবর নেন। একবার নেপালে ভূমিকম্পের কারণে যখন আটকা পড়েছিলাম তখন হেলিকপ্টার পাঠিয়ে মেয়েদের ফিরিয়ে এনেছেন। এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কি হতে পারে। মেয়েদের ফুটবল খেলে পরিবার বদলে দেযার পেছনে বড় অবদান বঙ্গবন্ধু কন্যারই।’

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসুন্দর গ্রামটি সারা বাংলাদেশের কাছে পরিচিত। অথচ কিছুদিন আগেও এই গ্রামকে কেউ চিনতো না। নারী ফুটবলের কারণে গ্রামটিকে সারা দেশের মানুষ চিনেছে। ২০১৬ সালে খেলার কারণে ছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল শিক্ষকেরা, এমন কি অভিভাবক ডেকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকিও দিয়েছিল। আজ দিন বদল হয়েছে সেই ছাত্রীরা শুধুমাত্র শিক্ষকদের নিকটই নয়, সারা দেশেরই গর্ব। তাদের কৃতিত্বের জন্য মুহুর্তেই বদলে গেছে কলসুন্দর গ্রাম।

বিজ্ঞাপন

বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশমাতৃকার মুক্তি অসম্ভব।’ বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আর নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা নিজেকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। ক্রীড়াঙ্গনেও সাফল্যের ধারায় আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। আজকের নারী ফুটবলারদের বিজয় সেই ধারাবাহিতারই ফসল। ফাইনালের আগে দলের অন্যতম সদস্য সানজিদা আক্তার তার ফেসবুকে একটি স্টাটাস দিয়েছিল যা বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের আপ্লূত করে। তিনি বলেছেন, ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, ১১ জনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব। জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে। তবে বিশ্বাস রাখুন, আমরা আমাদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখব না, ইনশাআল্লাহ।’ কথা রেখেছেন সানজিদারা। এ জয় নারী জাগরণের জয়, এ জয় বীর যোদ্ধাদের, পুরো বাংলাদেশের। লাল বাঘিনীদের অভিনন্দন।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন